‘তাজমহল ১৯৮৯’
১৯৮৯। নয়া উদারনীতির আগমনে নয়ের দশক আর কিছু দিনের মধ্যেই পাল্টে দেবে ভারতের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং অবশ্যই তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চিত্রও। খোলা বাজার ও বিশ্বায়নের হাওয়ায় আকস্মিক ভাবে ভারতীয় জনজীবন হাই রাইজ, শপিং মল ও ইন্টারনেটের অসম্ভব এক দ্রুতগামীতায় প্রবেশ করার আগের দশক ১৯৮০। সেই দশকের একদম অন্তিম প্রান্তের লখনউ শহরকে প্রেক্ষাপট হিসেবে বেছে নিয়েছেন পরিচালক পুষ্পেন্দ্রনাথ মিশ্র, নেটফ্লিক্স সিরিজ ‘তাজমহল ১৯৮৯’-এর জন্য।
লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বিভিন্ন ভাবে যুক্ত একাধিক চরিত্র নিয়ে এই সিরিজ। ভিন্ন ভিন্ন বয়স, শ্রেণি, লিঙ্গ ও সামাজিক অবস্থানের এই চরিত্রদের মধ্যে যোগসূত্র হল- প্রেম। এরা সকলেই নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রেমের ব্যাপারে ধারণা তৈরি করেছেন, কখনও পূর্বনির্ধারিত সামাজিক ধারণা ভেঙেছেন। যেমন লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যায় স্থাতকস্তরের ছাত্রী রশ্মি মালিক মনে করেন মেয়েরা সম্পর্কে চায় প্রেম এবং ছেলেরা সেক্স— এই ধারণাটি আদ্যন্ত ভুল, বরং মেয়েরাও পুরুষের মধ্যে খোঁজে শারীরিক সৌন্দর্য। দর্শনের অধ্যাপক আখতার বেগ আবার দীর্ঘ সময় ধরে চেষ্টা করেও প্রেম বুঝতে পারেননি, যদিও তিনি মনে করেন ‘‘লাভ ইজ আ মিউটেটিং ভাইরাস।’’
তবে এঁদের প্রত্যেকের অভিজ্ঞতা পৃথক, এবং এই পৃথক অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সমগ্র সিরিজ জুড়ে প্রত্যেকের মধ্যে এক রূপান্তর ঘটে। বি কমের ছাত্র ধরমের সঙ্গে রশ্মির সম্পর্কে চিড় ধরে যখন ক্ষমতার লোভে সে বাব্বু ভাইয়ার দলের হয়ে ছাত্র নির্বাচনে দাঁড়ায় এবং কার্যত গুন্ডা-মস্তানদের সঙ্গে ওঠা বসা শুরু করে। আখতর বেগের সাথে সরিতার সম্পর্ক ২২ বছরের, নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন থেকে। এখন তারা দু’জনেই সেখানকার অধ্যাপক, অথচ এই দীর্ঘদিন অতিক্রান্ত হওয়ার পর এক অদ্ভুত দূরত্ব সরিতাকে বিবাহবিচ্ছেদের কথা ভাবাতে বাধ্য করে। এই প্রেমের সম্পর্কগুলির পাশাপাশি আছে চিরন্তন বন্ধুত্বের গল্পও। বহু বছর পর এক কবিতার জলসায় আখতারের দেখা হয়ে যায় তার কলেজ জীবনের প্রিয় বন্ধু সুধাকরের সঙ্গে—ঝুলিতে স্বর্ণপদক থাকা সত্ত্বেও যিনি বাবার মতো দর্জির পেশাই বেছে নিয়েছেন। তেমনই, রশ্মির সঙ্গে অঙ্গদের বন্ধুত্ব, বা সরিতার সঙ্গে তাঁর সহকর্মী স্টিভের বন্ধুত্ব অন্য মাত্রা যোগ করে।
বিভিন্ন বৈশিষ্ট ‘তাজমহল ১৯৮৯’-কে অন্যান্য গতানুগতিক গড়পড়তা ওয়েবসিরিজের থেকে খানিক উচ্চতাতেই তুলে দেয়। যেমন, বারবার এই সিরিজে ‘ফোর্থ ওয়াল’ ভাঙা হয়েছে দারুণ দক্ষতায়। প্রথম পর্বের দ্বিতীয় দৃশ্যে যখন অনশুল চৌহ্বান সরাসরি ক্যামেরায় তাকিয়ে নিজেকে পরিচয় দেন রশ্মি মালিক হিসেবে—হঠাৎ একটা ধাক্কা লাগে। এ ভাবেই বিভিন্ন চরিত্র কখনও নিজেরাই নিজেদের, কখনও অন্যদের পরিচয় দিয়ে ভেঙেছেন ‘ফোর্থ ওয়াল’। কেবল পরিচয়ের জন্য নয়, চরিত্রদের মতামত প্রকাশের জন্যও ‘ফোর্থ ওয়াল’ ভাঙা হয়েছে।
অসম্ভব দক্ষ ও বলিষ্ঠ অভিনয় এই সিরিজের এক প্রাপ্তি। বিবাহিত জীবনে বীতশ্রদ্ধ মধ্যবয়স্ক পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক সরিতার ভূমিকায় গীতাঞ্জলি কুলকর্নি অনবদ্য— চোখে পড়ার মতো তাঁর ‘কমিক টাইমিং’। একই সঙ্গে তাঁর স্বামী আখতার বেগের ভূমিকায় নীরজ কবিরের ‘কমিক টাইমিং’ও প্রশংসার দাবি রাখে। ‘পাতাললোক’-এ সাংবাদিক সঞ্জীব মেহরা এবং ‘শিপ অব থিসিউস’-এর মতো সিরিয়াস ছবিতে মৈত্রেয়র ভূমিকায় নজরকাড়া অভিনয়ের পাশাপাশি এই সিরিজে একজন পণ্ডিত অথচ গোবেচারা অধ্যাপকের চরিত্রে নীরজ কবির সমানভাবে সাবলীল। এই চরিত্র তাঁর অভিনয় ক্ষমতার আশ্চর্য ব্যাপ্তিকেই আবার প্রমাণিত করে। রশ্মির চরিত্রে অনশুল চৌহ্বান, ধরমের চরিত্রে পরশ প্রিয়দর্শনকে ভাল লাগে। তবে আলাদা করে উল্লেখ করতে হয় দু’জনের কথা— শীবা চাড্ডা ও অনুদ সিং ঢাকা। শীবা অভিনয় করেছেন সুধাকরের সঙ্গিনী মুমতাজের চরিত্রে— দেহব্যবসায়ী হিসেবে কর্মজীবনের অতীতকে ফেলে যিনি নতুন করে জীবনকে ছুঁতে চান সুধাকরের সঙ্গে। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে জাত রুক্ষতা ও অন্তরের এক অদ্ভুত সারল্যের সহাবস্থানকে শীবা ফুটিয়ে তুলেছেন দক্ষতার সঙ্গে। আর চনমনে ও হাসিখুশি অঙ্গদের ভূমিকায় অনুদের অভিনয় একরাশ তাজা হাওয়ার মতো।
আটের দশকে যাঁরা বড় হয়েছেন, বা জীবনের এক তাৎপর্যপূর্ণ সময় কাটিয়েছেন, তাঁদের কাছে এই সিরিজ আবেগে নাড়া দিয়ে যাবে। বিভিন্ন সময়ে টুকরো টুকরো করে উঠে আসা বক্স টেলিভিশনের সিরিয়াল, আকাশবাণীর সুর, ডায়াল টেলিফোন, রাসনার বিজ্ঞাপণ বা ওয়াকম্যান রেকর্ডার দর্শককে স্মৃতিমেদুর করে তুলতে বাধ্য। তবে লখনউ শহর প্রেক্ষাপট হিসেবে আরও একটু বেশি উঠে এলে ভাল লাগত। ক্লাইম্যাক্সে তাজমহলের অনুষঙ্গ ছাড়া তাজমহলের বিশেষ প্রাসঙ্গিকতাও খুঁজে পাওয়া যায় না। অন্যান্য পর্ব যতটা উপভোগ্য, তার তুলনায় শেষ পর্বের ক্লাইম্যাক্সও কিঞ্চিত দুর্বল মনে হয়।
তবু পরিচালককে কুর্নিশ বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রেক্ষিত করে কেবল রাজনীতি-প্রেমের চিরাচরিত ছকে সীমাবদ্ধ না থেকে অনেক ছোট ছোট দিকে দৃকপাত করার জন্য। যেমন, রশ্মির ওপর ধরমের এক অস্বাস্থ্যকর অধিকারবোধের পাশাপাশি ডিভোর্সের দোরগোড়ায় আইনজীবীর সামনে আখতারের কান্নায় ভেঙে পড়ার দৃশ্য অন্যভাবে পুরুষত্বের সংজ্ঞা নির্মাণ করে। সিনেমাহলে অধ্যাপক স্টিভের সঙ্গে জীবিকায় দর্জি সুধাকরের সহাবস্থানে স্টিভের অস্বস্তি সূক্ষ্ম অথচ দৃঢ় ভাবে তুলে ধরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে সুপ্ত শ্রেণিবৈষম্যের বীজ। আবার ১৭ বছর বয়সে এক হাজার টাকার বিনিময়ে নিষিদ্ধ পল্লীতে বিক্রি হয়ে যাওয়া মুমতাজ যখন গার্হস্থ্য হিংসার শিকার বিনিতাকে বলে— ‘‘যে মারে, সে পুরুষ নয়’’, সেই দৃশ্য পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক জোরালো আঘাতের প্রতীকী হয়ে ওঠে। এত কিছু সত্ত্বেও পুষ্পেন্দ্রনাথ মিশ্র একবারের জন্যেও সিরিজটির হালকা মেজাজ ও হাস্যরস ক্ষুণ্ণ হতে দেননি। বরং বলা যেতে পারে, সমান্তরালে চলা বেশ কিছু মানুষের প্রেমকে বুঝতে পারা বা সংজ্ঞায়িত করার প্রয়াস, যা কোনও কোনও বিন্দুতে এসে আবার মিলেও যায়— তারই এক অন্যরকম কোলাজ ‘তাজমহল ১৯৮৯।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy