‘ত্রিভঙ্গ’ মায়েদের এই ঠিক-ভুলের সীমারেখায় দাঁড়িয়ে।
‘মেয়েরা মায়ের জাত। আর মা হলেন ঈশ্বরের রক্ত-মাংসের রূপ।’ তাই না? একদমই না। তাঁরাও মানুষ। দোষে গুণে ভরা মানুষ। তাঁদেরও জীবন আছে, ইচ্ছে আছে, ভাল থাকা আছে। সব সময় সন্তান-পরিবারের ভাল থাকাই, তাঁদের ভালো থাকার মাপকাঠি নাও হতে পারে।
খুব বেসুরো লাগছে কথাগুলো? লাগাটা স্বাভাবিক। যুগ যুগ ধরে পিতৃতন্ত্রের নির্ধারণ করে দেওয়া স্বাভাবিকত্বে, নারীস্বাধীনতা সব সময়ই ব্রাত্য। কারণ মায়েরা ভুল করতে পারেন না। তাই সমাজের চিরাচরিত স্রোতের বিপরীতে চলা মেয়েরা সমালোচনার পাত্রী। আসলে এটাই তো নিয়ম। সময়টা যাই হোক, নারীকে নিজের ভাল থাকার জন্য নিরন্তর লড়াই করে যেতেই হয়। সময়ের সঙ্গে, আধুনিকতার সঙ্গে পরিস্থিতি বদলায়, বদলে যায় সমস্যার ধরন— কিন্তু লড়াই বদলায় না। সন্তানের জীবনে সেই লড়াই প্রভাব ফেলে। মা ও সন্তানের জীবন অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে। বিশেষত সন্তানের বেড়ে ওঠা মায়ের লড়াইয়ের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে যায়। তাই এতে সন্তানের জীবন প্রভাবিত হওয়াটা স্বাভাবিক। সব সময় সেই প্রভাব প্রত্যাশিত নাও হতে পারে। মায়েরও ভুল হতে পারে। সদ্য মুক্তি পাওয়া ওয়েব-ফিল্ম ‘ত্রিভঙ্গ’ মায়েদের এই ঠিক-ভুলের সীমারেখায় দাঁড়িয়ে। এবং সেই সীমারেখা আদৌ কতটা স্পষ্ট, সে সম্পর্কেও প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় এই ছবি।
অনুর জীবনে তার মা নয়নের সব সিদ্ধান্তের প্রভাব ভাল ভাবে পড়েনি। রাষ্ট্রীয় সম্মানপ্রাপ্ত লেখিকা নয়নতারা আপ্তের সংসার থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত সমালোচনার মুখে পড়ে। তার দুই সন্তান অনুরাধা ও রবীন্দ্রর বেড়ে ওঠাও মসৃণ হয়নি। স্বাধীনচেতা নয়নের জীবনে আসা পুরুষসঙ্গীরা অনু ও রবীন্দ্রর জীবনে বদল আনে। বদলাতে থাকে মা-সন্তান সম্পর্কের রসায়ন।
‘ত্রিভঙ্গ’ ছবির একটি দৃশ্য।
ঘটনাপ্রবাহ অনু ও নয়নের সম্পর্ককে তিক্ত করে দেয়। বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী অনুও জীবনযাপন করে নিজের স্বর্তে। সন্তান মাসার ব্যাপারে কোনও রকম আপস করেনি সে। মায়ের ভুলগুলোর পুনরাবৃত্তি না করার বিষয়েও সে খুবই সচেতন। কিন্তু অনু কি সফল? তার নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো কি সত্যিই মাসার জীবনে ইতিবাচক প্রভাবিত ফেলে? ‘স্বাভাবিক’ জীবনযাপনে মাসা কি আদৌ ভাল আছে? প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে মেয়েদের তথাকথিত ভুল-ঠিকের বৃত্ত। অনু যখন এই বৃত্তটি বুঝতে পারে, তখন কেমন হয় নয়নের সঙ্গে তার সম্পর্ক? মেয়েদের জীবনপথটাই আঁকে-বাঁকে ভরপুর, ঠিক ত্রিভঙ্গের মতোই। সম্পর্কের এই টানাপোড়েন, মা-সন্তান রসায়ন, এবং নারী তথা মাকে ঈশ্বরের সিংহাসন থেকে নামিয়ে তার উপর মনুষ্যত্ব আরোপ করেছে রেণুকা সহানী পরিচালিত সিনেমাটি।
আরও পড়ুন: ত্বরিতা-সৌরভের বিয়েতে জয় হল কনেপক্ষের, মাটন কষা আর জিলিপি খেয়ে মন ভরে আছে
দীর্ঘ ১২ বছর পর পরিচালকের আসনে রেণুকা। এক সময় বড় এবং ছোটপর্দার আদর্শ বউমা ছিলেন তিনি। সেই রেণুকা যে ভাবে বাঁধাধরা নিয়মের বাইরের নারীচরিত্রগুলিকে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন, তা প্রশংসনীয়। শিশুনির্যাতন, ঘরোয়া হিংসা, বিবাহবিচ্ছেদ-সহ একাধিক সামাজিক বিষয় ছবিতে তুলে ধরা হয়েছে খুব সহজে।
আরও পড়ুন: দক্ষিণী ছবির অফারের সঙ্গে এসেছিল ‘কাস্টিং কাউচ’-এর প্রস্তাব, কী করলেন বিবৃতি?
ওয়েব-পর্দায় কাজল আত্মপ্রকাশ করলেন ‘ত্রিভঙ্গ’-র হাত ধরে। প্রত্যাশিত ভাবেই তিনি অত্যন্ত সাবলীল। তানভি আজমি, মিথিলা পালকার, কুণাল রায় কপূর, বৈভব তাতওয়াদি-সহ অন্যান্যরাও যথাযথ। তবে মিথিলা পালকারের মতো অভিনেত্রীকে আরও কিছু সময় দেখা ভালো হত। ‘ত্রিভঙ্গ’ ছবিতে কোনও গান নেই, কিন্তু আবহসঙ্গীত গল্পের মেজাজকে সঙ্গ দিয়েছে। সিনেমাটোগ্রাফি সংযত, ছিমছিম। অজয় দেবগণ প্রযোজিত নেটফ্লিক্সের ছবিটি সুন্দর এবং ছিমছাম।
ওয়েব-পর্দায় কাজল আত্মপ্রকাশ করলেন ‘ত্রিভঙ্গ’-র হাত ধরে।
বইয়ের পাতার সত্য-সুবর্ণ-বকুলই যেন ওয়েব-পর্দার নয়ন-অনু-মাসা হয়ে উঠেছে। ভাল-মন্দর সীমারেখায় দাঁড়িয়ে থাকা নারীস্বাধীনতার প্রশ্নগুলোকেই তারা আবার জলজ্যান্ত ভাবে তুলে ধরছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy