কল্কি ২৮৯৮ এডি। ছবি: সংগৃহীত।
‘অশ্বত্থামা হত ইতি গজ’...’— ‘মহাভারত’-এর যুদ্ধে যুধিষ্ঠিরের বিখ্যাত সংলাপ দিয়ে ছবি শুরু হয়। যেখানে যুদ্ধে জয়লাভের জন্য তৈরি হয় সুপরিকল্পিত এক নাটক, নিহত হন অশ্বত্থামার পিতা গুরু দ্রোণাচার্য। এই ঘটনাই নিমেষে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের গতিপথকে বদলে দেয়। যুদ্ধের একেবারে শেষ পর্বে, যুদ্ধক্ষেত্রে ছড়িয়ে থাকা হাজার হাজার পচাগলা মৃতদেহের মধ্যে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণ অশ্বত্থামাকে অভিশাপ দেন, অশ্বত্থামার মৃত্যু না হলেও, প্রতিটি দিন তাঁকে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে হবে এবং তাঁর হাত ধরেই বিষ্ণুর দশম অবতার কল্কির আবির্ভাব ঘটবে।
সেই তথাকথিত অমর ‘অশ্বত্থামা’-ই নাগ অশ্বিন পরিচালিত এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ‘কল্কি-২৮৯৮ এডি’ ছবির অন্যতম প্রধান চরিত্র। মহাভারতের এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত দিয়ে কাহিনি শুরু হয়ে (ধরা হয়, সে সময় থেকেই কলি যুগের সূচনা), তার পর ছবি চলে যায় ২৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে। ওই সময়ের রুক্ষ শুষ্ক শহর কাশী এই ছবির পটভূমি। যেখানে স্বঘোষিত ঈশ্বর রাজা সুপ্রিম ইয়াসকিন (কমল হাসন) একটি অত্যাধুনিক ‘কমপ্লেক্স’-এ থাকেন। এই ‘কমপ্লেক্স’-এ মানুষ এবং রোবটের অত্যাধুনিক মেলবন্ধনে গড়ে ওঠে নতুন সভ্যতা। রাজা সুপ্রিম এক নতুন পৃথিবী তৈরি করতে চান, যেখানে বিজ্ঞান এবং পুরাণ মিলেমিশে একাকার। রাজার নির্দেশেই এই শহরের প্রতিটি প্রাণের স্পন্দন ওঠানামা করে। রাজার নিয়মেই সবাই এখানে জীবনধারণ করে। ওই ‘কমপ্লেক্স’-এর গবেষণাগারে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সুমতির (দীপিকা পাড়ুকোন) গর্ভে সন্তান আসে। এই সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য অশ্বত্থামা (অমিতাভ বচ্চন) এবং ভৈরব (প্রভাস) লড়াই করে। এই রকমই এক নাটকীয় টানাপড়েনে গল্প এগিয়ে যায় ক্লাইম্যাক্সের দিকে, যেখানে বিষ্ণুর দশম অবতার কল্কির আগমন বার্তাই হয়ে ওঠে এই ছবির মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। যে কাহিনির সঙ্গে কৃষ্ণের জন্ম কাহিনির অনেক মিল লক্ষ করা যায়।
এই ছবি সম্পর্কে প্রথমেই বলে নেওয়া ভাল, ‘কল্কি-২৮৯৮ এডি’ ছবিটি শুধুমাত্র একটি চলচ্চিত্র নয়, ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে এই ছবি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এই ছবির নির্মাণ, বিষয় ভাবনা, গল্প বলার ধরন, এ দেশের চলচ্চিত্র শিল্পে নির্দিষ্ট একটা মানদণ্ড তৈরি করে দেয়। যেখান থেকে ভারতীয় ছবির উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভাবা যেতেই পারে। যেখানে দাঁড়িয়ে অনায়াসে হলিউডের ছবির সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার কথা চিন্তা করা যায়! এই ছবি মুক্তি পাওয়ার আগে পর্যন্ত, কোনও ভারতীয় ছবিতে পুরাণ, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের এমন অসাধারণ মেলবন্ধন চোখে পড়েনি। মহাকাব্যের সঙ্গে কল্পনা ও বিজ্ঞানকে এমন সাফল্যের সঙ্গে মেশাতেও দেখা যায়নি। সাহিত্য, মহাকাব্য, দর্শন এবং বিজ্ঞান একই ছবিতে এ ভাবে কখনও কোনও ভারতীয় ছবিতে দৃশ্যায়িত হয়নি। দর্শকাসনে বসে এই ছবি দেখা অবশ্যই একটা অভিজ্ঞতা, কারণ এই ছবি থেকেই আমরা বুঝতে পারি, আগামী দিনে ভারতীয় চলচ্চিত্রের গতিপথ কী হতে চলেছে।
ছবিতে অভিনেতা হিসেবে অনেক বড় বড় নাম চোখে পড়ে। কমল হসন, অমিতাভ বচ্চন, প্রভাস, দীপিকা পাড়ুকোন, দিশা পাটানি, বিজয় দেবেরাকোন্ডা, ম্রূনাল ঠাকুর বা বাংলার শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়দের মতো জনপ্রিয় এবং বলিষ্ঠ অভিনেতারা এই ছবির সম্পদ। এই ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র অশ্বত্থামার ভূমিকায় অমিতাভ বচ্চনের অভিনয় এক অসাধারণ আবেশ তৈরি করে, যা দর্শকের কাছে বড় পাওনা হয়ে থেকে যায়। শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ের অভিনীত চরিত্রটিও দর্শকদের নজর কাড়ে। গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হলেও দীপিকা পাড়ুকোন এবং কমল হাসন-এর বরং তেমন কিছু করার সুযোগ ছিল না। মজাদার অ্যাকশন হিরো ভৈরব চরিত্রটি বৈচিত্র তৈরি করেছে, কিন্তু প্রভাসের অভিনয় চরিত্রটির প্রতি সুবিচার করতে পারল কই? জনপ্রিয় নায়কের ‘ইমেজ’ ভেঙে ছবির নির্দিষ্ট চরিত্র হয়ে ওঠা ভীষণ শক্ত কাজ। চটকদারি অভিব্যক্তি দিয়ে প্রভাস চরিত্রটিকে আকর্ষক করার চেষ্টা করেছেন মাত্র, তাই পর্দায় তাঁর উপস্থিতি এবং অ্যাকশন দৃশ্যে সিনেম্যাটিক চমক বেশ ভাল লাগে। অ্যাকশন এই ছবির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও, বেশ কিছু অ্যাকশন দৃশ্য দীর্ঘ মনে হয়েছে। এই দৃশ্যগুলি দর্শকদের একঘেয়েমিকে প্রশ্রয় দেয়। একটু যত্ন নিয়ে এই দৃশ্যগুলিকে সহজেই সম্পাদনা করা যেতে পারত।
ছবির প্রথমার্ধ জুড়ে গল্পের পটভূমি তৈরি করতে গিয়ে পরিচালক গ্রাফিক্স বা ভিএফএক্স-এর উপর বড় বেশি মনোনিবেশ করে ফেলেছেন, ফলে এই পর্বে চিত্রনাট্যের দুর্বলতা প্রকাশ পায়। বেশ কিছু দর্শনীয় দৃশ্য তৈরি হলেও, চিত্রনাট্য কেমন যেন ভোঁতা হতে থাকে। এখানে কাহিনির বেড়ে ওঠার দিকে আরও একটু নজর দেওয়ার দরকার ছিল বলে মনে হয়। দ্বিতীয়ার্ধে ছবিটি অনেক বেশি সুসংহত হয়ে এগোতে থাকে, ফলে ছবিতে গল্প বলার পথটি প্রশস্ত হয়ে যায়।
এই ছবির ‘সেট ডিজ়াইন’ এবং ‘সিনেমাটোগ্রাফি’ আগামী দিনের চলচ্চিত্রের ছাত্রছাত্রীদের কাছে শিক্ষনীয় বিষয় হতে পারে। আলোর অসাধারণ ব্যবহারে ক্যামেরার অসামান্য কাজ হিসেবে ‘কল্কি- ২৮৯৮’ ভবিষ্যতে নজির হয়ে থাকবে। শুধুমাত্র ক্যামেরা নয়, গ্রাফিক্স, ভিএফএক্স-এর কাজেও এই ছবি অবশ্যই একটি মাইলফলক, তবে সম্পাদনার ক্ষেত্রে আরও একটু কঠোর হওয়ার প্রয়োজন ছিল বলে মনে হয়। মনে রাখতে হবে চমকদার দৃশ্যকে বার বার দেখাতে থাকলে, চমকটাই ক্রমশ উধাও হয়ে যায়, তখন দর্শকদের কাছে সেগুলিই মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠে। ছবি দেখতে বসে বার বার মনে হয়েছে, শুধুমাত্র অ্যাকশন ও গ্রাফিক্স-এর মোহে অযথা কিছু দৃশ্যকে রবারের মতো টানা হয়েছে।
ছবিতে সন্তোষ নারায়ণের আবহসঙ্গীত বেশ ভাল হলেও বেশ কিছু জায়গায় আবহের প্রাবল্য দর্শকের মনোসংযোগে ব্যাঘাত ঘটায়। যে কোনও ছবিতে আবহ সঙ্গীতের পরিমিত ব্যবহার আদতে ছবিটিকেই সমৃদ্ধ করে। ‘কল্কি ২৮৯৮ এডি’র অনেক দৃশ্যই আন্তর্জাতিক স্তরের। এর মধ্যে, কুরুক্ষেত্রে অশ্বত্থামা ও কৃষ্ণের মুখোমুখি হওয়া, সুমতির আগুনের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাওয়া, ভৈরব ও অশ্বত্থামা পরস্পরের হাত ধরে সুমতিকে খাদে পড়ে যাওয়া থেকে উদ্ধার করা, ভৈরবের প্রথম পর্দায় আসা বা অশ্বত্থামা ও ভৈরবের মুখোমুখি যুদ্ধ ইত্যাদি দৃশ্য অসামান্য।
শেষ পর্যন্ত বলা যায়, অনেক আশা ও নিরাশার প্রেক্ষাপটে তৈরি ‘কল্কি ২৮৯৮ এডি’ ছবিটি দর্শকদের অন্য রকম এক অভিজ্ঞতার সাক্ষী করতে পারে। ছবির শেষে সেই প্রতিশ্রুতিই নজরে পড়ে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy