Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Film Review

‘Ekannoborti’ Movie Review: বাঙালি আবেগে মোড়া জমজমাট প্যাকেজ, তবু ‘একান্নবর্তী’তে ভাঙন ধরাল কাহিনির অতি সরলীকরণ

পুরনো কাসুন্দিতেই আটকে গেল ‘একান্নবর্তী।‘ নতুন কিছু বাঙালি পেল কই?

তিন নারী ও তাদের বিভিন্ন সঙ্কট ঘিরে আবর্তিত হয় ছবির গল্প।

তিন নারী ও তাদের বিভিন্ন সঙ্কট ঘিরে আবর্তিত হয় ছবির গল্প।

ইন্দ্রদত্তা বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০২১ ১৪:২৮
Share: Save:

দুর্গাপুজো, পরিবারের গল্প, প্রেম, পুরনো বাড়ি, স্মৃতিমেদুরতা- সমস্ত উপাদান হাজির। মৈনাক ভৌমিকের নতুন ছবি ‘একান্নবর্তী’ হাঁটল বাঙালি আবেগের চেনা ছকে। উচ্চ মধ্যবিত্তের অন্দরমহলে ভাঙা পরিবারের কাহিনি। তার মধ্যেই খানিক আবেগ, পুরনো প্রেম-নতুন প্রেম, আবার খানিক প্রগতিশীলতার বার্তা— সব মিলিয়ে জমজমাট প্যাকেজ। কিন্তু বুনোট ও ভাবনাচিন্তার স্তরের অভাবে সেই পুরনো কাসুন্দিতেই আটকে গেল ‘একান্নবর্তী।‘ নতুন কিছু বাঙালি পেল কই?

গল্পের ধারা স্পষ্ট ছিল প্রচার ঝলকেই। আধুনিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত অণু-পরমাণু পরিবার। তার কাঠামোয় মা, মেয়ে, নাতনি- সকলেই থাকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। বছর ঘুরে গেলেও বৃদ্ধা মায়ের (অলকানন্দা রায়) খোঁজ নেওয়ার সময় হয় না কারও। দেখা-সাক্ষাৎ বলতে বছরে এক বার মাত্র, পারিবারিক দুর্গাপুজোয়। বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের ক্ষয়িষ্ণু ঐতিহ্যের এক মাত্র স্মারক এই পুজো। সে ধারা বয়ে নিয়ে চলার দায়িত্বও কার্যত বিধবা মায়ের উপরেই ন্যস্ত। এ দিকে, সেই পুজোতেই ঘটে যায় একটি দুর্ঘটনা, যা বদলে দেয় বহু সমীকরণ, পরিসর, উপলব্ধি।

ছবির কেন্দ্রে এক মা ও তার দুই মেয়ে। তিন নারী ও তাদের বিভিন্ন সঙ্কট ঘিরে আবর্তিত হয় ছবির গল্প। গত ২৫ বছর ধরে সংসারের ভার মালিনীর কাঁধে (অপরাজিতা আঢ্য)। পুজোর আগে আচমকা খবর আসে— বর সুজন (সুদীপ মুখোপাধ্যায়) একটি দুর্ঘটনায় গুরুতর জখম, ছুটতে হবে হাসপাতালে। সেখানে মালিনীর অপেক্ষায় ছিল এক অজানা বিপর্যয়। দীর্ঘদিন ধরে স্বামীর লুকিয়ে রাখা কথা প্রকাশ্যে এসে উল্টেপাল্টে দেয় সাজানো গোছানো দাম্পত্য। এ দিকে, মালিনীর বড় মেয়ের ( সৌরসেনী মৈত্র) দীর্ঘ দিনের সম্পর্কও তলানিতে দাঁড়িয়ে। ছোট মেয়ে পিঙ্কি (অনন্যা সেন) তার পছন্দের পাত্রের সঙ্গে আটকে আছে এক কাল্পনিক সম্পর্কে।

‘একান্নবর্তী’ ছবির দৃশ্য।

‘একান্নবর্তী’ ছবির দৃশ্য।

ঠিক সেই বছরই পুজোয় ওই বাড়িতে ওয়েবসিরিজের কাজ করতে আসে একটি দল। সিরিজের পরিচালক অভ্রদীপ দত্তর (কৌশিক সেন) সঙ্গে মালিনীর একটি মিষ্টি প্রেমের পরিসর গড়ে ওঠে। আবার, সহকারী পরিচালক অমিত (শাওন চক্রবর্তী) প্রেমে পড়ে পিঙ্কির। বাকি থাকেনি বড় মেয়ে বা বাড়ির পরিচারিকাও। চার-চারটি প্রেমের কাহিনি পুজোর ৪ দিনে।
অভিনয় এ ছবিতে এক শক্ত খুঁটি। অপরাজিতাকে মালিনীর ভূমিকায় বেশ ভাল লাগে। তবে পর্দায় মধ্যবিত্ত ছা-পোষা গৃহবধূর চরিত্রের বাইরে তাঁকে পেতে হয়তো আরও কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে বাঙালি দর্শককে। অপরাজিতার সঙ্গে কৌশিক সেনের সম্পর্কও পর্দায় ভারি মিষ্টি লাগে। অভ্রদীপের ভূমিকায় কৌশিককেও মানিয়েছেও ভাল। সংসারের দায়িত্ববান ও তথাকথিত ভাল মেয়ে হওয়ার চাপ সামলাতে সামলাতে ক্লান্ত হয়ে পড়া এক তরুণীর অন্তর্দ্বন্দ্ব যত্নে ফুটিয়েছেন সৌরসেনী। তবে পিঙ্কির চরিত্রে নজর কেড়েছেন অনন্যা সেন। মোটা, পড়াশোনায় তেমন ভাল না হওয়ায় বরাবর দিদির ছায়ায় ঢাকা পড়ে থাকার অনিশ্চয়তা, হীনমন্যতা নিখুঁত ভাবে তুলে ধরেছেন তিনি। খুনসুটি-ঝগড়া-ভালবাসা মিলিয়ে দিব্যি জমে গিয়েছে দুই বোনের রসায়ন। তবে ছবির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যাঁর নিজস্ব ঢঙে এ ছবির ছন্দ বাঁধা, তিনি অলকানন্দা রায়। সকলের আদরের দিদুনের চরিত্রে তাঁর অভিনয় মনে রাখার মতো।

কিন্তু তার পরেও থেকে গেল কিছু গুরুতর ফাঁক। এই ছবির মূল সমস্যা হয়ে উঠেছে অতি সরলীকরণ। কেবল কাহিনির ধারা নয়, চরিত্রগুলির উপস্থাপনা থেকে গল্প বলার ধরন, সংলাপ- সবেতেই সেই প্রবণতা। ফলে, রান্নাঘরে আটকে থাকা গৃহবধূর একাকীত্ব থেকে সমাজ নির্মিত ‘বডি ইমেজ’-এর সমস্যার মত গুরুতর কিছু বিষয় তুলে ধরলেও, ‘একান্নবর্তী’ আটকে গেল সাদা-কালোর বাইনারিতে। ভাল ও খারাপের মাঝে কিছুই রাখলেন না পরিচারক। না কোনও স্তর, না ওঠানামা। চরিত্রগুলিও শুরু থেকে শেষ একমুখী, এক রেখায় চলা। পরের দৃশ্যে কী হতে চলেছে, অনুমান করা খুব কঠিন হয়নি কখনওই।
একান্নবর্তী বলতে পিসি-জ্যাঠা-কাকাদের ঘিরে যে বিরাট যৌথ পরিবারের ছবি ভেসে ওঠে তার ধারেকাছে হাঁটেননি পরিচালক। মালিনী ও তার দুই মেয়েকে বাদ দিলে বাড়ির পুজোর অতিথি আর এক আমেরিকা নিবাসী আত্মীয়-দম্পতি। এই আপাত সুখের মোড়কে ফ্রেমের পর ফ্রেম যে আদর্শ জীবনের গল্প বলে, বা যে দিকে গড়ায়, তা আসলে মধ্যবিত্ত বাঙালির বাস্তবের থেকে অনেক দূরে। সেখানে বাড়ির অন্দরেও মেয়েদের ঠোঁটে লিপস্টিক, পরনে দামি ও পরিপাটি পোশাক। সাজানো-গোছানো ড্রয়িং রুম ও রঙিন ঠাকুর-দালান কুহক আঁকে মধ্যবিত্তের সেই অধরা উচ্চাকাঙ্ক্ষারই।
বাংলা ছবিতে এই ধারা শুরু হয়েছিল ঋতুপর্ণ ঘোষের হাত ধরে। এই ছবির পরতে পরতেও তাকেই বয়ে নিয়ে চলার ইঙ্গিত। উচ্চ-মধ্যবিত্তের সুখী গৃহকোণে বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের সঙ্কট মনে করাতে পারে ‘দোসর’, দুর্গাপুজোর প্রেক্ষিত মনে করাতে পারে ‘উৎসব’ বা ‘হীরের আংটি’, আবার পুরনো বাড়িতে ফিল্মের শ্যুটিং দেখে মনে পড়ে যেতে পারে ‘বাড়িওয়ালি’। ছবি শেষেও এক লাইনে ‘ঋতুদা’-র প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন। কিন্তু উচ্চ-মধ্যবিত্তের আরাম ও বিলাস যাপনের যে প্রচ্ছন্ন সমালোচনা এই ধারার বৈশিষ্ট্য, তা মৈনাকের ছবিতে অনুপস্থিত।

‘একান্নবর্তী’ ছবির দৃশ্য।

‘একান্নবর্তী’ ছবির দৃশ্য।

ছবির আর একটি দুর্বলতার জায়গা সংলাপ। বারবার যেন শিক্ষামূলক বার্তা চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা। ফলে চরিত্রদের কথোপকথন নিজস্ব স্বাভাবিকতা হারিয়েছে বেশ কিছু ক্ষেত্রে। কিছু ক্ষেত্রে অযত্নও চেখে পড়ে। যেমন, মালিনী ও অভ্রদীপের একসঙ্গে একটি ছবি তুলে দেওয়ার দৃশ্যে মোবাইলের পর্দায় ধরা পড়ল শ্যুটিং সেট-এ ব্যবহৃত আলো, ক্যামেরায় যা কোনও ভাবেই ধরা পড়ার কথা নয়। একাধিক দৃশ্যে চরিত্রের মুখের দিকে জুম করে এগিয়ে যায় ক্যামেরা। অথচ, সেই মুহূর্তে ক্যামেরা স্থির থাকলে হয়তো চরিত্রদের মনের গভীরতাকে খানিক ধরা যেতে পারত।
তবে ভাল লাগে প্রসেন ও দলবলের সুরে ‘বেহায়া’ গানটির ব্যবহার। লগ্নজিতার কণ্ঠে অন্য মাত্রা পেয়েছে এই গান। ছবিতেও যেন এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়ার মতো। এ ছাড়া ছবিতে কোনও যন্ত্রানুষঙ্গ ছাড়া খালি গলায় দু’টি রবীন্দ্রসঙ্গীত- ‘মনে কি দ্বিধা’ এবং ‘অমল ধবল পালে লেগেছে’-র ব্যবহারও ভাল লাগে। কিন্তু দুর্বল কাহিনি ও চিত্রনাট্যের খামতিতেই শেষ পর্যন্ত সে ভাবে দাগ কাটল না ‘একান্নবর্তী।‘

অন্য বিষয়গুলি:

Film Review mainak bhoumik Aparajita Auddy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy