অভিষেক না শাশ্বত? কাকে এগিয়ে রাখলেন দর্শক?
বব বিশ্বাস এক পেশাদার খুনির নাম। ২০১২ সালে সুজয় ঘোষ পরিচালিত ছবি ‘কহানি’-র এক ছোট চরিত্র বব বিশ্বাস। যে বিমা সংস্থায় চাকরি করে আর তারই আবডালে চুক্তিবদ্ধ হন্তারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। হত্যা তার কাছে জলভাত। ঠান্ডা মাথায় একের পর এক হত্যা সে করে যেতে পারে। ‘নমস্কার। এক মিনিট’— এই কথা ক’টি বলে সে বন্দুক বার করে ও নির্বিকার চিত্তে গুলি চালায়। শ্বাশ্বত চট্টোপাধ্যায় অভিনীত সেই চরিত্রটি জনপ্রিয়তা পায় এবং অচিরেই নেটমাধ্যমে বিভিন্ন মিমে, রিল ভিডিয়োয় ছড়িয়ে পড়ে। একটি ‘ক্যামিও’ চরিত্রের এই প্রসার ভারতীয় সিনেমায় খুব বেশি দৃষ্ট নয়। সম্ভবত তাই বব বিশ্বাসকে ফিরে আসতে হল পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবিতে মুখ্য চরিত্র হয়ে।
এ বারে বব বিশ্বাস নিজেই একটি কাহিনি। পরিচালনায় সুজয় নন, তাঁর কন্যা দিয়া অন্নপূর্ণা ঘোষ। যদিও ছবির সংলাপে রয়েছেন সুজয়ই। এটি একটি স্বতন্ত্র থ্রিলার। এখানে বব বিশ্বাস তাঁর ‘সুপারি কিলার’ ভাবরূপ নিয়েই উপস্থিত, তবে অবতারে খানিক ফারাক রয়েছে।
ছবির গোড়াতেই বব আট বছরের কোমা কাটিয়ে এক হাসপাতাল থেকে যখন ছুটি পায়, তখন তার যাবতীয় স্মৃতি লুপ্ত। এমনকি, সে নিজের নামটুকুও মনে করতে পারে না। বেরিয়ে এসেই সে জানে, তার স্ত্রী এবং ছেলে রয়েছে। সে বাড়ি ফিরে দেখতে পায়, তার এক মেয়েও রয়েছে। সে অবশ্য তার নিজের মেয়ে নয়, তার স্ত্রীর আগের বিবাহের সন্তান। এর পর শুরু হয় ববের আত্মপরিচয় উদ্ধারের পর্ব। এমন সময়ে দুই রহস্যময় ব্যক্তি তাকে এক গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় এক আধা গুপচুপ জায়গায় এবং জানায়, সে একজন পেশাদার খুনি। বব জানতে পারে, সে এক বিমা সংস্থায় কাজ করত এবং বরাত মাফিক খুন করা তার আর এক পেশা ছিল। সেই রহস্যময় মানিকজোড় তাকে খুনের পেশায় ফিরতে আদেশ দেয়।
এর সমান্তরালে চলে আর এক কাহিনি। কলকাতা শহরের তরুণ সমাজে ‘ব্লু’ নামে এক মাদক ছড়িয়ে দিচ্ছে একটি চক্র। ববের সৎ মেয়েও সেই মাদকের খপ্পরে পড়ে। এই মাদকওয়ালাদের সঙ্গে ববকে সুপারি প্রদানকারীদের যোগ রয়েছে। তবে সে সব ক্রমশ প্রকাশ্য।
মাঝখানে ‘কালীদা’ নামের একটি চরিত্রের আবির্ভাব ঘটে। সে এক প্রাচীন ওষুধের দোকানের মালিক। কিন্তু হোমিওপ্যাথি ওষুধের পাশাপাশি অস্ত্র চালাচালির কারবারও সে করে থাকে। ববকে তার দোকানে পাঠায় মানিকজোড়। কালীদা ববের হাতে তুলে দেয় ‘নাক্স ভমিকা’-র একটি প্যাকেট আর সেই অবসরে শুনিয়ে রাখে গেরামভারি দার্শনিক সব তত্ত্ব। এই ‘নাক্স ভমিকা’ একটি পিস্তল ও কিছু গুলি। সেই বন্দুক হাতে পেয়ে বব তার পড়শী এক বিরক্তি উৎপাদক গায়ককে দুম করে খুন করে ফেলে। তার মৃতদেহ সরাতে যায় নিজেই, এমন সময়ে সেই সুপারিদাতা মানিকজোড় এসে তাকে উদ্ধার করে।
মৃতদেহ লোপাট হয়। ভাল-মন্দের দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকা ববের মধ্যে খুনিয়া সত্তা জেগে ওঠে। মানিকজোড়ের নির্দেশে সে শুরু করে একের পর এক খুন। এখানে খুন হতে থাকে মূলত ‘ব্লু’ নামক মাদকের সঙ্গে জড়িত থাকা লোকজন। ধড়াদ্ধড় লাশ পড়ে যায় অথচ তা নিয়ে শহরের আইন-প্রসাশন-সংবাদমাধ্যম ইত্যদির তেমন মাথাব্যথা দেখা যায় না। হঠাৎ উদিত হয় এক মহিলা পুলিশ আধিকারিক। সে কী সব যোগসূত্র জোড়াতালি লাগিয়ে বার করে ফেলে, তার ঊর্ধ্বতন আধিকারিককে খুনের বরাত পেয়েছে কেউ। প্রায় অনায়াসেই সে ববকে সন্দেহ করতে শুরু করে।
এই কাহিনির সমান্তরালে ববের স্ত্রী মেরি তার বসের কাছ থেকে কু-ইঙ্গিত পেতে থাকে। এবং এক দিন তাকে জুতোপেটা করে বাড়ি চলে আসে। ববের ছেলে স্কুলের মস্তান সহপাঠীর কাছে হেনস্থা হয়। বব গিয়ে তার পোষা খরগোশকে সংহার করে। কেন এই সব ঘটে তার থই পাওয়া মুশকিল। এরই মধ্যে তার মনে পড়ে যায় মেরির আগের স্বামীকে সে-ই হত্যা করেছিল। সুতরাং ববের মধ্যে যে হন্তারক প্রবৃত্তি তার কোমায় চলে যাওয়ার আগেও ছিল, সন্দেহ নেই। ফলে কোমা ত্থেকে উঠে আসা ববের অন্তরের কোন উপলব্ধি তাকে ভাল-মন্দের দ্বন্দ্বে ক্রমাগত ভোগাতে থাকে, তা বোঝা যায় না।
মহিলা পুলিশের সূত্র ধরে দেখা যায়, মাদকচক্রের মাথাও পুলিশের লোক। মাদকচক্রের মাথাই আবার সুপারিদাতা মানিকজোড়ের বস-ও। সুতরাং কে যে কার পক্ষে, তা তালগোল পাকাতে থাকে। ওদিকে বব জানতে পারে, তার সৎ মেয়ে ব্লু মাদকে আসক্ত। তার ভিতরে আবার ন্যায়নিষ্ঠ এক সত্তা জেগে ওঠে। ফলে মানিকজোড়ের নির্দেশ অমান্য করে বব এবং মানিকজোড় তাকে কড়কানোর জন্য গুন্ডা পাঠায়। কারণ, ঘটনার চক্করে বব হদিশ পেয়েছে তার বিগত জীবনের সুপারি সংক্রান্ত এক ডায়েরির।
দু’ঘন্টার অধিক সময় ব্যয় করে কী পাওয়া গেল ‘বব বিশ্বাস’ থেকে— এই প্রশ্ন দর্শকের চিত্তে ভনভন করতেই পারে। ‘বব বিশ্বাস’ ট্র্যাজেডি, না কমেডি বোঝা যায় না। শেষ দৃশ্যে সব কিছু চুকেবুকে যাওয়ার পরেও ববের মুঠোফোনে সুপারি আসে। সে মিচকে হাসি হেসে সেই সুপারি গ্রহণও করে। ইঙ্গিতে বোঝা যায়, এই ঘটনাক্রম সুজয় ঘোষ পরিচালিত ‘কহানি’-র আগের।
তা হলে ‘বব বিশ্বাস’ কোন বিধার ছবি। সে কি এক স্মৃতিলুপ্ত মানুষের জীবনের ট্র্যাজেডি, নাকি কলকাতা নামের এক প্রেক্ষাপটে নির্মিত কিছু এলোমেলো বাংলা সংলাপ-ঋদ্ধ এক কৌতুকী, যার শেষ ১৯৭০-’৮০-র দশকের হিন্দি মশলা ছবির আঙ্গিকে। পুলিশের তরফে ধারাবাহিক খুনি ববকে শুধুমাত্র মাদক চক্রের সন্ধান পেতে ছেড়ে দেওয়া খুব বিশ্বাসযোগ্য নয়। ববকে সুপারি দেওয়া মানিকজোড় খুন হয়ে যায় ববের হাতেই। তাদের বস-ও নিহত হয় একই পন্থায়। তা হলে শেষ দৃশ্যে ববকে সেই বিশেষ ফোনে সুপারি পাঠাল কে, যা তাকে সেই মানিকজোড় দিয়েছিল? বব ও তার সৎমেয়ের সম্পর্কের সমীকরণটিও ঘাপলাময়। কোথাকার জল যে কোথায় গিয়ে দাঁড়াল, বোঝা যায় না। এরই মধ্যে রয়েছে এক চাউমিন বিক্রেতার কাহিনি। তাকে নিয়ে আসার উদ্দেশ্য-বিধেয়ও তেমন খোলসা হল না ১৩২ মিনিটে।
এই সব বারোভেজাল পেরতে পেরতে মনে হয়, এই ছবি কেন নির্মিত হল? ‘কহানি’ তোলার সময় পরিচালক কি ঘুণাক্ষরেও ভেবেছিলেন যে, শ্বাশ্বত অভিনীত ‘ক্যামিও’ চরিত্রটি আসমুদ্রহিমাচলে আলোড়ন ফেলবে? শ্বাশ্বত নিজেও বোধ হয় ভাবেননি, তিনি ‘বব বিশ্বাস’ নামেই খ্যাত হয়ে উঠবেন।
‘বব বিশ্বাস’-এ নামভূমিকায় অভিনয় করতে এসে অভিষেক বচ্চনের উপর অবশ্যই এক গুরুদায়িত্ব ছিল। এক ঘটে যাওয়া অঘটনকে প্রলম্বিত করা। তিনি সেই চেষ্টায় কোনও ত্রুটিই রাখেননি। কিন্তু অতি দুর্বল চিত্রনাট্য বাদ সেধেছে। একদা ‘রাবণ’-এর ভূমিকায় অভিনয় করা মানুষটি কেমন খ্যাপলা জালে পড়া শিঙিমাছ-হয়ে পড়েছেন। মেরির ভূমিকায় চিত্রাঙ্গদা সিংহের অবস্থাও তথৈবচ। কালীদার ভূমিকায় পরান বন্দ্যোপাধ্যায় বা এক অহেতুক খলনায়কের ভূমিকায় রজতাভ দত্তেরও কিছু করার ছিল না। করার কিছু ছিল না এক ছোট চরিত্রে দিতিপ্রিয়া রায়েরও।
গোদা ভাবে বলতে গেলে, গোটা ছবিতে কারওরই করার কিছু ছিল না। মাসের পর মাস প্রচারে ‘বব বিশ্বাস’ মুক্তির আগেই বিখ্যাত। তবে শ্বাশ্বতর ‘বব’ এক ক্রুর খুনি।। তাকে দেখলে হৃদপিণ্ড থেকে এক পরত রক্ত উবে যায়। আর অভিষেকের ‘বব’ এক বিভ্রান্ত, ভোম্বল-মার্কা অবতার, যে নিজেই জানে না সে কী করছে। এটাই ট্র্যাজেডি। যদি কেউ নিয়তিতাড়িত হয়ে থাকেন এই খেলায়, তিনি অভিষেক বচ্চন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy