পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের চেয়ে অভিনেতা কৌশিককে অনেকেই হয়তো এগিয়ে রাখেন। ছবি: সংগৃহীত।
কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবি মানেই দর্শকের প্রত্যাশা স্বাভাবিক ভাবেই একটু বেড়ে যায়। সাদামাটা গল্পের বাইরে কিছু পাওয়ার ইচ্ছে তৈরি হয়। তাই ‘কাবেরী অন্তর্ধান’-এর ট্রেলার দেখে থ্রিলার মনে হলেও সেখানেই আভাস ছিল যে, ছবিতে রহস্য ছাড়াও আরও কিছু পাওয়া যেতে পারে। সে দিক থেকে হতাশ করেনি এই ছবি। রহস্য ছাড়াও গল্পে রয়েছে পারিবারিক ক্রাইসিস, সম্পর্কের টানাপড়েন, প্রেম, যৌবনের উন্মাদনা, নকশাল আন্দোলন ও আরও অনেক কিছু। নানা রকম উপাদান থাকলেও অনেক সময় গল্প মাঠে মারা যায়, যদি গল্পের বুনোটটা ঠিক না হয়। পরিচালক অবশ্য সে দিকটা ভালই সামলেছেন।
ছবির প্রেক্ষাপট পঁচাত্তরের অশান্ত বাংলা। তবে কলকাতা নয়, উত্তরবঙ্গের হাতিমারা। পুলিশ অফিসার মৃণ্ময় (কৌশিক সেন) তার স্ত্রী (চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায়), বোন কাবেরী (শ্রাবন্তী), বোনের বর (অম্বরীশ ভট্টাচার্য), এবং তাদের ছেলেমেয়েকে নিয়ে থাকে। গল্পের শুরুই হয় মৃণ্ময়ের খুন এবং কাবেরী উধাও হয়ে যাওয়া দিয়ে। হাতিমারায় পৌঁছয় নতুন পুলিশ অফিসার (ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত) এবং পুরনো গোয়েন্দা (কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়)। সন্দেহের তির গিয়ে পড়ে এলাকার শিল্পী অর্ঘ্যকমলের (প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়) উপর। কিন্তু অভাব প্রমাণের। কাবেরী কোথায় গেল, সেই রহস্যের কোনও রকম কিনারা পাওয়াই মুশকিল হয়ে পড়ে। দু’ভাবে গল্প এগোয়। এক বর্তমানে কী ঘটছে, এবং পাশাপাশি অতীতে কী হয়েছিল, তা সমান্তরালে দেখিয়ে। মজার বিষয় হল, বর্তমান ঘটনার দৃশ্যগুলিতে রহস্যের জট পাকে এবং অতীতের দৃশ্যগুলিতে গল্পের জট ছাড়ায়।
পরিচালক কৌশিকের একটি গল্প বলার নিজস্ব ধরন রয়েছে। তাঁর প্রত্যেকটা গল্পে যেন একটা প্রাণ থাকে। এখানেও তিনি গল্পটাকেই মূল হাতিয়ার করেছেন। তাই থ্রিলার হওয়া সত্ত্বেও টেকনিক্যাল দিকগুলির উপর গা এলিয়ে দেওয়া হয়নি। ক্যামেরার কারসাজি, আলো-আঁধারির খেলা, অহেতুক লো অ্যাঙ্গল শট, ভয়-দেখানো আবহসঙ্গীত— এ সব কিছুই ব্যবহার করা হয়নি। বরং এটা চিত্রনাট্যের গুণ, যে শুধু গল্পের মধ্যে দিয়েই সাসপেন্স বা একটা দমবন্ধ ভাব তৈরি করা গিয়েছে।
তবে সেই দমবন্ধ ভাব বা দর্শকের উৎকণ্ঠাটা শেষ পর্যন্ত একই রকম ভাবে ধরে রাখা যায়নি। ছবির প্রথমার্ধ যতটা টান টান, ছবির দ্বিতীয়ার্ধ ততটা নয়। গল্পের বাঁধন যেন একটু হলেও আলগা লাগতে পারে। তাই শেষ অবধি রহস্যের সমাধান হলেও, দর্শকের প্রত্যাশা অতিক্রম করতে পারবে কি না, বলা মুশকিল।
ছবির সবচেয়ে জোরের জায়গা অবশ্যই অভিনয়। কৌশিক সেন, শ্রাবন্তী, অম্বরীশ, এমনকি, তুলনামূলক ভাবে ছোট ভূমিকায় ইন্দ্রনীল সেনগুপ্তও জোরালো অভিনয় করেছেন। চূর্ণী এখানে অনবদ্য। তাঁর চরিত্রের নানা রকম দিক রয়েছে, যার প্রত্যেকটাই এমন ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন পর্দায়, যে হল থেকে বেরিয়েও আলাদা করে তাঁর অভিনয় মনে থেকে যাবে।
পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের চেয়ে অভিনেতা কৌশিককে অনেকেই হয়তো এগিয়ে রাখেন। এই ছবি দেখলে বোঝা যাবে তাঁদের সিদ্ধান্ত কতটা ঠিক। কৌশিক যে কত বড় মাপের অভিনেতা, তা বার বার তিনি প্রমাণ করেছেন। এই ছবির গুরুগম্ভীর গল্পের মধ্যেও যেটুকু কমিক রিলিফ পাওয়া গেল, তা সম্ভব হয়েছে একমাত্র কৌশিকের দৌলতেই।
যাঁর অভিনয়ের কথা না বললেই নয়, তিনি অবশ্যই প্রসেনজিৎ। তাঁর অভিনয় অনেকটা ভিনটেজ ওয়াইনের মতো। যত দিন যাচ্ছে, আরও স্বাদ বাড়ছে। অশান্ত সময়ের মধ্যে শান্ত হয়ে থাকা অর্ঘ্যকমল কি ছবির নায়ক? না কি খলনায়ক? উত্তর দেবেন দর্শকই। কিন্তু উত্তর যা-ই হোক, এটুকু নিশ্চিত যে এ ছবি তাঁরই। পর্দায় তাঁর উপস্থিতি যে কোনও দৃশ্যের আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে তুলেছে। এবং সেটা প্রসেনজিতের স্টারডমের দৌলতে নয়, বরং তাঁর অভিনয় গুণে।
‘কিশোর কুমার জুনিয়র’, ‘দৃষ্টিকোণ’, ‘জ্যেষ্ঠপুত্র’-এর পর ‘কাবেরী অন্তর্ধান’। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় এবং প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের যুগলবন্দি প্রত্যেক বারই খেলা জমিয়ে দেয়। এই ছবি দেখার পর যে দর্শক তাঁদের পঞ্চম পার্টনারশিপের জন্য অপেক্ষায় থাকবেন, তা নিশ্চিত ভাবে বলা যেতেই পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy