এতটা সত্যি শহুরে যাপনচিত্র ইদানীং তৈরি হতে দেখা যায় না। এক সময় দেখা যেত, যখন মৃণাল সেনরা এই শহরে ছিলেন, তখন তাঁরা এই শহরের ইতিকথা বড় পর্দায় ফুটিয়ে তুলতেন। না, তাঁর ‘ক্যালকাটা ট্রিলজি’র কথা বলছি না, বলছি ‘খারিজ’ বা ‘একদিন প্রতিদিন’-এর কথা। কিন্তু সমসাময়িক বাংলা ছবির পরিচালকেরা সে রকমটি আজকাল আর করে উঠতে পারেন না। সত্যি কথাটি সহজ করে বলে দিতে বুকের খাঁচার বৃহৎ পরিধির প্রয়োজন হয়। যেমন লাগে বিদেশের ক্রিকেট মাঠের ম্যাচে। বুকের খাঁচার আয়তনের বিষয়টি বিলেতের ট্রেন্ট ব্রিজে ’৯৬-এর টেস্টে প্রায় হারতে বসা ভারতের সঙ্গে ইংল্যান্ডকে ড্র করতে বাধ্য করার পর, নিজের অপরাজিত সেঞ্চুরি করা ইনিংস সম্পর্কে এক আড্ডায় নাকি উল্লেখ করেছিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। গল্পটি শুনেছিলাম বয়োজ্যেষ্ঠ এক সাংবাদিক সহকর্মীর মুখে। সৌরভ সেই সময় ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক। আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্ত নিজের পরিচালিত ‘মায়ানগর’ (ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন ক্যালকাটা) ছবিতে নিজের সেই বুকের খাঁচার পরিধিটিই স্পষ্ট করেছেন এবং সেই খাঁচা, বলতে বাধ্য হচ্ছি, যতটা দৃঢ়, ততটাই শক্তিশালী।
প্রথমেই বলে রাখি ‘মায়ানগর’ কিন্তু আদিত্যের আগের দু’টি ছবি ‘আসা যাওয়ার মাঝে’ বা ‘জোনাকি’র থেকে একেবারেই আলাদা। সুতরাং ‘আসা যাওয়ার মাঝে’ বা ‘জোনাকি’র দেখন-অভিজ্ঞতার সূত্র ধরে ‘মায়ানগর’কে দেখলে হবে না। আগের ছবিগুলি ছিল দুই বা এক মানব-মানবীর যাপনসত্য। ‘মায়ানগর’ একটি গোটা শহরের যাপনচিত্র। সেই শহরের বাসিন্দাদের যাপনের মাধ্যমে, চুম্বকে ধরা। একই সঙ্গে এটিও বলে নেওয়া ভাল, ‘মায়ানগর’-এর বীজ কিন্তু নিরুচ্চারে বপন করাই ছিল আদিত্যের আগের দু’টি সিনেমায়। যা লুক্কায়িত ছিল ২০১৪ সাল থেকে, তাকেই বলা যায় এক রকম প্রকাশ্যে আনলেন পরিচালক ২০২৫-এ পৌঁছে।

‘মায়ানগর’ ছবির একটি দৃশ্য। সংগৃহীত।
‘মায়ানগর’ এই মুহূর্তে অনবরত পাল্টাতে থাকা কলকাতার কথা বলে। কী ভাবে তার ভূগোল পাল্টাচ্ছে, মানসিকতা পাল্টাচ্ছে তার ফলে, আর এই সব পাল্টানোর পাগলামির প্লাবনে কী ভাবে পাল্টে যাচ্ছে এই শহরের অর্থনীতি, সমাজনীতি বা প্রশাসন, সেই কথাও বলে। আর যেটি উল্লেখযোগ্য, ছবি যে কেবল এ দিকেই দৃষ্টি দেবে, সেটি একেবারে প্রথম দু’টি দৃশ্যেই পরিষ্কার করে দেওয়া হয়। ছবি শুরু হয় এক জ্বলন্ত চিতার আঁচ ওঠার দৃশ্য দিয়ে; তার পরেই আসে অস্থি ভাসানোর দৃশ্য। পরিষ্কার হয়ে যায় পরিচালকের দৃষ্টিকোণ। এ শহর নতুন লক্ষ্যে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। পুরাতনের অস্থি সেখানে বিসর্জন দেওয়া হয়েছে।
আগের দু’টি ছবির তুলনায় এ ছবিতে অনেক বেশি সংখ্যক চরিত্র। সেটিও, ধরা যায়, এক রকমের চিত্র গঠনগত ইঙ্গিত যে এই ছবিটি খানিক অন্য রকম হবে। পাশাপাশি, এই বিষয়টিও এই বেলায় উল্লেখ করে নেওয়া ভাল যে আদিত্যের আগের দু’টি এবং এই ছবিটির মধ্যে মিল একটিই। তা হল ছবির গতি। যেখানে এতটুকু তাড়াহুড়ো, এতটুকু অকারণ ছোটাছুটি বা ব্যস্ততার এক ফোঁটাও ছাপ নেই। একটি গীতিময়, সমাহিত গতি রয়েছে এই ছবির গঠনেও। জীবন যেমন। এ জগতে যত দিন কাটানোর কথা লেখা আছে, সে ক’টা দিন তাকে কাটাতেই হবে এখানে। তাই অকারণ তাড়াহুড়োয় কোনও লাভ নেই। এ ছবিকে নানা ঘটনায়, নানা শাখা, উপশাখায় ভেঙে তাদের শেষে মূলে মিশিয়ে দিতে ঠিক যতটা সময় লাগা স্বাভাবিক, ততটাই সময় নিয়েছে এই ছবি।
কথা উঠিয়েছিলাম এই ছবির বিষয় নিয়ে। আধুনিক সময়ে, এই শহরের একেবারে সত্য এবং সৎ একটি যাপনচিত্র ধরা আছে এ ছবিতে। সেটি এক কথায় এই যে, শহরটি উপরে-উপরে যতটাই চাকচিক্যে ভরা থাক না কেন, আসলে ভিতর-ভিতর এক গভীর পচনে নষ্ট হয়ে গিয়েছে শহরটি। মৃতদেহের মতো। কেবল গভীরে বলে, কটু গন্ধটি পাওয়া যাচ্ছে না। যেমন বুবুর (ব্রাত্য বসু) মৃত্যু। এক পরিত্যক্ত খালি নাটকগৃহের উপরের তলায় অবস্থিত তার ফ্ল্যাটে বুবুর সব রকমের জাগতিক যোগাযোগহীন অস্তিত্ব। তাই বহু দিন আগে মৃত্যুর পর, আশপাশে কারও নাকেই তার ধীরে-ধীরে পচতে থাকা দেহের গন্ধটুকুও পৌঁছয়নি। সে চুপচাপ পৃথিবী থেকে সরে গিয়েছে। বুবুর সেই মৃতদেহ হয়ে ওঠে এই শহরেরই এক রূপক। যেন পরিচালক প্রশ্ন রেখে যান, এমনই কি এই শহরেরও ভবিতব্য?
এ রকমই এই ছবির প্রত্যেকটি চরিত্র। প্রত্যেকেই এক-একটি রূপক। আর তার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী রূপকটি হল, কলকাতার বাইপাসের পাশে সায়েন্স সিটির প্রবেশদ্বারের সামনে বসানো বিরাট এক ডাইনোসরের মূর্তি। যেটি ভাঙা পড়ে, নতুন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোডের উপর গড়ে ওঠা ফ্লাইওভারকে জায়গা করে দিতে। এ ভাবেই এই শহর ভেঙে-গড়ে নিতে চাইছে নিজেকে, পুরাতনকে বিসর্জন দিয়ে। সময়ের সঙ্গে উন্মাদ গতিতে পা মেলাতে চাইছে। এ দিকে কী আশ্চর্য! এক বিস্তৃত বিপরীতার্থক যাপনের প্রতিবিম্ব প্রলম্বিত হচ্ছে রোজ। সারা ক্ষণই আবহে বেজে চলেছে রবি ঠাকুরের লেখা ‘আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও’ (আবহ: মিন্সো এগার্সম্যন)। হয়তো তা বাজছে, বিশ্বভারতীর স্বত্বাধিকার উঠে যাওয়ার পরে, নতুন সুরক্ষেপণে। কিন্তু তার অবয়বটিই কেবল পাল্টাচ্ছে, হৃদয়টি সেই পুরাতনকেই আঁকড়ে আছে। অর্থাৎ, সেই পুরাতনকে জাপটে ধরেই আসলে আমাদের এই বর্তমান অস্তিত্ব, ব্যাপক ভাবে বিপরীতার্থক।

গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
অভিনয় এ ছবির একটি মূল্যবান রত্নবিশেষ। এলা (শ্রীলেখা মিত্র), বুবু, প্রদীপ্ত (অনির্বাণ চক্রবর্তী), শিশির (সত্রাজিৎ সরকার), ভাস্কর (অরিন্দম ঘোষ) বা রাজা (সায়ক রায়) এবং অন্যেরা প্রত্যেকেই নিজের-নিজের কাজটি নির্ভুল ভাবে করেছেন এবং যথেষ্ট ভাল ভাবেই, তুখোড় পেশাদারিত্বের সঙ্গে করেছেন। যে কারণে এত জটিল অঙ্কের ছবিও সুষ্ঠু ভাবে একটি দৃঢ় গঠন পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে যেটি দেখার, সেটি হল শ্রীলেখা এবং ব্রাত্যের উপস্থিতি। শ্রীলেখা প্রথম থেকেই অত্যন্ত শক্তিশালী অভিনেতা। কিন্তু মানুষ হিসাবে ভীষণ ঠোঁটকাটা। বর্তমান বেশির ভাগ বাঙালি পরিচালক তাই হয়তো এমন বিস্ফোরক অভিনেতাকে এড়িয়ে চলেন। দুর্ভাগ্য বাঙালি সিনে-দর্শকের। এক শক্তিশালী অভিনেতার কাজ তাঁরা ঘন-ঘন দেখা থেকে বঞ্চিত হন।
এক বছরের কিছুটা বেশি সময়ে বাঙালি দর্শকের কাছে ধরা দিলেন ব্রাত্য, তিনটি সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রার ছবিতে। প্রথমে, ’২৪-এর মাঝামাঝি এক পার্থিব-ভোগে লৎপৎ দৃষ্টি-চিকিৎসক হয়ে (‘মানিকবাবুর মেঘ’ বর্ষা, ২০২৪), তার পর এক শৃঙ্খলাবদ্ধ উন্মাদ হত্যাপিপাসু হয়ে (‘চালচিত্র’, শীত, ২০২৪) এবং এ বার ২০২৫-এর বসন্তে ‘মায়ানগর’ ছবিতে, এক একাকী, জীবনবিমুখ, অবসাদগ্রস্তের চরিত্রে। প্রত্যেকটিতেই তাঁর খুব কম সময়ের পর্দা-উপস্থিতি। রাজ্যের মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য হিসাবে খুব বেশি সময় অভিনয়ের পিছনে ব্যয় করার অবসর যে তাঁর নেই, তা সহজেই অনুমেয়। অথচ এর প্রত্যেকটি চরিত্রেই এই জাত-অভিনেতাটি নিজের স্বকীয় প্রতিভার এক গভীর ছাপ রেখে চলেছেন। ‘মায়ানগর’ ছবিতে তাঁর অভিনীত বুবু আলোচনায় উঠে আসবে আশা করা যায়।
আদিত্য কিন্তু সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কোথাও শালীনতার গণ্ডি পার করেননি। একটি দৃশ্যের উদাহরণ দিলেই তা বোঝানো যাবে। প্রদীপ্ত, এলার কর্মসংস্থার কর্ণধার হিসাবে, নানা সময়ে তাকে সমানে ব্যক্তিগত সম্পর্কে আসার জন্য অনুরোধ করে। একটি সময় আসে যখন এলা সেই অনুরোধে সাড়া দিতে বাধ্য হয়। ক্যামেরা এলার সেজেগুজে প্রদীপ্তের ভাড়া করা হোটেলের ঘরে প্রবেশ করা পর্যন্ত দেখায়। তার পরের অবধারিত শয্যাদৃশ্যটি কিন্তু আর দেখানো হয় না। তার জায়গায় দেখানো হয় এলার সম্ভবত বিবাহবিচ্ছিন্ন স্বামীর পোষ্য জার্মান শেফার্ড মাদী সারমেয়টির সঙ্গে অন্য একটি একই জাতের পুরুষ সারমেয়র মিলনের আগের মুহূর্তটুকু। প্রসঙ্গত, কেবল এমন দৃশ্য রচনাই নয়, প্রত্যেকটি দৃশ্যেই তুর্কি সিনেমাটোগ্রাফার গোখান তিয়ার্কির ক্যামেরা আসলেই যেন ছবিটির আরেকটি চরিত্র হয়ে উঠেছে।
আসলে ‘মায়ানগর’ নিছকই একটি ছায়াছবি নয়। একই সঙ্গে সেটি আসলে একটি চিত্রভাষ্যে গড়ে তোলা শহরের অধুনা যাপনচিত্রের উপর তৈরি পরিচালকের মতামত। যা প্রতি পদক্ষেপে দেখায় নাগরিক যাপন আসলে এক ভাবে সমাজমাধ্যমের পাতায় আমরা যে ভাবে আমাদের প্রতিভাত করে চলেছি, তারই প্রতিরূপ, সম্পূর্ণ মেকি। আসলটি ঢেকে-ঢুকে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা, আর পরতে-পরতে মিথ্যার পর্দা। সে কারণেই, এলার বাল্যপ্রেমিক ভাস্কর, বিবাহিত হয়েও কেবল এলার সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য অবলীলায় বলে দেয় সে অবিবাহিতই রয়েছে। আবার এলাও তার প্রতি দিনের মদ্যপানের অভ্যাসের কথা সম্পূর্ণ অনুল্লিখিত রেখে দেয় ভাস্করের কাছে। অর্থাৎ, তাদের সম্পর্কটিই তৈরি হয় মিথ্যার উপর তৈরি দুই ভিতে। যেমন সমাজমাধ্যমে আমরা সকলেই হাসিমুখের ছবি দিই, সুখের পরিচয় দিতে উন্মুখ হয়ে থাকি।
বাংলা ছবির দর্শক হিসাবে যে ব্যাপারটি দেখে পুলকিত হচ্ছি, তা হল দু’মাসের মধ্যে যেন এক ব্যাপক উত্তরণ ঘটেছে বাংলা ছবির। পর পর তিনটি অত্যন্ত সুনির্মিত সিনেমা মুক্তি পেল রাজ্যে। হয়তো বাংলা ছবির গৌরবের হৃত সময়টি আবারও ফিরে আসতে চলেছে, এমন আশা করাটা কি এই সময়ে দাঁড়িয়ে, খুব দুরাশা?