“তারিণীখুড়ো দুধ চিনি ছাড়া চায়ে একটা সশব্দ চুমুক দিয়ে তাঁর গল্প আরম্ভ করলেন।”
উপরের এই বাক্যটির সঙ্গে সত্যজিৎ-ভক্তদের নতুন করে পরিচয় করানোর দরকার পড়ে না। প্রয়োজন পড়ে না যে, এর পর তারিণীখুড়োর মুখ থেকে যে গল্পটি শোনা যাবে, তার চরিত্র কী কিসিমের। ফেলুদা, শঙ্কুর পরে এই একটি চরিত্রকে নিয়েই সত্যজিৎ রায় সিরিজ় লিখেছিলেন। তারিণীখুড়োর গল্প মানেই রোমহর্ষক ব্যাপার। তাতে ভূত, পিশাচ, বেতাল অথবা নিছক রোমাঞ্চ কাহিনির এমন সব মিশেল থাকবেই যে, একটি থেকে অন্য গল্পে লাফ দিতে বাধ্য হবেন পাঠক। কিন্তু এ হেন তারিণীখুড়ো সিরিজ়েই সত্যজিৎ এমন একটি গল্প লিখেছিলেন, যাতে উপরোক্ত রোমাঞ্চের ছিটেফোঁটাও ছিল না। ‘গল্পবলিয়ে তারিণীখুড়ো’ কার্যত সত্যজিতের শেষ দিকের রচনা। ১৯৮৮ সালে এ গল্প লেখা হয়। প্রকাশিত হয় ১৪০১ বঙ্গাব্দের ‘আনন্দমেলা’ পূজাবার্ষিকীতে। এ গল্প লেখার চার বছর পরেই সত্যজিৎ প্রয়াত হন। উল্লেখ্য, তারিণীখুড়োর অনুরাগীদের কাছে অবশ্যই গল্পটি কোনও ‘প্রিয়’ সংযোজন নয়। এ গল্পকে সত্যজিতের ‘মাইনর ওয়ার্ক’ বলেই চালিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু সমস্যা হল এই যে, এই আপাত নিরীহ, রোমাঞ্চবিহীন কাহিনিটিকেই অনন্ত নারায়ণ মহাদেবন চলচ্চিত্রের রূপ দিলেন। তারিণীখুড়োর তথাকথিত রোমাঞ্চ কাহিনিগুলিকে বাদ দিয়ে কেন সিনেমার জন্য বাছলেন এই গল্পকে, প্রথমেই সেই প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাবে।
অনন্তের ছবিতে তারিণীখুড়ো এক অবসরপ্রাপ্ত মধ্যবিত্ত বিপত্নীক, যাঁর ছেলে আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিত। গল্পবলিয়ে বাবাকে বার বার বলেও সে কলকাতা থেকে বিদেশে নিয়ে যেতে পারে না। কারণ হিসাবে তারিণীর এক উত্তর— ক্যাপিট্যালিস্ট দেশে সে থাকতে পারবে না। ছবির নামলিপি প্রদর্শনের সময়েই তরুণ তারিণী শুরু করেছিল এক বালকের গল্প। সে স্কুলে মার্কস ভাল পেত না। কিন্তু কলেজে তার সঙ্গে পরিচিতি ঘটে আর এক মার্কসের। কার্ল মার্ক্স। আর তবে থেকেই যে পুঁজিবাদের প্রতি তার এক অনীহা। তরুণ তারিণীকে তার স্ত্রী এবং বন্ধুরা গল্প লেখার অনুরোধ করে বার বার। কিন্তু তারিণী শতং বদ, মা লিখ-তে বিশ্বাসী। তার মনের ভিতরে এমন এক ভাবনা ঘুরপাক খেতে থাকে যে, লিখে ফেললেই গল্প ক্যাপিট্যালিজ়মের যন্ত্রাংশে পরিণতি পাবে। বরং তারিণীর কাছে যেন প্রাক্-পুঁজিবাদের যুগের কাহিনি কথনই শ্রেয়। একদিন অবসরপ্রাপ্ত তারিণীর নজরে পড়ে সংবাদপত্রের এক বিজ্ঞাপন, যেখানে গারোড়িয়া নামে এক গুজরাতি ভদ্রলোক ‘স্টোরিটেলার’ চেয়েছেন। তারিণী তার বন্ধুদের অনুরোধ, কলকাতার অমোঘ টান ছেড়ে পাড়ি জমায় অহমদাবাদের উদ্দেশে।

গারোড়িয়ার জীবনের অপ্রাপ্তি আর ধূর্ততার মিশেলকে একত্র করেছেন আদিল হুসেন। ছবি: সংগৃহীত।
গারোড়িয়া বিপুল ধনী, কাপড়ের ব্যবসায়ী। সে তারিণীকে জানায়, তার নিদ্রাহীনতার অসুখ রয়েছে। সে এমন এক গল্পকথককে খুঁজছে, যে তাকে ঘুম পাড়াতে পারবে বা বলা ভাল, যার গল্প তাকে ঘুমের দেশে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে। তবে শর্ত এই যে, সেই গল্প হতে হবে একান্ত মৌলিক। কোনও বইতে পড়া গল্প তাকে শোনানো চলবে না। তারিণীর শর্ত পছন্দ হয়। শুরু হয় তারিণীর অহমদাবাদ বাস এবং প্রতি রাতে গারোড়িয়াকে গল্প শোনানোর কাজ। গারোড়িয়া অবিবাহিত প্রৌঢ়। তারিণীর সঙ্গে তার এক রকম সখ্যই তৈরি হয়ে যায়। গারোড়িয়া এক সময় তারিণীকে জানায়, সে কেন বিয়ে করেনি। তার যৌবনের কাঙ্ক্ষিতা নারী সরস্বতী অন্য এক পুরুষকে বিয়ে করে। গারোড়িয়াকে সে বাতিল করে এই কারণেই যে, গারোড়িয়া শিক্ষিত ও পরিশীলিত নয়। গারোড়িয়া ব্যবসায় সাফল্য পায়। ও দিকে সেই মহিলার স্বামী তত দিনে প্রয়াত। গারোড়িয়া তার সামনে নিজেকে শিক্ষিত ও পরিশীলিত বলে প্রমাণ করতে চায়। তারিণীকে ডেকে এনে তার কাছে অনিদ্রার অছিলায় গল্প শোনার উদ্দেশ্য, তার বলে যাওয়া কাহিনিগুলিকে আত্মসাৎ করা এবং ছদ্মনামে (অথচ নিজের ছবি সহ) গুজরাতি সাহিত্য পত্রিকায় সেগুলি প্রকাশ করা।
গারোড়িয়ার এই কীর্তি খুব বেশি দিন চলল না। স্থানীয় এক গ্রন্থাগারে তারিণী যেতে শুরু করেছিল। সেখানেই এক গুজরাতি পত্রিকায় ‘গোর্কি’ ছদ্মনামে লিখিত একটি গল্প নজরে আসে তারিণীর, সঙ্গে লেখক হিসাবে যার ছবি, সে গারোড়িয়া। গ্রন্থাগারিকের কাছে গল্পটির বিষয়বস্তু জানতে চায় সে। গ্রন্থাগারিক যা তাকে জানায়, সেটি তারই বলা গল্প। তারিণী আরও জানতে পারে, গারোড়িয়া ‘গোর্কি’ নামে বেশ বিখ্যাত। খেলা বুঝতে দেরি হয় না তারিণীর। নিজেকে সংস্কৃতিবান প্রমাণ করে সে তার দয়িতাকে মুগ্ধ করতে চায়। এই তঞ্চকতার প্রতিশোধ নিতে চায় তারিণী।
দুর্গাপুজোর সময় সে কলকাতায় ফেরে। বন্ধুদের জানায় গারোড়িয়ার কীর্তি। বন্ধুরাও তাতে উষ্মা প্রকাশ করে। তারিণী ফিরে যায় অহমদাবাদে। এ বার সে গারোড়িয়াকে যে গল্প শোনায়, তা আসলে রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রাঙ্গদা’। যথাসময়ে গারোড়িয়া সেই কাহিনি নিজের রচিত বলে প্রকাশ করে। এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তাকে ধরে ফেলে এবং কুম্ভীলকবৃত্তির কারণে কপিরাইট সংক্রান্ত মামলা রুজু করে মোটা টাকা জরিমানা দাবি করে। গারোড়িয়া সঙ্কটে পড়ে। কিন্তু তত ক্ষণে তারিণী অহমদাবাদ ছেড়ে কলকাতায় ফিরে এসেছে, সঙ্গে নিয়ে এসেছে গারোড়িয়ার বাড়ির এক মার্জার। এ বার সে পাড়ি দেবে আমেরিকা, ছেলের কাছে। ক্যাপিট্যালিজ়মের পয়সায় নয়, গারোড়িয়ার কাছ থেকে পাওয়া গল্পবলিয়ের পারিশ্রমিক হিসাবে সে যে টাকা পেয়েছিল, তা দিয়েই সে আমেরিকা যাবে।

গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
সত্যজিতের কাহিনিটি ছিল তারিণীখুড়োর বুদ্ধিবৃত্তির চমৎকারিত্বের বিষয়ে। কিন্তু অনন্ত মহাদেবনের এই ছবি কি সেখানেই শেষ? না কি এই ছবি পোস্ট-ক্যাপিট্যালিজ়মের প্রেক্ষিতে রচিত এক এলিজি? এলিজি এ কারণেই যে, এখানে প্রয়াণ ঘটেছে স্বপ্নের, প্রয়াণ ঘটেছে কথন বা কহনের মতো এক লুপ্তপ্রায় শিল্পমাধ্যমের। যে কহন সামূহিক রসভুক্তির হাতিয়ার ছিল, তাকে গুটেনবার্গ প্রজন্মে এসে পুঁজিবাদের দাসত্ব করতে হয়েছে। পুঁজির দ্বারা নির্ধারিত রুচি এসে বলে গিয়েছে— “এই ভাবে লেখো। ঠিক এই ভাবে।” আর সেই ‘ভাব’কে অনুসরণ করতে গিয়ে কখন যেন রুদ্ধ হয়ে গিয়েছে ফেরার পথটি। কিন্তু এটাও ভেবে দেখার বিষয় যে, তারিণীর নিজস্ব পুঁজি তার গল্প সৃজনের ক্ষমতা। তা অবশ্য ‘প্রাগাধুনিক’ পুঁজি। আর তাকেই কব্জা করছে ‘আধুনিক’ পুঁজি, বণিকের রৌপ্যমুদ্রা। তারিণীর ঘুরে দাঁড়ানোর কাহিনি, তার প্রতিশোধ নেওয়ার গল্প কি তবে আধুনিক পুঁজির বিপর্যয়ের আখ্যান? ক্যাপিট্যালিজ়ম যেখানে মার্কস-বর্ণিত যাবতীয় সীমাকে অতিক্রম করে আজ প্রায় অদৃশ্য এক সত্তা, যাকে ছাড়া এক মুহূর্তও সভ্যতার চলবে না, সে কি এ ভাবে দুমড়ে পড়তে পারে? এই জাতীয় অসংখ্য প্রশ্নকে পরিচালক ছুড়ে দিয়েছেন দর্শকের দিকে।
তারিণী নিজেও স্মৃতিতাড়িত। বিপত্নীক তারিণী প্রয়াত স্ত্রীর ছবি নিয়ে ঘোরে। উল্টো দিকে গারোড়িয়া মাথায় নিয়ে ফেরে তার অসম্পূর্ণ প্রেমের স্মৃতিকে। দু’জনেই নিঃসঙ্গ। তারিণীর সামনে ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই আর গারোড়িয়া ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়েই বেঁচে আছে। ছবি দেখতে বসে মনে হতেই পারে, তারিণী কি মুহূর্তজীবী? খানিক পরেই মোহভঙ্গ হয় গারোড়িয়ার বাড়ির বিড়ালটির সঙ্গে তার সখ্য স্থাপন দেখে। তারিণীর মৎস্যবিলাস এ ছবির আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তা বাঙালি জীবনের অভিজ্ঞানমাত্র নয়। নিরামিশাষী গারোড়িয়ার গড়ে সে মাছ নিয়ে এসে তারই পাচককে দিয়ে রান্না করিয়ে জানিয়ে দিতে চায়, সে পেশাগত ক্ষেত্রে নমনীয় হতে পারে, কিন্তু তার যাপনকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা কারওর নেই। এখানেই আসে অভিনয়ের প্রসঙ্গ। তারিণীর ভূমিকায় পরেশ রাওয়াল যে জাদু দেখিয়েছেন, তা আগে দৃষ্ট হয়নি। সত্তর ছুঁই ছুঁই বয়সেও তিনি যে নিজেকে এমন ভাবে ভাঙতে পারেন, তা এ ছবি না দেখলে বিশ্বাস হত না। সঙ্গে আদিল হুসেনের কথাও বলা একান্ত প্রয়োজন। গারোড়িয়ার জীবনের অপ্রাপ্তি আর ধূর্ততার মিশেলকে তিনি একত্র করেছেন দক্ষতার সঙ্গে। সব মিলিয়ে এ ছবি বহুস্তরীয়। একমাত্রিক বিন্যাসে একে দেখা সম্ভব নয়।
তবে এ ছবির সব থেকে বড় সমস্যা এর গতি। অতিমন্থরতাকে যদি কেউ দোষ হিসাবে দেখেন, তা আসলে এ ছবির অন্যতম সম্পদ। এই মন্থরতা এক এক সময় দর্শকের মাথায় চাপ ফেলতেই পারে। সেটি পরিচালকের ইচ্ছাকৃত। আরও একটি বিষয়, বার বার তারিণীকে বাঙালি প্রমাণ করার জন্য তাকে দিয়ে বাংলা সংলাপ বলানো হয়েছে, বাংলা গান গাওয়ানো হয়েছে। পরেশের অনভ্যস্ত উচ্চারণে সেগুলি বড়ই কানে বাজে। একটি চরিত্র বাঙালি হলেই বা ছবির প্রেক্ষাপট বাংলা হলেই কেন বাংলা ভাষাকে অবতারিত হতে হবে? যদি চরিত্রাভিনেতা বাঙালি হন, তবে অন্য কথা।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত ‘দ্য স্টোরিটেলার’ কোথাও যেন দাগ রেখে যায়। আজ যখন পডকাস্ট আর অডিয়ো বুকের যুগে অক্ষরের সাহিত্য কিছুটা পিছনে হাঁটছে, তখন অক্ষরের জয় কি অতখানি অনিবার্য যে, শেষ পর্যন্ত তারিণীকে কলম তুলে নিতে হল? বড় জটিল এই সব প্রশ্ন। উত্তর এই মুহূর্তে অজানা। উত্তর-পুঁজিবাদের এই মুহূর্তে শ্রাব্য আর পাঠ্যের দ্বন্দ্বও মোটেই রৈখিক সরলতায় হাঁটে না। এর মীমাংসার ভার এ ছবি এড়িয়ে যেতেই পারত। কিন্তু তা না করে অনন্ত মহাদেবন এক উজ্জ্বল সমাপনরেখার দিকেই তাকিয়েছেন। এই পরিসমাপ্তি কি পুঁজিবাদের দিকেই ঢলে পড়া? এর উত্তরও অজানা।