খোলা জানলা। ফাটা দেওয়াল। এ দিক-সে দিক লাগানো রয়েছে শাহরুখ খানের পোস্টার। আসবাবপত্তর বলতে খাট, চেয়ার-টেবিল আর একটা আলমারি মাত্র। এক কামরার এইটুকু ঘরেই দিব্যি দিন কাটাতে চেয়েছিল দিল্লিতে কেরিয়ার গড়তে যাওয়া মেয়েটি। তার চোখে একরাশ স্বপ্ন। কিন্তু হোস্টেলের সেই ৩৩৩ নম্বর ঘর যে তার জীবনে অন্ধকার বয়ে নিয়ে আসবে, তা বুঝতে পারেনি স্বপ্নজাল বোনা সেই মেয়ে।
সম্প্রতি ওটিটি প্ল্যাটফর্মের পর্দায় মুক্তি পেয়েছে সাইকোলজিক্যাল হরর ঘরানার ওয়েব সিরিজ় ‘খউফ’। আট পর্বের এই দীর্ঘ সিরিজ়ের পরতে পরতে ফুটে উঠেছে নারীজীবনের যন্ত্রণা। একসঙ্গে একাধিক কাহিনি দানা বেঁধেছে এই সিরিজ়ে। মূল কাহিনি এগিয়েছে মধু নামের এক নারীচরিত্রকে কেন্দ্র করে। গ্বালিয়রে বড় হয়ে ওঠা মধু স্বপ্ন দেখেছিল কলেজের গণ্ডি পার করার পর ছুটবে দেশের রাজধানীতে। সেখানেই কর্মরত রয়েছে তার প্রেমিক। দিল্লিতে গিয়ে চাকরি খুঁজবে মধুও। কেরিয়ার-সম্পর্কের ভবিষ্যৎ মনে মনেই ফুল দিয়ে সাজিয়ে ফেলেছিল সে। কিন্তু সেই সুন্দর বাগান তছনছ করে দিল মুখোশ পরিহিত তিন জন অচেনা পুরুষ। ধর্ষণের শিকার হল মধু।

সিরিজ়ের একটি দৃশ্যে অভিনেত্রী মোনিকা পনওয়ার। ছবি: সংগৃহীত।
অতীতের অন্ধকার বাস্তবেও ভয় দেখাতে শুরু করে মধুকে। প্রতিনিয়ত সেই দুঃস্বপ্নের সঙ্গে লড়াই করে প্রতি দিন এক নতুন জীবনে বাঁচার চেষ্টা করতে থাকে তরুণী। স্বপ্নপূরণের আশায় দিল্লি গিয়ে এক সরকারি হোস্টেলে থাকা শুরু করে সে। উপর তলার কোনার ঘরে মাথা গোঁজার ঠাঁই পায় মধু। কিন্তু সে ঘরেও যে লুকিয়ে রয়েছে দানবের ছায়া! সেই দানব ধারালো নখ দিয়ে মধুর জীবনেও আঁচড় ফেলে। সেখান থেকেই সিরিজ়ের গল্প শিকড়ের মতো নানা দিকে ছড়িয়ে পড়ে। প্রেম-বিচ্ছেদের পাশাপাশি বন্ধুত্ব, মা-ছেলের সম্পর্কের টানাপড়েন— সব কিছুই নিপুণ ভাবে ফুটে ওঠে ‘খউফ’-এর পর্দায়।
নারীমনে শব্দের আঘাত, পুরুষতান্ত্রিকতার কুয়ো থেকে জন্মানো অশালীন মন্তব্যের প্রভাব কী ভাবে পড়তে পারে, তা-ও দেখানো হয়েছে এই সিরিজ়ে। মূল গল্পের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে দিল্লির নির্ভয়াকাণ্ডের ভয়াবহতা। কাহিনি প্রসঙ্গে পর্দায় ফুটে উঠেছে সাদা ফেনার চাদরে ঢাকা যমুনার দূষণ।
এই সিরিজ় নির্মাণের দায়িত্বে ছিল ম্যাচবক্স শট্স নামের এক প্রযোজনা সংস্থা। অবশ্য ‘খউফ’ তাদের প্রথম কাজ নয়। এর আগে ‘স্কুপ’, ‘আইসি ৮১৪: দ্য কান্দাহার হাইজ্যাক’-এর মতো ওয়েব সিরিজ়ের পাশাপাশি ‘মনিকা, ও মাই ডার্লিং’, ‘থ্রি অফ আস’, ‘অল ইন্ডিয়া র্যাঙ্ক’-এর মতো চলচ্চিত্র তৈরি করেছে তারা। ‘খউফ’ ওয়েব সিরিজ়ের চিত্রনাট্য বেশ পরিণত। মুখ্য চরিত্রের পাশাপাশি সিরিজ়ের প্রতিটি পার্শ্বচরিত্রও যত্ন নিয়ে তৈরি করা হয়েছে। চরিত্রগঠনের পাশাপাশি মনে দাগ কাটে তারকাদের সাবলীল অভিনয়ও। মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করে আলাদা ভাবে প্রশংসার দাবি রাখেন মোনিকা পনওয়ার। পার্শ্বচরিত্রে তেমন বহুল পরিচিত মুখ না থাকলেও অভিনয়ের মাঠে সকলেই দুর্দান্ত পারফর্ম করেছেন। খলচরিত্রে রজত কপূরের অভিনয় যথাযথ। তবে এই সিরিজ়ে একেবারেই অন্য ভাবে দেখা গিয়েছে শিল্পা শুক্লকে। ‘চক দে! ইন্ডিয়া’ ছবিতে জাঁদরেল চরিত্রে অভিনয় করে নজর কেড়েছিলেন তিনি। এই সিরিজ়ে মনোবিদের চরিত্রে অভিনয় করেছেন শিল্পা। তাঁর বিশ্বাসযোগ্য অভিনয় এই চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে কোনও ফাঁক রাখেনি।

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
ভয়ের আবহ তৈরি করতে গিয়ে কিছু দৃশ্যে ‘জাম্পস্কেয়ার’ থাকলেও সিরিজ় নির্মাতারা যেন বেশি নজর দিয়েছিলেন রহস্যের জাল বোনার দিকে। প্রথম কয়েকটি পর্ব জুড়ে ধীর গতিতে প্রতিটি কাহিনির জাল বিস্তার করা হয়েছে। সিরিজ় এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যা দর্শকমনকেও অস্থির করে তুলতে বাধ্য করবে। এমনকি, সিরিজ়ের সমস্ত প্লট-সাবপ্লট মাথায় রেখে বিছিয়ে দেওয়া জালগুলি খুব যত্ন সহকারে ধীর গতিতে গোটানোও হয়েছে। সে দিক থেকে এই সিরিজ়টিকে ‘স্লো বার্ন’ বললেও আপত্তি নেই। তবে হাতেগোনা কয়েকটি জায়গায় কাহিনির কিছু অংশ বাদ দিলে সিরিজ়ের তেমন ছন্দপতন হত না বলেই মনে হয়। ৪৫ থেকে ৫০ মিনিটের এক একটি পর্ব গাঁথা রয়েছে আট পর্বের এই সিরিজ়ে। হরর ঘরানার ভারতীয় সিরিজ়ের তালিকায় ‘খউফ’ যে তার নাম লিখিয়ে ফেলবে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। হাতে বেশ খানিকটা সময় নিয়ে এই সিরিজ়টি দেখা যেতে পারে। রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘরে দেখলে তো গায়ে কাঁটাও দিয়ে উঠতে পারে।
গোড়ার দিকের পর্বগুলিতে তেমন ভয়ের আবহ না থাকলেও শেষের দু’-তিনটি পর্ব বেশ ভয় ধরায়। এই সিরিজ়ে চোখে আঙুল দিয়ে সামাজিক বার্তা দেওয়ার একাধিক জায়গা থাকলেও সিরিজ় নির্মাতারা সে দিকটি সচেতন ভাবেই যেন এড়িয়ে গিয়েছেন। সে কারণেই ‘খউফ’ দর্শককে চুম্বকের মতো নিজের দিকে টেনে নিতে সক্ষম হয়েছে। উপরন্তু সিরিজ়টি শেষ হওয়ার সময় দর্শকের ঘাড় ঝাঁকিয়ে যেন বলেও যায়, মেয়েদের মনে ভয়ের বাসা আর কোনও ‘খউফ’ সৃষ্টি করতে পারবে না।