ঋষি কপূর: ২০০১ থেকে চরিত্রাভিনেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করেন।। ছবি-পিটিআই।
আধুনিক ভারতের সেলুলয়েডে নতুন ধারার প্রেমের দূত ছিলেন ঋষি কপূর। যেন এক্কেবারে ‘টেলর মেড’। করোনা মহামারির এই আবর্তে ইরফান খানের পর ক্যানসার কেড়ে নিল তাঁকেও। বাঙালির অতি প্রিয় ঋষি কপূর। বয়স হয়েছিল ৬৭। ঋষিকে আসমুদ্রহিমাচল প্রথম চিনেছিল গোয়ানিজ মেয়ে ববি ব্রিগেঞ্জার প্রেমিক রাজ হিসেবে। ববি আর রাজ, দু’জনকেই ভালবেসে ফেলেছিল ভারতবাসী। এই দুই টিনএজার নায়ক-নায়িকা আধুনিক ভারতীয় সিনেমায় প্রেমের সংজ্ঞাই বদলে দিয়েছিলেন।
তবে সিনেমার পর্দায় ঋষি কপূরের প্রথম আবির্ভাব ‘শ্রী৪২০’ ছবিতে। যাঁরা এই ছবি দেখেছেন তাঁরা মনে করতে পারবেন, ছবিতে রাজ কপূর ‘প্যার হুয়া, ইকরার হুয়া’ গানটি গাইতে গাইতে চলেছেন আর তাঁর সঙ্গে রয়েছে দু’টি শিশু। এই দু’জনের এক জন হলেন ঋষি কপূর। ঋষির কথায়, নার্গিস নাকি চকোলেট খাওয়ানোর লোভ দেখিয়ে তাঁকে ওই দৃশ্যে অভিনয় করিয়ে নিয়েছিলেন। এর পর ‘মেরা নাম জোকার’ ছবিতে পিতা রাজ কপূরের ছোটবেলার ভুমিকায় অভিনয় করানো হয় তাঁকে। এই ছবিতে অভিনয়ের জন্য তিনি শ্রেষ্ট শিশুশিল্পী হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পান।
কলকাতার সঙ্গে ঋষি কপূরের সম্পর্কের শুরু সেই ১৯৭০ সালের জুন মাস থেকে এবং এই ছবির সূত্রেই। তিনি ‘মেরা নাম জোকার’ ছবির প্রিমিয়ার শো’তে রাজ কপূরের সঙ্গে হাজির হয়েছিলেন কলকাতার ‘লোটাস’ সিনেমায়। সেই ছবিতে অভিনয়ের জন্যই তিনি বাংলার বিএফজে-র ‘বিশেষ পুরস্কার’ পান জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার আগেই। এটিই হল তাঁর জীবনের প্রথম পুরস্কার।
অনেকের ধারণা, ঋষি কপূরকে হিন্দি সিনেমার জগতে নিয়ে আসতেই রাজ কপূর ‘ববি’ বানিয়েছিলেন। কিন্তু ঋষি জানিয়েছিলেন, “আসলে ‘মেরা নাম জোকার’ ছবির দেনা মেটাতে বাবা ‘ববি’ তৈরি করেন।” ববি ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। সারা দেশের মধ্যে এই ছবি বাংলায় সব থেকে বেশি ব্যবসা করেছিল।
বলিউডের নবীন প্রজন্মের সঙ্গেও সমান সাবলীল ছিলেন ঋষি। ছবি-পিটিআই।
১৯৭৩ সালে মেট্রো সিনেমায় ‘ববি’ ছবির প্রিমিয়ার শোতে তাঁর দেখা হয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে। রাজ কপূর তাঁর দ্বিতীয় সন্তান ঋষিকে সত্যজিতের সামনে এনে বলেছিলেন “প্রণাম করো, ইনি আমাদের সকলের গুরু।” সত্যজিৎ রায় সে দিন হাসি মুখে ঋষি কপূরকে আশীর্বাদ করেছিলেন। কালক্রমে ভারতীয় সিনেমার প্রধান ও অপরিহার্য এক জন অভিনেতা হয়ে উঠেছিলেন ঋষি।
চলচ্চিত্র বিশ্লেষক রঞ্জন দাশগুপ্তকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, ঋষি কপূরের প্রিয় জায়গা ছিল দার্জিলিং। সত্যজিতের ‘নায়ক’ ছবিটি তিনি তিন বার দেখেছিল মুগ্ধ হয়ে। হেমন্ত ও মান্না ছিলেন তাঁর প্রিয় গায়ক। সুপ্রিয়া চৌধুরীকে তিনি মনে করতেন হলিউডের অভিনেত্রীদের সমতুল। উত্তমের ময়রা স্ট্রিটের বাড়িতে তিনি একাধিক বার গিয়েছেন। কলকাতার ‘মেট্রো’ সিনেমা বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে বলেছিলেন এক বিরাট ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটল।
১৯৭০ থেকে ২০০০ সাল অবধি ঋষি কপূর ছিলেন রোম্যান্টিক হিরো। হিসেব করলে এই সময়ে তাঁর অভিনীত ছবির সংখ্যা প্রায় ৫১। ‘লয়লা মজনু’, ‘রফু চক্কর’ থেকে ‘দারার’ ও ‘কারবার’ ছিল এই সময়কালের ছবি। মুম্বই ইন্ডাস্ট্রির হিসেবের খাতা অনুযায়ী, এই ৫১টি ছবির মধ্যে ১১টি ছবিই হিট।
২০০১ থেকে তিনি চরিত্রাভিনেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করেন। এই সিদ্ধান্ত তিনি সচেতন ভাবেই নিয়েছিলেন। ২০২০ পর্যন্ত ‘ইয়ে হ্যায় জলবা’, ‘হাম তুম’ থেকে ২০১৯-এ জিতু জোসেফের ‘দ্য বডি’ ছবি অবধি তাঁকে আমরা সে ভাবেই পেয়েছি। এর মধ্যে রয়েছে ২০০৯-এর ‘চিন্টুজি’র মতো ছবি। জানা গিয়েছে, হিতেশ ভাটিয়ার ‘শর্মাজি নমকিন’ ছবির শুটিং অসমাপ্তই রয়ে গেল। ১৯৭৩ থেকে ২০০০ অবধি তিনি ৯২টি ছবিতে অভিনয় করেন।
তাঁর প্রিয় অভিনেতাদের মধ্যে ছিলেন রাজ কপূর, দেবানন্দ, শাম্মি কপূর, দিলীপকুমার। এঁদের অভিনয় তিনি অবাক হয়ে দেখতেন আর শেখার চেষ্টা করতেন। তাঁর অভিনয়ে এঁদের ছাপ পড়েছিল। তবে শুরুর দিকে ‘হাম কিসিসে কম নেহি’ ছবিতে শাম্মি কপূর তাঁর নাচের ভঙ্গির ভুল শুধরে দিয়েছিলেন বলে চিরকাল কৃতজ্ঞ থেকেছেন।
বলিউডের প্রেমের ছবির মাইলফলক ‘ববি’। ফাইল চিত্র।
তবে মনে করতেন, তাঁর বাবা-কাকারা অভিনেতা হিসেবে যে শীর্ষে পৌঁছেছিলেন তিনি কখনওই সেই উচ্চতায় পৌঁছতে পারেননি। “কারণ চিরকাল আমাকে প্লে বয় অভিনেতা হিসেবেই ইন্ডাস্ট্রি ব্যবহার করেছে।” তাঁর খুব ইচ্ছে ছিল, বাবার ‘তিসরি কসম, দেবানন্দের ‘গাইড’ বা গুরু দত্তর ‘পিয়াসা’র মতো ছবির চরিত্রে অভিনয় করবেন। কাকা শাম্মি কপূরের ‘প্রফেসর’ ছবিতে চরিত্রকে যে ভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তাকেই তিনি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের শ্রেষ্ঠ রূপ বলে মনে করতেন। অভিনয় জীবনে তিনি নাসিরুদ্দিন শাহ ও অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে কাজ করে শিখেছিলেন নিয়মানুবর্তিতা বলতে কী বোঝায়। অমিতাভের সঙ্গে ‘অমর আকবর অ্যান্টনি’, ‘পা’, ‘১০২ নট আউট’ ছবিতে অভিনয় তাঁকে অনেক কিছু শিখিয়ে ছিল।
আরও পড়ুন: ঋষির সঙ্গে শেষ দেখা আর হল না : হেমা মালিনী
তবে ভাল চরিত্রের জন্য খিদে তিনি মিটিয়ে নিয়েছিলেন ১৯৮৯-তে ‘টু চেজ আ ক্রুকেড শ্যাডো’ অবলম্বনে তৈরি ‘খোঁজ’-এর মতো ছবিতে অভিনয় করে। এই ছবিতে তিনি তাঁর অভিনয়কে সেরা বলে মনে করেন। তাঁর সহ-অভিনেতা ছিলেন নাসিরুদ্দিন শাহ। ২০১৮ সালে তাপসী পান্নুর সঙ্গে ‘মুলক্’ ছবিতে ঋষি কপূরকে অন্য চেহারায় পাওয়া গেল। এই অভিনয়কে তিনি আজীবন মনে রাখতে চেয়েছেন। এই সময় তিনি হয়ে উঠেছিলেন সমাজসচেতন। গো মাংস ভক্ষণ নিয়ে তাঁর করা ট্যুইট সারা দেশে হইচই ফেলে দিয়েছিল।
তিনি ছিলেন অনুভবী শিল্পী। বলতেন, “মাথা দিয়ে অভিনয় আমার দ্বারা হবে না।” তাঁকে গড়ে দিয়েছিলেন বাবা রাজ কপূর ও স্ত্রী নিতু সিংহ। বলেছিলেন, “আমাকে এঁরাই ঋষি কপূর বানিয়েছেন।”
তাঁর মতো আজন্ম প্রেমিক নায়ক চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বলিউড আরও একটু বিবর্ণ হল।
আরও পড়ুন: আমি ধ্বংস হয়ে গেলাম: অমিতাভ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy