‘লালবাজার’ রক্ত দেখিয়েছে, চোরাকারবারি দেখিয়েছে, কিন্তু জনসাধারণকেও দেখিয়েছে।
অন্ধকার গলি, কথায় কথায় রক্তপাত, যৌনতা— অভাব ছিল না কিছুরই। সঙ্গে এক ঝাঁক নামী ও দক্ষ অভিনেতা।
অঙ্ক তবু মিলল না!
এক-একটা সময় বুঝি শুধু একই ধারার গল্পের রসদ জোটে? তখন সকলে এক ধরনের কাজ করতে চান কি? ঘরে বসে অনলাইন কাজের এই ডামাডোলের মাঝে ইন্টারনেটে বিনোদন মানেই দেখা যাচ্ছে চোর-পুলিশের খেলা। এ যেন সর্বত্র ডালগোনা চ্যালেঞ্জ চলছে!
লালবাজার
পরিচালক: সায়ন্তন ঘোষাল
অভিনয়ে: কৌশিক সেন, সব্যসাচী চক্রবর্তী, হৃষিতা ভট্ট, গৌরব চক্রবর্তী, দিব্যেন্দু ভট্টাচার্য, রঞ্জিনী চক্রবর্তী
কোনও একটা মডেল ক্লিক করলে, তা বার বার ব্যবহার করা নতুন নয়। তবে এখন কিন্তু সেটাই সবচেয়ে বড় ট্র্যাপ! ‘লালবাজার’-এর এপিসোডগুলি দেখতে দেখতে এ কথা মনে এল বইকি। দেখতে যে খারাপ লেগেছে, তেমনটা বলা যায় না। গল্প যেমনই হোক, চলন বেশ টানটান। কিন্তু কখন কোন গল্প বলা হচ্ছে, কাদের গল্প বলা হচ্ছে— তার উপরে সিরিজের ভবিষ্যৎ অনেকটাই নির্ভর করে। আর সেই গল্প বলার ভঙ্গি যেন বড্ড ‘রিপিটেটিভ’ হয়ে গেল। টাইটেল কার্ড থেকে দর্শকের মনে হতে থাকবে, কোথায় যেন দেখে ফেলেছেন তিনি এই সব ফ্রেমগুলো। প্রতিটা ফ্রেম, গল্পের মোড়, পুলিশের চাল, ভিলেনের ঢাল— সব যে এত দিনে চিনে ফেলেছেন ওটিটি-র দর্শক।
এ কথা কি ভুলে গেলে চলবে যে, গত কয়েক মাস ধরে সামাজিকতা, বন্ধুবান্ধব, পাব-পরকীয়া সব ছেড়ে স্ক্রিনে মুখ গুঁজে বসে আছেন গ্রাহকেরা? তাঁদের সব দেখা হয়ে গিয়েছে। নার্কোস, সেক্রেড গেম বার দুই করে হয়ে গিয়েছে পুরোটা। মির্জাপুর, দিল্লি ক্রাইমও ভোলেনি। মাঝে টুক করে ‘শি’ দেখেছে। ‘পাতাল লোক’-এর হাথোড়া ত্যাগিকে নিয়ে হইহই করেছে। তারা অন্য সময়ে এ সব গল্প ভুলতে মাত্র দু’মিনিট সময় নিলেও, এখন তো তা হবে না। সময়টা এমনই যে এই সবই তাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। তারা দিব্যি মনে রাখছে চার বছর আগের রঙ্গবতি চ্যালেঞ্জে কোন অভিনেত্রী কী রকম গয়না পরেছিলেন। না মনে থাকলে খুঁজে বার করেছে। তাই দিয়ে নতুন চ্যালেঞ্জ-চ্যালেঞ্জ খেলা শুরু করছে। দর্শকের মেজাজ যখন এই মাত্রায় উৎফুল্ল, তখন ছকে বাঁধা গল্পটা বলার চ্যালেঞ্জটা কি না নিলেই হত না? ‘লালবাজার’ নিশ্চয়ই ‘পাতাল লোক’-এর অনুপ্রেরণায় বানানো নয়। অন্তত রিলিজের সময় দেখে তেমনই ধরে নিতে হবে। তবে এই লকডাউনের মধ্যে, এক মাসেরও কম ব্যবধানে যদি পর পর এমন দু’টি কাহিনি দেখে ‘ক্লিশে’ বলে দর্শক, তবে কি তা অমার্জনীয় অপরাধ বলা যেতে পারে? প্রযোজক একটু ভেবে দেখলে ভালই হয়।
আরও পড়ুন: একাধিক সম্পর্কে বিশ্বাসী বলেই হয়তো এত বার প্রেমে পড়েছি: সুমন
আরও পড়ুন: ‘বাবার জন্যই আজ এখানে, সুবিধা পাই, এ আমার কর্মফল’, বিস্ফোরক সোনম কপূর
চোর-পুলিশের খেলা দেখতে এমনিতে ভালবাসে গোটা দুনিয়াই। তার মধ্যে কয়েক দফা কঠিন গালিগালাজ, রগরগে রসিকতা, যৌনপল্লি, ড্রাগ্স, অপরাধ— এ সব তো মনের লুকনো কোণে কম আনন্দ দেয় না। তাই এই সিরিজটাও দেখবেন অনেকে। তবে কাজু-কিসমিশ ঢাললেই তো আর সবসময় মায়ের হাতের পায়েসের স্বাদ আসে না বোনের পরমান্নের হাঁড়িতে। মুশকিলটা সেখানেই। পায়েস রান্না একটা ট্রেন্ড। অনেকেই তা চেখে দেখবেন। কিন্তু এ হাঁড়িতে অন্য কিছু হলেও তো পারত।
‘লালবাজার’-এ নতুন বলতে শুধু প্রেক্ষাপটটাই। মানে দিল্লি-মুম্বই-উত্তরপ্রদেশের গ্রাম না দেখিয়ে সোজা কলকাতা। চিনে পাড়া, বন্দর এলাকা, যৌনপল্লির অলিগলি— সব মিলে কলকাতা দেখতে বেশ ভালই লাগে। বাঙালি মধ্যবিত্ত সে সব জায়গায় বেশি অভ্যস্ত না হলেও, সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের দর্শকের তালিকা লম্বা। তাঁদের এই সব জায়গা বড় পর্দায় দেখা আছে। বলতে বাধা নেই, যারা চিনে পাড়া বা বন্দর চত্বরে গিয়ে অভ্যস্ত, তাঁরা ‘লালবাজার’-এর ক্যামেরাকে অনেক বেশি নম্বর দেবেন বলেই আশা। ‘লালবাজার’ রক্ত দেখিয়েছে, চোরাকারবারি দেখিয়েছে, কিন্তু জনসাধারণকেও দেখিয়েছে। যা এর আগের বেশির ভাগ গল্পে যথেষ্ট পাওয়া যায়নি। সাদা আর কালোর মাঝে যে একটা স্তর আছে, যাকে ধূসর বলা যায়, তা দেখানোর মতো সূক্ষ্ম চোখ বেশি মেলে না। টিম ‘লালবাজার’ তা করে দেখিয়েছে। লেখক রঙ্গন চক্রবর্তীর চোখ এবং কস্টিউম ডিজাইনার সন্দীপ জয়সওয়ালের দক্ষতায়, এই সিরিজে প্রতিটি মূল চরিত্র ফুটে উঠেছে নিপুণ ভাবে। এত পুলিশকর্মীর মধ্যেও যে প্রতিটি পদ এবং মানুষ আলাদা, তা দেখানো হয়েছে খুব যত্নের সঙ্গে। সবটা যদিও ছাড়তে পারেনি। যৌনপল্লির মেয়েদের সাজ, বন্দরের মাফিয়ার পোশাকে আরও একটু নজর দেওয়া যেত বোধহয়। স্টিরিওটাইপ ভাঙতে গিয়েও এ ভাবেই মার খেল স্টাইলিংয়ে। তবে এগুলো বাংলার সঙ্গে বাংলার তুলনা। কিন্তু একটা কাজ হিন্দিতে ডাব করে যখন সর্বভারতীয় দর্শকের উদ্দেশে ছেড়ে দেওয়া হয়, তখন তো তুলনায় স্পেকট্রামটা বড্ড বড়। সেখানে যে এমন অনেক ভাল কাজ হয়ে গিয়েছে। সেখানে আলাদা জায়গাটা করতে পারবে কি ‘লালবাজার’?
টালিগঞ্জের নিরিখে অবশ্যই একটা বিশাল বড় পদক্ষেপ এই ওয়েব সিরিজ। অনলাইন প্ল্যাটফর্মের হাত ধরে আগামী দিনে যদি এ ভাবে টলিগঞ্জ এগিয়ে আসে বিশ্বের দরবারে, রকমারি দর্শক খুঁজতে, তবে ‘লালবাজার’ পথনির্দেশকের ফলক পাবে। কলকাতার মানুষের গর্ব হওয়ার কথা যে এত যত্ন নিয়ে ফ্রেমের পর ফ্রেমে তুলে ধরা হচ্ছে তাঁদের শহর। তবে হিন্দিতে যখন ডাবিং হলই, তখন আর একটু পেশাদার হল না কেন? হতেই পারে, তা ইচ্ছে করে করা হয়নি। কলকাতাকে ধরে রাখতে ব্যবহার করা হয়েছে হিন্দিতে বাঙালি টান। তবে গোটা দশটা এপিসোড সে ভাবে ধরে রাখা একটু কঠিন হয়। এ ক্ষেত্রে তা স্পষ্ট ধরা পড়ছে। নেহাত কৌশিক সেন, সব্যসাচী চক্রবর্তীর মতো পর্দা আলো করে রাখা বলিষ্ঠ অভিনেতারা ছিলেন, তাই এ যাত্রায় পার পেয়ে গেল পার্শ্বচরিত্রে থাকা বহু অভিনেতার হিন্দি উচ্চারণে বাঙালি টান। সে সব ছাপিয়েও অভিনয় দেখার মতো অনেকেরই। হৃষিতা ভট্টের সঙ্গে কৌশিকবাবুর রসায়নটা জমজমাট না বলা গেলেও, চোখে পড়ছে বটে। গৌরব চক্রবর্তীও নিজ গুণে জায়গা করে নিয়েছেন। আলিনগড়ের গোলকধাঁধার পরে আবারও পরিচালক হিসেবে সায়ন্তন ঘোষালের কাছ থেকে আশা বাড়ল দর্শকের। আগামীতে আরও পরিণত হোক টালিগঞ্জের এমন উদ্যোগ। তবে তাতে ভাল-মন্দ যাহাই আসুক, হাতে রইলেন রঞ্জিনী চক্রবর্তী। অবশ্যই বার বার দেখতে ইচ্ছে করবে ‘লালবাজার’-এর এই ফরজানাকে। দাপুটে অভিনেতাদের মাঝেও এই নবাগতা চোখ টেনে নিতে পারেন তাঁর দিকে।
শেষের আগে লেখক রঙ্গনবাবুর সাংবাদিক সত্ত্বা নিশ্চয়ই আলাদা গুরুত্ব পাবে যে কোনও দর্শকের কাছেই। নিয়মিত খবর খেয়াল করলে এই সিরিজে দেখানো সব ক’টি অপরাধ কলকাতার দর্শকের চিনতে পারার কথা। কলকাতায় এমন ধরনের খুন প্রায়ই ঘটেছে গত দশ-বারো বছরে। তবে এত একসঙ্গে দেখতে গিয়ে মূল গল্পের থেকে একটু বেশি জায়গা নিয়ে নিয়েছিল কি সাবপ্লট? সাধারণ দর্শক, বিশেষ করে কলকাতার বাইরের মানুষ, লালবাজারের গুরুত্ব না-ও জেনে থাকতে পারেন। তা আর একটু যত্ন নিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া যেত বোধহয়। তাতে খানিকটা হলেও প্রাসঙ্গিক লাগতে পারত মূল গল্পের খুন ছাড়া অন্য সব অপরাধের প্রসঙ্গও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy