দ্বিতীয় পুরুষ
পরিচালনা: সৃজিত মুখোপাধ্যায়
অভিনয়: পরমব্রত, অনির্বাণ, রাইমা, গৌরব, ঋতব্রত
৬/১০
থ্রিলার আর সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের কম্বিনেশন এবং একটা ন্যাশনাল হলিডে— এই যুগলবন্দি যে হল ভরাতে টনিকের মতো কাজ করেছে, সেটা নেতাজির জন্মদিনের সকালে ভালমতো টের পাওয়া গেল। প্রত্যাশা এবং মানদণ্ড হিসেবে যে নামটা সামনে ছিল, সেটা ‘২২শে শ্রাবণ’। ‘হু ডান ইট’ আর ‘হাউ ডান ইট’ পেরিয়ে এ বার ‘হোয়াই’ অর্থাৎ কারণ খোঁজার চোর-পুলিশ খেলায় নেমেছিলেন পরিচালক। এমন একটা খেলা, যেখানে সারা গল্পে চোর আর পুলিশ সামনাসামনি এক বারও হয় না। একেবারে শেষে গিয়ে সপাটে ধাক্কাটা দেওয়ার জন্যই।
সোশ্যাল নেটওয়র্কের দৌলতে ছবি মুক্তি পাওয়ার আগে থেকেই খোকা ‘হিট’। খোকা (অনির্বাণ ভট্টাচার্য) একটা হিসেব মেলাতে চায়। তাকে তাড়া করে বেড়ায় কিছু একটা, যার জন্য ট্যাংরার অলিগলি আর লাল দরজায় ধাক্কা খেতে খেতে সে করে ফেলে একের পর এক খুন, সিগনেচার স্টাইলে। খুনিকে পাকড়ানোর দায়িত্ব এসে বর্তায় অভিজিৎ পাকড়াশীর (পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়) উপরে। ‘সিরিয়াল কিলার স্পেশ্যালিস্ট’ অভিজিৎ ‘২২শে শ্রাবণ’-এর চেয়ে এখন অনেক বেশি ‘সর্টেড’, রাগ গিলে নিতেও জানে। অধঃস্তন অফিসার রজতকে (গৌরব চক্রবর্তী) এবং সেই সঙ্গে দর্শককেও সিরিয়াল কিলারের সংজ্ঞা বুঝিয়ে দেয় অভিজিৎ। অমৃতার (রাইমা সেন) সঙ্গে তার দাম্পত্য এখন অবেলার ডাল-ভাতের মতোই পানসে। সূর্য সিংহও (আবীর চট্টোপাধ্যায়) মাঝে একবার হাজির হয় প্লটে, প্লেটে বিরিয়ানির ‘স্পেশ্যাল অ্যাপিয়ারেন্সে’র মতোই! ঘরের ঝড় সামলাতে সামলাতেই অভিজিৎ নেমে পড়ে খোকার সন্ধানে। পরের ঘটনা পর্দায় দেখাই বাঞ্ছনীয়।
আগেরটির মতোই এ ছবিরও ক্লাইম্যাক্সেই তুরুপের তাসটি লুকিয়ে রেখেছেন সৃজিত। সেই চমকে ধাতস্থ হয়ে যুক্তি খুঁজতে গেলেই নড়বড়ে লাগতে পারে ‘যতনে সাজানো’ চিত্রনাট্যটি। কী হল সেটা বোঝা গেলেও, কেন হল তা তলিয়ে দেখতে গেলেই বেরিয়ে পড়বে বড়সড় ফাঁকফোকর। প্রবীর রায়চৌধুরীর (প্রসেনজিৎ) প্রসঙ্গ আনতে হবে বলেই, যেন তার আদলে নতুন একটি চরিত্র আমদানি করা হয়েছে সিকুয়েলে। স্বভাবটিও আশ্চর্যভাবে এক ছাঁচে ঢালা! সহকারী পুলিশ অফিসার হিসেবে গৌরবের চরিত্রটিও দাবার বোড়ে হয়েই রয়ে গেল। পুলিশি হেফাজতের অন্দরের এক অপরাধীকে নিয়ে এত বড় একটা ‘আইওয়াশ’, যা এ কাহিনির ভিত, অথচ ঘুণাক্ষরেও কেউ তা জানতে পারল না? এত বছর পরে সেই ঘটনাই আবার পুলিশকে ঘোল খাইয়ে ছেড়ে দিচ্ছে, মেনে নেওয়া মুশকিল। কলকাতা পুলিশের সফল, ঝরঝরে বাংলা জানা অফিসারের ‘অতীত’ যখন এসে বিষম ধাক্কা দেয়, তখন খোকার মতোই দর্শকেরও হিসেব মেলাতে অসুবিধে হয়। ছক মিলিয়ে পরপর যে তিনটে খুন হল, তার জন্যই যেন অপেক্ষা করছিল পুলিশ আর তার টিম। হিসেব মেলাতে সুবিধে হত, যদি প্রথম থেকে ছেড়ে যাওয়া সুতোগুলো আর একটু মজবুত হত।
‘২২ শে শ্রাবণ’, ‘চতুষ্কোণ’ কিংবা হালের ‘ভিঞ্চি দা’র মতো থ্রিলার উপহার দেওয়ার পরে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠবে, ‘দ্বিতীয় পুরুষ’ সেই উচ্চতায় পৌঁছল কি না। তুলনা আসবে ন’বছর আগের ছবিটার সঙ্গেও। সেই মাপকাঠিগুলোয় সৃজিত মুখোপাধ্যায় এ যাত্রা উতরে গেলেন কি না, তা দর্শক বলবেন। আর বলবে ছবির বক্স অফিস। তবে সৃজিতের এ বারের সাজানো চৌষট্টি খোপের ঘুঁটিরা প্রায় প্রত্যেকেই ছক্কা হাঁকিয়েছেন। ঋতব্রত মুখোপাধ্যায় প্রথম দৃশ্যেই ছবির মুড সেট করে দিয়েছিলেন। পর্দায় এলেই গা ঘিনঘিন করবে, এমন চরিত্রে অনির্বাণকে নিয়ে পরিচালকের এক্সপেরিমেন্ট কুর্নিশযোগ্য। পরমব্রত-আবীর একবারই এক ফ্রেমে এসেছেন। সে দৃশ্য মৌনমুখর ও সুন্দর। অরিজিৎ সিংহের ‘আবার ফিরে এলে’ মন ছুঁয়ে যায়। ‘যে ক’টা দিন’ ফিরিয়ে দেয় পুরনো ভাল লাগা। রাইমাও স্বল্প পরিসরে মানানসই। গৌরব-ঋদ্ধিমার জুটি এই থ্রিলারের স্ক্রিপ্টে অতিরিক্ত মেদ হলেও তাঁদের অংশটা ‘শর্ট অ্যান্ড ক্রিস্প’ রাখা হয়েছে। আগের ছবিতে প্রবীর রায়চৌধুরীর মতোই এ ছবিতে অভিজিৎ পাকড়াশীর মুখ দিয়েও একাধিক তথ্যসম্বলিত পাঞ্চলাইন বলিয়ে নিয়েছেন পরিচালক। এ-ও জানিয়েছেন, ডাল-ভাত আর বিরিয়ানির মধ্যপন্থা হতে পারে হালিম!
ছবির সবচেয়ে বড় চমকের মধ্যেই লুকিয়ে সবচেয়ে বড় গরমিল। অতএব, স্বপনকুমারের সিরিজ়ের মতোই ‘কী হইতে কী হইয়া গেল’র জট ছাড়াতে হবে নিজ দায়িত্বে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy