Advertisement
E-Paper

কেমন হল জাফর পানাহির সাম্প্রতিকতম ছবি ‘নো বেয়ার্স’? জানাচ্ছে আনন্দবাজার অনলাইন

রাষ্ট্রশক্তি যত জোর করে অবরুদ্ধ করবে পানাহির কণ্ঠ, ততই জোরালো হবে তাঁর কথা। তাঁর নতুন ছবি প্রদর্শিত হল এ বারের কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে।

পানাহির ছবি মানেই খাপখোলা তলোয়ার।

পানাহির ছবি মানেই খাপখোলা তলোয়ার। ছবি: সংগৃহীত।

শতরূপা বসু

শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০২২ ২০:৫৮
Share
Save

চলতি বছরের জুলাই মাসে জাফর পানাহিকে জেলবন্দি করে ইরান সরকার। ২০১০ সালে তাঁকে ৬ বছরের কারাবাসের সাজা দেওয়া হয়েছিল। সে সময়ে তাঁকে অবশ্য ছেড়ে দেওয়া হয় কিছু শর্তে। তিনি ঘরবন্দি থাকবেন, ইরানের বাইরে বেরোতে পারবেন না এবং সিনেমা বানাতে পারবেন না। কিন্তু এ বার আর ছাড় নেই। সেই ছ’বছরের কারাবাস এ বার তাঁকে কাটাতে হবে বলে জানিয়ে দিয়েছেন কর্তৃপক্ষ।

যত দিন পানাহি ঘরবন্দি ছিলেন, তত দিন নানা রকম বিধিনিষেধ ছিল তাঁর উপর। কিন্তু তাঁর মতো শিল্পীকে কি ধমকে, ভয় দেখিয়ে মুখ বন্ধ করিয়ে রাখা যায়? তাই ছবি করা থামাননি তিনি। তাঁর সাম্প্রতিকতম ছবি ‘নো বেয়ার্স’-এর একাংশের শুট হয়েছে তুরস্কে। এবং সেটা তিনি বানিয়েছেন ইরানে বসেই!

অথবা বলা ভাল, তুরস্কের এক কাঁটাতারের বেড়ার ধারে (বর্ডার) বসে। ছবিতে জাফর নিজেও একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে আছেন— নিজের চরিত্রে। এক পরিচালক যিনি রিমোটলি বসে মানে ইন্টারনেটের সাহায্যে ভিডিয়ো কলের মাধ্যমে অনেক দূরে বসে এক দম্পতিকে নিয়ে তথ্যচিত্র তৈরি করছেন। তেহরান থেকে শ্যুটিং করলে তিনি ইন্টারনেটের সিগন্যাল অনেক ভাল ভাবে পেতেন। কিন্তু পানাহি কাঁটাতারের ধারের এই গ্রামকেই বেছেছেন। কারণ, এখান থেকে তাঁর ‘অভিনেতা-অভিনেত্রীরা’ কিছুটা কম দূরত্বে রয়েছেন।

ছবিতে দুটি ভিন্ন প্রেমের কাহিনি সমান্তরাল ভাবে এগিয়েছে। দুটি ভিন্ন আখ্যানে। একটি হল যাদের নিয়ে শ্যুটিং হচ্ছে সেই চরিত্ররা— জ়ারা আর বখতিয়ার। জ়ারা আর বখতিয়ার ইরান থেকে পালিয়ে ইওরোপ যেতে চায়। একটি সুস্থ, সুন্দর জীবনের উদ্দেশ্যে। কিন্তু মুশকিল হল, শুধু জ়ারার পাসপোর্ট মিলেছে। তা হলে জ়ারা কী করবে? তাদের একসঙ্গে থাকার স্বপ্ন কি অকালেই ফুরিয়ে যাবে?

অন্য আখ্যানটি পানাহি যেখানে রয়েছেন, সেখানকার ঘটনা। পানাহি যে গ্রামে থেকে ছবি বানাচ্ছে, সেই গ্রামের দুই যুবক এক যুবতীকে বিয়ে করতে চায়। এদের এক জনের সঙ্গে যুবতীর প্রেমের সম্পর্ক। গ্রামের মানুষের ধারণা, পানাহি সেই যুবকের সঙ্গে যুবতীর ছবি তুলেছেন। তারা ছবিটি ফেরত চায়। পানাহি অবশ্য তেমন কোনও ছবির কথা অস্বীকার করেন। গ্রামবাসীরা দবি করে, তা হলে জাফরকে ঈশ্বরের কাছে ‘কনফেস’ করতে হবে যে, সে এ রকম কোনও ছবি তোলেনি। তা হলেই ঝামেলা মিটে যাবে!

এক দিকে শহর বনাম গ্রাম। অন্য দিকে, কুসংস্কার বনাম সত্য— পরিচালক সুনিপুণ ভাবে সংলাপ এবং ঘটনাবলির মাধ্যমে তুলে ধরেন এই দ্বন্দ্বগুলি। তার সঙ্গে নিজে একটি চরিত্র হয়ে, নিজের দিকে আয়না ঘুরিয়ে তিনি এক জন স্বাধীন ফিল্মমেকারের উপর রাষ্ট্রের চাপানো নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে নিদারুণ লড়াইয়ের ছবিটিও তুলে ধরেন।

ছবির একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে ভয়। কুসংস্কারের ভয়, প্রাচীন সংস্কার লঙ্ঘন করার ভয়, ধর্মের ভয়, রাষ্ট্রের ভয়। যা জীবনকে অবশ করে স্বাধীন ভাবে পাখা মেলতে দেয় না। এক গ্রামবাসী পানাহিকে বলে, ‘‘ও দিকে একা যেয়ো না। ভালুকে ধরবে।’’ তার পর বলে, ‘‘আসলে ভালুক-টালুক কিছু নেই। আমাদের কুসংস্কার। যা দিয়ে আমাদের ভয় দেখানো হয়।’’

ছবি দেখতে দেখতে দমবন্ধ হয়ে আসে। ছবি জুড়ে শুধু বাধা আর বাধা। ছবির আবহাওয়া পানাহির অভিজ্ঞতার মতোই গুমোট। এবং সব বাধারই উপসংহার বড় বেদনায় উপনীত হয়।

 ছবির আবহাওয়া পানাহির অভিজ্ঞতার মতোই গুমোট। এবং সব বাধারই উপসংহার বড় বেদনায় উপনীত হয়।

ছবির আবহাওয়া পানাহির অভিজ্ঞতার মতোই গুমোট। এবং সব বাধারই উপসংহার বড় বেদনায় উপনীত হয়। ছবি: সংগৃহীত।

একেবারে অন্তরঙ্গ আলাপচারিতা এবং সংলাপ ছবির শক্তি। একটি দৃশ্য মনে রাখার মতো। যেখানে পানাহির ছবির সহ-পরিচালক রেজ়া পানাহিকে নিয়ে যাচ্ছে একটি ‘অন্য’ রাস্তায়। সে রাস্তা চোরাচালানকারীদের রাস্তা। সেই পথে নিশুতি রাতে, প্রায় চোরের মতো, এক জন বিশ্ববরেণ্য পরিচালক যাচ্ছেন শুটিং স্পট ঠিক করতে। গাড়ির হেডলাইটে উদ্ভাসিত সেই ধূসর, পাথরমোড়া পথ বড় মায়াবী ঠেকে বড় পর্দায়।

‘নো বেয়ার্স’ দেখতে দেখতে জাফর পানাহির ‘ট্যাক্সি’-র কথা মনে পড়ে। সেখানেও তিনি একটা ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। ট্যাক্সির চালক তিনি নিজে। বিনা পয়সায় যাত্রী তুলে তাঁদের গল্প শোনাই ছিল পানাহির কাজ। আর ট্যাক্সির ড্যাশবোর্ডে লাগানো ছিল ক্যামেরা। তাই দিয়ে পুরো ছবিটা তুলেছিলেন। সেখানেও ছিল যাত্রীদের সঙ্গে পানাহির এ রকম অন্তরঙ্গ কথোপোকথন।

ফিকশন আর নন ফিকশনকে এমন ভাবে মিলিয়েছেন পরিচালক, কোনটা গল্প কোনটা বাস্তব, বোঝাই দায়। ঘরে বসে সামান্য ল্যাপটপের ক্যামেরায় চোখ রেখে, একদম সাদামাঠা শট নিয়ে কী করে অসামান্য ছবি বানাতে হয় তা দেখিয়ে দিয়েছেন পানাহি। সম্ভবত তাঁর কেরিয়ারের অন্যতম সেরা কাজ ‘নো বেয়ার্স’। এ ছবির চিত্রনাট্যে অন্তত দু’বার দেখা যায়, তাঁর কাছে রাস্তা থাকা সত্ত্বেও তিনি বর্ডার পেরিয়ে তুরস্ক যাচ্ছেন না। নিজের দেশেই থাকছেন। দর্শক ভাবতে বাধ্য হবেন, এটা ছবির চিত্রনাট্য, না কি পানাহির কঠিন বাস্তব?

পানাহির ছবি মানেই খাপখোলা তলোয়ার। এবং যে হেতু ছবিটি জাফর পানাহির, তাই অবশ্যই শেষমেশ জেতে রাষ্ট্রশক্তিই। সেখানে মনুষ্যত্ব বড় অসহায়। আসলে যত রাষ্ট্রশক্তি জাফর পানাহির মতো পরিচালকের কণ্ঠ জোর করে অবরুদ্ধ করার চেষ্টা করবে, যত কারাবন্দি করবে, তত এই পরিচালকের কণ্ঠস্বর জোরালো হবে। তত তিনি বলবেন, ‘‘হাল ছেড়ো না বন্ধু, বরং কণ্ঠ ছাড়ো জোরে...’’।

Film Review Review KIFF2022

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।