‘ওপেনহাইমার’ ছবির পোস্টার। ছবি: সংগৃহীত।
বিশ্ব জুড়ে ওটিটিমুখী হচ্ছেন দর্শক। সিনেমাহলে না গিয়ে বাড়ি বসেই সব বিনোদন হাতের মুঠোয়। কম্পিউটারে তৈরি গ্রাফিক্স (সিজিআই) তো ছিলই, এখন আবার তাড়া করছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স)। সিনেমা ধুঁকছে। বলিউড থেকে টলিউড, সর্বত্রই এক আর্জি— সিনেমার পাশে দাঁড়াও। হলিউডে চলছে ধর্মঘট। সাধারণ দর্শকও বাড়িতে পপকর্ন বানিয়ে সোফায় চাদর মুড়ি দিয়ে ওটিটি-তে যা পাওয়া যায় গিলছেন। এরই মাঝে এক জন পরিচালক মন দিয়ে নিজের কাজ করে যাচ্ছেন। সিনেমাকে বাঁচিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ডিজিটালকে নাকচ করে অ্যানালগ ফিল্মে শুট করছেন। ওটিটি-তে নিজের কোনও ছবি যাতে মুক্তি না পায়, তার জন্য প্রতিনিয়ত লড়ে যাচ্ছেন। সিজিআই-কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বিশাল আইম্যাক্স ক্যামেরায় শুটিং করছেন। এবং দিনের শেষে দর্শককে মন থেকে ১০০ শতাংশ সততার সঙ্গে সুন্দর গল্প উপহার দিচ্ছেন। তিনি ক্রিস্টোফার নোলান। তাঁর নতুন ছবি ‘ওপেনহাইমার’ ফের এক বার প্রমাণ করল, পরিস্থিতি যতই শোচনীয় হয়ে যাক না কেন, সিনেমা এখনও বেঁচে আছে। মার্টিন স্করসেসিও হয়তো এই ছবি দেখার পর সে কথা মেনে নেবেন।
নোলান যে এই সময়ের অন্যতম সেরা পরিচালক, তা নিয়ে সিনেপ্রেমীদের মধ্যে কোনও দ্বিমত নেই। তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান। বলা যায়, একটু বেশিই। ‘ব্যাটম্যান ট্রিলজি’ বাদ দিয়ে তাঁর সব ছবিই যেন একটু বেশি বুদ্ধি খাটিয়ে দেখতে হয়। সাধারণ দর্শকের একটি বড় অংশের অন্তত তেমনটাই অভিযোগ। অনেকে বলেন, মাথার উপর দিয়ে গেল, আবার অনেকে বলেন তাঁর সিনেমা দু-তিন বার না দেখলে বোঝার উপায় নেই। ‘ওপেনহাইমার’ কিন্তু সেই ‘কঠিন’ ফিল্মোগ্রাফিতে জায়গা পাবে না। পরমাণু বোমার ‘জনক’ রবার্ট ওপেনহাইমারের পুলিৎজ়ারপ্রাপ্ত বায়োগ্রাফি ‘আমেরিকান প্রমেথিউয়াস’-এর (কাই বার্ড এবং মার্টিন শেরউইনের কলমে) ভিত্তিতে নোলান তাঁর চিত্রনাট্য তৈরি করেছেন। আদ্যোপান্ত ঐতিহাসিক বায়োপিক এই ছবি। তুলনামূলক ভাবে সহজ কায়দাতেই গল্প বলা। তবে এক বার দেখলেই সব ধরতে পারবেন, তা ভেবে ভুল করবেন না। তিন ঘণ্টার ছবিতে প্রতি মুহূর্তে এত কিছু ঘটবে যে, কিছু না কিছু মিস্ হতে বাধ্য। হতেই পারে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ কোনও মুহূর্ত ধরাই গেল না। তার মূল কারণও অবশ্য নোলানের পরিচালনার ধরন। তিনি ইতিহাসের পাতা থেকে সকলের চেনা বেশ কিছু ঘটনা তুলে ধরেছেন। সবটা জানা, তা-ও যেন ছবিটিকে একটি টানটান থ্রিলারের আওতায় ফেলে দেওয়া যায়! ছবিতে এত অস্কারজয়ী অভিনেতার ক্যামিয়ো রয়েছে যে, মনে হবে গোটা হলিউড একত্র হয়েছে। কেউ হয়তো এসেছেন পুরনো বন্ধুত্বের খাতিরে। বাকিরা বোধহয় তাঁদের ফিল্মোগ্রাফিতে অন্তত একটি নোলানের ছবি যোগ করার লোভে দু-তিনটি দৃশ্যে মুখ দেখাতেই হাজির হয়েছেন। তবে নোলান তাঁদের কাউকেই তারকাসুলভ ফ্রেম দেননি। বরং ক্যামেরা তাঁদের সাধারণ মানুষের মতোই তুলে ধরেছে। একটি গোটা দৃশ্যে (যা বেশ লম্বা) ক্যামেরা কিলিয়ান মার্ফির উপরেই ফোকাস করে। ব্যাকগ্রাউন্ডে চুপচাপ বসে থাকেন এমিলি ব্লান্টের মতো দক্ষ অভিনেত্রী। অনেকে হয়তো বহু ক্ষণ পর্যন্ত বুঝতেও পারবেন না, তিনি রয়েছেন। অবশেষে যখন দৃশ্যের প্রয়োজন পড়ে, তখন ক্যামেরা ঘুরে যায় এমিলির উপর। এমন বহু উদাহরণ গোটা ছবি জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে।
যুদ্ধ, প্রযুক্তি, বিজ্ঞানের ক্ষতিকর দিকগুলি বহু দিন ধরেই নোলানের ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এই ছবিতেও তাই। আমেরিকার ‘ম্যানহ্যাটন প্রোজেক্ট’-এর ‘ট্রিনিটি’ পরীক্ষা ছবির অন্যতম মূল আকর্ষণ। যে ঘটনা মানবজাতির ইতিহাসের পথ বদলে দিয়েছিল, তাকে এক বিন্দুও মহিমান্বিত না করে কী ভাবে ‘স্পেক্টাকল’ তৈরি করতে হয়, তা নোলানের কাছে শেখার মতো। আজকাল যে কোনও বড় বাজেটের ছবির সিংহভাগই নিয়ে যায় সিজিআই। কোন ছবি ভিএফএক্স-এর মান কত উন্নত বা কত হাস্যকর, তা সিনেমার সমালোচনার গুরুত্বপূর্ণ দিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ ২০২৩ সালে এক জন পরিচালক পরমাণু বিস্ফোরণ নিয়ে ছবি বানিয়েও বার বার দাবি করছেন, ছবিতে কোনও রকম সিজিআই ব্যবহার করা হয়নি! তা যদি সত্যি হয়, তা হলে চিত্রগ্রাহক হোয়টে ভ্যান হোয়টেমা-এর এই ছবির জন্য অস্কার মনোনয়ন, এবং সম্ভবত পুরস্কারও পাকা। যখন দর্শক বুঝতে পারবেন, পর্দায় যা যা হচ্ছে, তা সব সত্যি, কোনও রকম গ্রাফিক্সের ভেলকি নেই, তখন গায়ে কাঁটা দিতে বাধ্য।
নোলান অবশ্য বরাবরই সিনেমার জোর যাচাই করেছেন দর্শকের মনস্তাত্ত্বিক দিক নিয়ে খেলা করে। হিরোশিমা-নাগাসাকির বিস্ফোরণের কোনও রকম ফুটেজ ছবিতে ব্যবহার করেননি পরিচালক। তা সত্ত্বেও পরমাণু বিস্ফোরণের আতঙ্ক দর্শক পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পেরেছেন সফল ভাবে। বিস্ফোরণের পর ওপেনহাইমারের বক্তৃতা এবং তাঁর সহকর্মীদের উল্লাস যে ভাবে পর্দায় তুলে ধরেন পরিচালক, তাতে দর্শকাসনে বসে দমবন্ধ হয়ে আসবে সকলের। এবং সেই অনুভূতি ছবি জুড়ে একাধিক দৃশ্যে তাড়া করে বেড়াবে দর্শকদের। গবেষণা এবং আবিষ্কার বিজ্ঞানের। কিন্তু আবিষ্কার হয়ে গেলেই তা রাষ্ট্রের। কী ভাবে সেই আবিষ্কার কাজে লাগানো হচ্ছে, তা খুব কমই গবেষকদের হাতে থাকে। তা বলে কি বিজ্ঞান দায় এড়িয়ে যেতে পারে? এই প্রশ্ন বার বার তুলেছেন নোলান। তাই বায়োপিক, ওয়ার ড্রামা, সব ছাপিয়ে এই নৈতিক প্রশ্নগুলি যেন ছবির মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিন ঘণ্টার ছবিতে রুদ্ধশ্বাস গতি আনতে চাইলে প্রয়োজন ভাল অভিনয়ের। নোলানের অবশ্য সেই ভান্ডার বরাবরই ভর্তি থাকে। পাঁচটি ছবিতে কাজ করার পর অবশেষে পরিচালকের কোনও ছবিতে মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছেন কিলিয়ান মার্ফি। তাই নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। প্রস্তুতিতে যে কোনও অংশে ত্রুটি রাখেননি, তা বহু সাক্ষাৎকারে বলেছেন। ওপেনহাইমার গীতা পড়ে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাই কিলিয়ানও পড়ে ফেলেছেন। গীতার পঙ্ক্তির ইংরেজি সংস্করণ ‘আই অ্যাম বিকাম দ্য ডেথ, দ্য ডেস্ট্রয়ার অফ দ্য ওয়ার্ল্ডস’ এখন পশ্চিমি দুনিয়ায়ও মুখে মুখে ঘুরছে। ওপেনহাইমারের মতো রোগা হতে দিনে একটি করে কাঠবাদাম খেয়েও থেকেছেন কিলিয়ান। এবং পর্দায় নিজের সবটা দিয়ে অভিনয় করেছেন। চোখেমুখে, শরীরী ভাষায়, প্রত্যেকটি দৃশ্যে প্রত্যেকটি মুহূর্তে কিলিয়ান এগিয়ে গিয়েছেন সেরা অভিনেতার জন্য অস্কার মনোনয়নের দিকে! তাঁর আগের কোনও ছবির সঙ্গে এই ছবির অভিনয় মেলানো যায় না।
ম্যাট ডেমন, কেসি অ্যাফ্লেক, রামি মালিক, গ্যারি ওল্ডম্যান— তারকাদের নামের তালিকা দীর্ঘ। অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের ভূমিকায় টম কন্টি টুকরো কিছু দৃশ্যেই মন ছুঁয়ে গিয়েছেন। ছবির কিছু সেরা কথোপকথন ওপেনহাইমার এবং আইনস্টাইনের মধ্যে হয়। তবে দর্শকের বহু দিন মনে থেকে যাবে লিউয়িস স্ট্রসের ভূমিকায় রবার্ট ডাউনি জুনিয়রের অভিনয়। যাঁরা অনেক টাকা খরচ করে আইম্যাক্স হলের টিকিট কেটেছেন, তাঁরা রবার্ট ডাউনির অভিনয় দেখেই সেই টাকা উসুল করে নিতে পারবেন! জটিল চরিত্র পেয়ে তিনি এতটাই নিষ্ঠাভরে অভিনয় করেছেন যে, ছবি দেখার সময় দর্শক ভুল যাবেন, একই অভিনেতা এত বছর ধরে ‘আয়রনম্যান’-এর মতো একটি বৈগ্রহিক চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
নোলানের অনেক ছবিতে নারীচরিত্রগুলি সে ভাবে জায়গা পায় না। দুর্ভাগ্যবশত এই ছবিও তেমনই। জিন ট্যাটলকের (ওপেনহাইমারের বামপন্থী প্রেমিকা) ভূমিকায় ফ্লোরেন্স পিউ এবং কিটির (ওপেনহাইমারের স্ত্রী) ভূমিকায় এমিলি ব্লান্ট পর্দায় খুব বেশি সময় পাননি। কিন্তু এমিলি সেই অল্প ক্ষণের দৃশ্যেই অভিনেত্রী হিসাবে নিজের জাত চিনিয়েছেন।
একটি ছবির সব বিভাগ যদি সমান দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে, তা হলে সিনেমা কোন উচ্চতায় পৌঁছতে পারে, তা প্রমাণ করে ‘ওপেনহাইমার’। অভিনয়, ক্যামেরা, চিত্রনাট্য ছাড়াও সাউন্ড ডিজ়াইন আর সম্পাদনার কথা না বললেই নয়। গোটা ছবিতে দর্শকের কখন কী অনুভূতি হওয়া উচিত, যেন তার দিশা দেখায় ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর। লুডউইগ গোরানসনও হয়তো অস্কার মনোনয়ন পেয়ে যাবেন এই ছবির সঙ্গীত ভাবনার জন্য। তিন ঘণ্টার ছবি যদি আড়াই ঘণ্টার মনে হয়, তা হলে সম্পাদনার তারিফ না করে পারা যায় না। গোটা গল্পটি বলা হয়েছে দু’টি আইনি শুনানির মাধ্যমে। একটি ১৯৪৯ সালের ‘কুখ্যাত’ ওপেনহাইমার সিকিউরিটি হিয়ারিং। অন্যটি ১৯৫৮ সালে। আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইসেনহওয়ার যখন সেক্রেটারি অফ কমার্স পদের জন্য স্ট্রসের নাম নির্বাচন করেছিলেন, কংগ্রেসের অনেকেই তার বিরোধিতা করেন। ব্যক্তিগত আক্রোশের জেরে ওপেনহাইমারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে সেনেটের শুনানি প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই দু’টি শুনানির দৃশ্যগুলি সমান্তরাল ভাবে চলতে থাকে ছবিতে। একটি অংশ সাদা-কালোয় শুট করা। জেনিফার লেমের সম্পাদনার গুণে ছবির কোনও অংশই একঘেয়ে মনে হবে না।
ওপেনহাইমার বেশ বিতর্কিত চরিত্র। এক দেশের নায়ক অন্য দেশের খলনায়ক হয়ে উঠতেই পারেন। কিন্তু রাজনীতির প্যাঁচে পড়ে দেশের হিরোই কখন কী ভাবে ভিলেন হয়ে যান, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ ওপেনহাইমার। মানবজাতির ধ্বংসের অস্ত্র যিনি মানুষের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, তাঁকে ইতিহাস কখনও কি ক্ষমা করতে পারবে? অথচ এই ছবি দেখলে ওপেনহাইমারের জন্য করুণা হবে দর্শকের। এক জন জিনিয়াস কী করে আশপাশের জগতের আসল চিত্রটি ধরতে পারলেন না, তা সত্যিই অবাক করার মতো।
‘ওপেনহাইমার’ দেখার পরাবাস্তব অভিজ্ঞতা তিন ঘণ্টার শেষে অনেক ক্ষণ দর্শকের মনে থেকে যাবে। বিশেষ করে দর্শক যদি হন বাঙালি! যে রাজ্যে ৩৪ বছরের বামরাজত্ব চলেছে, যেখানকার ‘পপুলার কালচার’-এ এখনও নকশাল আন্দোলনকে রোম্যান্টিসাইজ় করা হয়, সেখানে কত জন আমেরিকার ‘ম্যাককার্থিসিজ়ম’-এর সঙ্গে পরিচিত? বামপন্থী চিন্তাধারা থাকা যে দেশদ্রোহী হওয়ার সমতুল্য, তা কত জন হজম করতে পারবেন? অবশ্য যাঁরা নারায়ণ সান্যালের বিশ্বাসঘাতক পড়েছেন, তাঁদের অনেক ঘটনাই জানা। ইতিহাস আসলে অনেক কিছু শেখায়।
হয়তো তাই বারে বারে সেই ইতিহাস বদলের চেষ্টা করা হয়। নোলানের কেরিয়ারে এই ছবি অবশ্যই তাঁর সেরা কাজের তালিকায় উঁচুতে জায়গা করে নেবে। তবে তিনি তাঁর ছবির মাধ্যমে, গল্প বলার ধরনে, যে পাঠগুলি চোখে আঙুল দিয়ে শেখানোর চেষ্টা করছেন, সেগুলি সিনেমার ইতিহাস কত দিন মনে রাখবে, সেটাই আলোচ্য বিষয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy