বিপ্লবী উধম সিংহ হয়ে উঠলেন কি ভিকি কৌশল
‘সর্দার উধম’। এ গল্প শুধুমাত্র এক বিপ্লবীর সংগ্রামের কথা নয়; মনুষ্যত্বের চরম অবমাননার কাহিনি!
ঘটনার সময়কাল ১৯১৯ থেকে ১৯৪০; অর্থাৎ মোট একুশ বছর। পরিচালক সুজিত সরকার এখানে বিপ্লবের গল্প বলেছেন একটু অন্য আঙ্গিকে। সেই গল্পের আগুপিছু বর্তমান থেকে অতীতে, আবার অতীত থেকে বর্তমানে। দু’ঘণ্টা চল্লিশ মিনিটের ছবি। আপাত ভাবে মনে হতেই পারে দৈর্ঘ্য খানিক বেশি। কিন্তু গল্প বলার ধরনেই হয়তো সময়ের এই বিস্তার।
স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম যোদ্ধা উধম সিংহ (ভিকি কৌশল) ইতিহাসে এবং আমজনতার কাছে ততটা পরিচিত নন। তিনের দশকের কাহিনিতে এ ছবি আরম্ভ হয় জেলখানার অন্ধকার ঘরে শুয়ে থাকা উধমকে দিয়ে। জেলরক্ষী তাকে ডেকে তুলে বলে, ‘আজাদি হয়ে গিয়েছে। দেশের নয়, তোর, যা!’ জেল গেটের বাইরে বেরিয়ে আসতে দেখি উধমকে। এর পর অমৃতসর থেকে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, রাশিয়া হয়ে লন্ডনে পৌঁছয় গল্পের মোড়।
ভারতকে ব্রিটিশদের কবলমুক্ত করা উধমের স্বপ্ন ছিলই; সেই সঙ্গেই বুকের ভিতর লুকোনো ছিল এক গোপন সংকল্প। কী সেই লক্ষ্য? তা জানতে অবশ্য বহু ক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় দর্শকদের। ইতিমধ্যে তাঁর শেষ গন্তব্য লন্ডনে তাঁকে দেখি জীবন যাপনের হরেক পথ ধরতে; কখনও কারখানার শ্রমিক, কখনও বা ছোট ব্যবসাদার হিসেবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে জামা কাপড় বিক্রি। এই বর্তমানের মধ্যেই অতীতের প্রবেশ। সেখানে উধমকে দেখা যায় বিপ্লবী ভগৎ সিংহের( অমল পরাশর) সঙ্গে। এক সুন্দর বন্ধুত্বের সম্পর্কে। এই অতীতচারণার মধ্যেই আসে রেশমার (বনীতা সাঁধু) সঙ্গে উধমের চাপা নরম এক ভালবাসার গল্প।
আবার ঘটনা এগিয়ে যায়। পরাধীন ভারতবর্ষের পঞ্জাবে প্রাক্তন লেফটেন্যান্ট গভর্নর মাইকেল ও’ডায়ার (শাউন স্কট) লন্ডনের এক সম্ভ্রান্ত সভাঘরে বক্তৃতা দিচ্ছেন; বলছেন— ভারতীয়দের বেয়াদবি বেড়ে ব্রিটিশদের মাথা ব্যথার কারণ হওয়ার আগেই তাদের শায়েস্তা করতে হবে। আচমকা এক যুবক এগিয়ে আসে। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চালিয়ে দেয় পরপর গুলি। এই যুবকই উধম সিংহ; যাকে এর পরে বহু ক্ষণ দেখা যাবে ব্রিটিশ জেলখানায়, চরম অত্যাচারিত হতে।
আমাদের নায়ককে লন্ডনে এসে এ কাজ করতে হল কেন? ফের অতীতে হাঁটে গল্প। দেখা যায়, নায়ক ডায়ারকে অনুসরণ করতে করতে তাঁর বাড়ি কাজ জুটিয়ে নিয়েছেন। বরফের মধ্যে দাঁড়িয়ে বন্দুক হাতে শিকারে ব্যস্ত ডায়ার। অপর বন্দুকটি হাতে সহকারী উধম। স্বয়ং ডায়ারের মাথা তার নিশানায়। ঠিক তখনই পিছনে ফেরেন ডায়ার। হাত বাড়িয়ে বন্দুকটি নিতে চাইলে নায়ক শান্ত ভাবে তা এগিয়ে দেন। কেন উধমের এত রাগ ডায়ারের উপরে? নাকি সমগ্র ব্রিটিশ জাতির উপরেই তার ক্রোধ? ধীরে ধীরে সেই জট খোলে গল্পের পরতে পরতে।
উধম সিংহ বিপ্লবী। তবু ছবিতে আগাগোড়াই সাধারণ মানুষ হিসেবে তাঁকে ধরতে চেয়েছেন পরিচালক সুজিত সরকার। স্বাধীনতা আন্দোলন এবং বিপ্লবীর জীবনকথায় সাধারণত যে সব তীব্র সংলাপ থাকে, এখানে তার বিপরীত দৃশ্য। শুভেন্দু ভট্টাচার্য এবং রীতেশ শাহের গল্প ও সংলাপে আপাত নায়কোচিত না হয়েও, উধম সত্যিকারের নায়ক হয়ে উঠেছেন। মানুষ তাঁর সঙ্গে একাত্ম বোধ করবে। ছবি দেখতে দেখতে যেন দীর্ঘ এক কবিতায় প্রবেশ করার অনুভূতি হয়। মিলেমিশে যায় বাস্তব ও রূপক। বিপ্লবীর অনিশ্চিত জীবনের মধ্যে লাড্ডু প্রীতির মতো একেবারে সাধারণ পছন্দ-অপছন্দ উধমকে বাস্তবের কাছাকাছি নিয়ে যায়।
উধম সিংহের চরিত্রে দারুণ অভিনয় ভিকি কৌশলের। ছবির ছোট-বড় বিভিন্ন চরিত্রে নিজেদের সম্পূর্ণটা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন অভিনেতারা। উধমের এক দেশ থেকে আর এক দেশে যাওয়া; যাত্রাপথে ধু ধু বরফের প্রান্তর, কুকুরে টানা স্লেজ গাড়ি, তিরিশের দশকের লন্ডন… অভীক মুখোপাধ্যায়ের ক্যামেরায় চমৎকার লাগে এসব দৃশ্যায়ন। রাশিয়ার তীব্র শীতের মধ্যে ঘর গরম হছে পাত্রে রাখা কাঠকয়লার ধিকি ধিকি আগুনে। ক্যামেরা সেখানে স্থির হয়; আসলে গল্পটাই যে চাপা আগুনের মত। তার সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করেছে শান্তনু মৈত্র, জর্জ জোসেফের আবহ সঙ্গীত।
চন্দ্রশেখর প্রজাপতির সম্পাদনা চমৎকার। ছবিতে সামান্য যেটুকু ফাঁক, তা হল গল্প মূল ক্লাইম্যাক্সে প্রবেশ করে অনেকখানি পরে। সময় অনুযায়ী বদলে যাওয়া ঘটনাকে অনুসরণ কখনও কখনও দর্শকের জন্য কিছুটা জটিল হয়ে উঠতে পারে। তবে শান্ত এবং সরল ভাবে তীব্র দহনের গল্প বলায় যে মুন্সিয়ানার প্রয়োজন, সে দক্ষতা দেখিয়েছেন সুজিত। অনুভূতিশীল মানুষের কাছে এ ছবি অত্যন্ত উপভোগ্য হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy