Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪
Bhakshak Review

চেতনার উদ্রেক কি এতই সহজ?

বিহারের মুনাওয়রপুরের এক শেল্টার হোমকে ঘিরে শুরু হয় গল্প। সেখানে আশ্রিত অনাথ মেয়েরা নিয়মিত নিপীড়নের শিকার। এর বিরুদ্ধে সরব হয় পটনার এক টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক বৈশালী (ভূমি পেডনেকর)।

Bhakshak Review

‘ভক্ষক’ ছবির একটি দৃশ্যে ভূমি পেডনেকর এবং সঞ্জয় মিশ্র। ছবি: সংগৃহীত।

সায়নী ঘটক
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৮:২৫
Share: Save:

সুকুমার রায় বহু দিন আগে লিখেছিলেন— ‘আজকে তোকে সেই কথাটা বোঝাবই বোঝাব/না বুঝবি তো মগজে তোর গজাল মেরে গোঁজাব’। বুঝিয়ে বললেই যদি সকলে সব বুঝে যেতেন, আর সেই মতো কাজ করতেন, তা হলে হয়তো দুনিয়ায় অন্যায় বলে কিছু থাকত না। আর সে রকমটা প্রায় অবাস্তব বলেই সিনেমার পর্দায় মাঝে মাঝে ‘বুঝিয়ে বলা’র প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ‘ভক্ষক’ ঠিক তেমনই একটা ছবি, যেখানে সকলের চোখের সামনেই থাকা সত্যিটা আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হয়েছে। ‘নিদ্রিত জনতা’র ঘুম ভাঙানোর, তাঁদের ধরে ঝাঁকুনি দেওয়ার আরও একটা চেষ্টা করা হয়েছে। আর এই চেষ্টার নেপথ্যে পরিচালক পুলকিত ও তাঁর স্ত্রী জ্যোৎস্নার দীর্ঘ পরিশ্রম, পড়াশোনা, গবেষণা রয়েছে। ক্যানসারের মতো মারণরোগের সঙ্গে লড়াই করতে করতে এই কাহিনির জন্য কলম ধরেছিলেন পরিচালক পুলকিত। যে তাড়না থেকে ছবিটা তৈরি করেছেন তিনি, তা যদি কিছু সংখ্যক দর্শককেও নাড়া দেয়, তাঁর পরিশ্রম সার্থক। কিন্তু নির্মাণের কিছু দুর্বলতায় যথেষ্ট মনোগ্রাহী হয়ে উঠতে পারেনি এ ছবি। মনে দাগ কাটলেও দীর্ঘকালীন রেশ রেখে যাবে, তেমন কনটেন্ট নয় নেটফ্লিক্সের এই ছবিটির।

বিহারের মুনাওয়রপুরের এক শেল্টার হোমকে ঘিরে শুরু হয় গল্প। সেখানে আশ্রিত অনাথ মেয়েরা নিয়মিত নিপীড়নের শিকার। এর বিরুদ্ধে সরব হয় পটনার এক টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক বৈশালী (ভূমি পেডনেকর)। ক্যামেরায় তার সঙ্গী ভাস্কর (সঞ্জয় মিশ্র)। শেল্টার হোমের মালিক বংশী সাহুর (আদিত্য শ্রীবাস্তব) উপরমহল পর্যন্ত যোগাযোগ থাকায় সরকার সব জেনেও চোখে ঠুলি পরে থাকে, কোনও ব্যবস্থা নেয় না। পুলিশ লেখে না এফআইআর। তদন্তে নেমে প্রতি পদে হেনস্থা, অপমান আর অসহযোগিতার মুখোমুখি হয় বৈশালী। কী করে সে শেল্টার হোমের মেয়েদের সুবিচার দেওয়ানোর পথে এগোয়, তা নিয়ে ছবিটি।

বিহার ও তার বাইরেও একাধিক শেল্টার হোমে খোঁজখবর নিয়ে, আইনজীবী, পুলিশ, চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে এ ছবির প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। সত্যি ঘটনা অবলম্বনে তৈরি ছবিটিতে যা যা ঘটে, প্রায় পুরোটাই প্রত্যাশিত। এমনকি, শেষটাও। তাই ছবিতে এমন কিছু উপাদান থাকা দরকার ছিল অনুচ্চারিত ভাবে, যা দর্শকের কাছে অপ্রত্যাশিত, নাড়া দেওয়ার মতো। সংলাপের পুনরাবৃত্তি, শ্লথ গতির চিত্রনাট্য, সর্বোপরি নারীদের বাঁচাতে নারীদের এগিয়ে আসার চিরাচরিত ফর্মুলা না থাকলে হয়তো আরও জোরালো হতে পারত ‘ভক্ষক’। বৈশালীকে যে ভাবে পরিবারের ভিতরে ও বাইরে লড়তে হয়, তার চিত্রায়ণও বেশ একপেশে। এক কামরার ঘরে শুধু একটা ক্যামেরা লাগিয়ে যে ভাবে চ্যানেল চালায় বৈশালী, তাতে তার ‘খবরি’কে হাজার হাজার টাকা দেওয়ার ক্ষমতা আসে কী ভাবে, আশ্চর্যের! সাপের লেজে পা দেওয়ায় বৈশালীর সঙ্গে যা যা হতে পারত, তার সিকিভাগও ঘটে না, শুধু শেষে তার জিত নিশ্চিত করার জন্যই বোধহয়। আর ঠিক সেই কারণেই হয়তো পুলিশ আসছে জেনেও অপরাধীরা গ্যাঁট হয়ে সোফায় বসে থাকে, হাতকড়া পরার অপেক্ষায়!

ছবির অধিকাংশ নীতিবাক্য, জ্ঞানগর্ভ সংলাপই বৈশালী ওরফে ভূমি পেডনেকরকে দিয়ে বলানো হয়েছে। নিজের চরিত্রে তিনি অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য। সঞ্জয় মিশ্রও তাঁর চরিত্রটি যথার্থ তুলে ধরেছেন। দুই সহকর্মীর মধ্যকার সম্পর্কটিও খুব সুন্দর ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ছবিতে মন্দ লোক অনেক, যাঁদের মধ্যে আদিত্য শ্রীবাস্তব, সত্যকাম আনন্দের মতো অভিনেতারা নজর কেড়ে নেন। বৈশালীকে খবর সরবরাহকারী গুপ্তাজির ভূমিকায় দুর্গেশ কুমার ছোট্ট পরিসরে মাত করেছেন। এসএসপি জসমিত গওরের চরিত্রে ছবির শেষের দিকে এসেছেন সাই তমহনকরের মতো শিল্পী, তবে তাঁর বিশেষ কিছু করণীয় ছিল না। ‘গঙ্গা’ বা ‘শামিল হ্যায়’-এর মতো গান ছবির মেজাজের সঙ্গে মানানসই। ক্যামেরার কাজও ছবিটিকে একটা উচ্চতায় পৌঁছে দিতে সাহায্য করে।

নাবালিকাদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত ঘটে চলা অপরাধের পরিসংখ্যান একটু খোঁজ নিলেই জানা যায়। পরিসংখ্যান না জানলেও অন্যায় যে ঘটে, তা প্রায় সকলের জানা। তা নিয়ে অধিকাংশের সচেতনতা বা বিবেকবোধ জাগ্রত হওয়ার মেয়াদ খবরের কাগজ পড়া কিংবা টিভি চ্যানেল দেখার সময়টুকু পর্যন্তই বরাদ্দ। তার বাইরে গিয়েও ভাবুন, অন্যের জন্য— এ কথাই বার বার করে বলে এ ছবি। এই চেষ্টাকে কুর্নিশ করতেই হয়।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE