সলমন খান। ছবি: সংগৃহীত।
এক জন বসে বসে আয়েস করে মোবাইলে কিছু একটা দেখছিল। সমলন তাকে রীতিমতো মেরে-ধমকে শেখালেন ছোট পর্দা ছে়ড়়ে বেরোতে। কারণ, তিনি বড় পর্দায় লাইভ অ্যাকশন দেখাবেন! বোঝাই যাচ্ছে, ওটিটি-র –আমলে দর্শককে হলে আনতে কালঘাম ছুটে যাচ্ছে বলিউডের। ভেলকিবাজি দেখানো, কাকুতি-মিনতি, হাতজোড় করে অনুরোধ— সবই হয়ে গিয়েছে। এ বার বোধ হয় দর্শককে হুমকি দেওয়াই বাকি ছিল। জোর করে হলে টেনে নিয়ে যাবেন সুপারস্টারেরা? কোনও অসুবিধা নেই। কিন্তু নতুন কিছু দেখাতে হবে তো! সেখানেই পিছিয়ে পড়ল টাইগার।
ছবি শুরু হয় জ়োয়ার (ক্যাটরিনা কইফ) কৈশোর থেকে। কী করে সে পাকিস্তানের আইএসআই-এ এজেন্ট হল, সেই গল্প জানা যায়। তার পর গল্প এগিয়ে যায় বেশ কিছু দশক। লন্ডন, দিল্লি, ইসলামাবাদ, ভিয়েনা, সেন্ট পিটার্সবার্গের মতো নানা শহর ঘুরে এগোতে থাকে গল্প। ঠিক যখন টাইগার আর জ়োয়ার গল্পে একটু দর্শকদের কৌতূহল তৈরি হবে, তখনই সব সাসপেন্স শেষ। এবং তার পর পুরোটাই চেনা ফর্মুলাতে ফেলা। দৃশ্যের পর দৃশ্য মারাকাটারি অ্যাকশন, ঝাঁ-চকচকে সব মারপিটের সিকোয়েন্স এবং অনেকটাই দর্শকের ‘সাসপেনশন অফ ডিজ়বিলিফ’-এর উপর জোর দিয়ে দাপিয়ে বেড়ায় টাইগার।
সুপারহিরোদের ইউনিভার্স হলিউড বহু আগেই দেখিয়ে দিয়েছে। ‘মার্ভেল’ বা ‘ডিসি’-দের দেখে বলিউডের স্পাই ইউনিভার্স বানানো শিখতে অনেকটা সময় লেগে গেল। হয়তো তাই হলিউ়ডে স্পাইদের সিনেমা বহু দূর এগিয়ে গিয়েছে। যার জন্য শুধু অ্যাকশন আর যৌনতা ছেড়ে বন্ডও প্রেমে পড়তে শিখেছে। চিত্রনাট্য নিয়েও খানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার চেষ্টা করছেন (কতটা সফল হচ্ছেন, তা অবশ্য তর্কসাপেক্ষ) নির্মাতারা। কিন্তু বলিউড এখনও মন দিয়ে শুধু অ্যাকশনটাই করা শিখছে। তাই গল্প নিয়ে কারও কোনও মাথাব্যথা নেই। সেরা অ্যাকশন দৃশ্য যাতে দেখতে পান দর্শক, তার পিছনেই সমস্ত পরিশ্রম করা হচ্ছে। ‘টাইগার’ অত্যন্ত সফল ফ্র্যাঞ্চাই়জ়ি। অ্যাকশন সেখানে চিরকালই প্রাধান্য পেয়েছে। কিন্তু সঙ্গে ছিল প্রেম, বিশ্বাসঘাতকতা, টান টান উত্তেজনা, সাসপেন্স। সবচেয়ে বড় কথা, এই ফ্র্যাঞ্চাইজ়ির নিজস্ব একটা ‘সোয়্যাগ’ ছিল। সে সব কিছুই ‘টাইগার ৩’-এ নেই। রয়েছে ‘পাঠান’-এর চেনা ফর্মুলা। গল্প এগোবে একই ভাবে, গল্পের মোড় ঘুরবে একই ভাব, ছবির বিরতি হবে একই ভাবে— সবই চেনা। শুধুই অ্যাকশনের ভেলকি আরও বেশি, ধার আরও বেশি।
‘পাঠান’-এর সাফল্যই যেমন ‘টাইগার’-এর গর্জন মিনমিনে করে দিয়েছে, আবার ‘পাঠান’ এসেছে ‘টাইগার’-কে বাঁচাতে। ছবিতে যে শাহরুখ খানের ক্যামিয়ো রয়েছে, তা বোধ হয় এখন কুয়োর ব্যাঙেরাও জেনে গিয়েছে। শাহরুখ এলেন, মারপিঠ করলেন, ‘ঝুমে যো পাঠান’ হল, কমেডি হল, তাঁর ঈর্ষণীয় চুল ফুরফুর করে হাওয়ায় উ়ড়ল এবং তিনি সলমনকে কথা দিলেন, ‘যব তক ম্যায় হুঁ, টাইগার জিন্দা রহেগা’। এবং সেটাই হল। গল্প যে মুহূর্তে ঝুলে যাচ্ছিল, সে মুহূর্তেই হলে সবচেয়ে বেশি সিটি পড়ল, হাততালির আওয়াজে ভেসে গেল এবং এই ছবিও যে হাজার কোটির ক্লাবে ঢুকতে পারে, তার আভাস পাওয়া গেল। আফসোস একটাই, টাইগারের ‘সোয়্যাগ’ একা সেটা করতে পারবে বলে বিশ্বাস করেননি নির্মাতারাও। তাই শাহরুখকে বলতেই হল, ‘ম্যায় হুঁ না’। তবে বাড়তি পাওনা, বড় পর্দায় দু’জনের ব্রোম্যান্স। এক বাক্যে যাকে বলা যায়, ‘সো বিউটিফুল, সো এলিগ্যান্ট, জাস্ট লুকিং লাইক আ ওয়াও’!
‘টাইগার’-এর আগের দু’টি ছবির পরিচালক ছিলেন কবীর খান (এক থা টাইগার) এবং আলি আব্বাস জ়াফর (টাইগার জ়িন্দা হ্যায়)। এ বার করেছেন মণীশ শর্মা। তাঁর জায়গায় অন্য কেউ করলেও ছবিটা এ রকমই হত। কারণ, পরিচালক যিনিই হোন না কেন, ফর্মুলা তো এক। এমনকি, ছবিতে ক’টা গান থাকবে, কোথায় থাকবে, কেন থাকবে— সবই তো জানা। বরং এই ফ্র্যাঞ্চাই়জ়িই এর আগে ‘মাশাল্লাহ’ বা ‘সোয়্যাগ সে স্বাগত’-এর মতো জনপ্রিয় গান দিয়েছিল। এ বার যেন দীর্ঘ প্রতীক্ষিত সলমন খান-অরিজিৎ সিংহের যুগলবন্দি ‘লেকে প্রভু কা নাম’-ও ফিকে পড়ল। তবে একটা কথা মানতেই হয়, ছবির অ্যাকশন দৃশ্যগুলি পপকর্ন খেতে খেতে উপভোগ করার জন্য আদর্শ। পরিচালক সে দিক থেকে কোনও ত্রুটি রাখেননি। সলমন-ক্যাটরিনাও রাখেননি। তাঁদের অভিনয় নিয়ে আলাদা করে বলার মতো কিছুই নেই। কিন্তু ভাইজান আর ভাবীর অ্যাকশনের প্রতি নিষ্ঠা দেখার মতো। ছবিতে রেবতী, রণবীর শোরে এবং ঋদ্ধি দোগরাকে ঠিকমতো ব্যবহারই করা হয়নি। তবে খলনায়কের চরিত্রে ইমরান হাশমি মন্দ নন। চিত্রনাট্যকার অবশ্য তাঁর প্রতিশোধের গল্পের পিছনেও খুব একটা পরিশ্রম করতে চাননি। ‘পাঠান’-এ জন আব্রাহামের চরিত্রের কাহিনিই একটু এ দিক-ও দিক করে চালিয়ে দিয়েছেন।
চেনা ফর্মুলা উৎসবের দিনে দেখতে মন্দ লাগছে না। বহু দিন ধরে ভাইজানের হিটের ঝুলি ফাঁকা। তাই এ বার আর কোনও ঝুঁকি নিতে চাননি বোধ হয়। প্রচুর মারপিটের মধ্যে শাহরুখ আসায় খানিক কমেডির স্বাদও পাওয়া গেল। সঙ্গে ‘ম্যাঁয় দিওয়ালি পটাকো সে নেহি, মুঁ মিঠা করকে মনাতা হুঁ’-র মতো খানিক বাণীও রয়েছে। চেনা শত্রু পাকিস্তান যেমন আছে, তেমনই আবার ‘শ্বশুরবাড়ি’ পাকিস্তানের প্রতি টাইগারের দায়িত্ব পালনও রয়েছে। অবশ্য তাতে নিজস্ব দেশপ্রেমে টান পড়েনি। ছবি শুরুর আগে জাতীয় সঙ্গীত আজকাল অনেক হলেই চালানো হয় না। টাইগার সেটা মনে রেখে ছবির মাঝেই সে দায়িত্বও পালন করেছে। সবই হয়েছে। কিন্তু এই দীপাবলিতে যা ভাল লাগছে, তা পরের দীপাবলিতেও ভাল লাগবে তো? শুধু ফর্মুলা মেনে আর কত দিন চলবে? শাহরুখের সিকোয়ন্স শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাশে বসে থাকা এক কিশোর অধৈর্য হয়ে বলে উঠল, ‘হৃতিক কখন আসবে’? টেম্পলেট মেনে ছবি না বানিয়ে এ বার বোধ হয় বলিউডেরও একটু অন্য চিন্তা করা উচিত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy