Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Hawa Review

‘হাওয়া’য় উত্তাল নন্দন! কিন্তু কী দিল আর কী দিল না এই বহুপ্রতীক্ষিত ছবি?

অনন্ত সমুদ্র আর একটি মাছ ধরা নৌকা। কয়েক জন পুরুষ আর এক রহস্যময়ী নারী। কামনা-বাসনা-লাস্য ছাড়িয়ে সত্যি-মিথ্যের কানামাছি খেলায় ডুবল-ভাসল কলকাতা।

‘হাওয়া’ ছবির একটি দৃশ্যে অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী।

‘হাওয়া’ ছবির একটি দৃশ্যে অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত।

ইন্দ্রদত্তা বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০২২ ১৭:২৭
Share: Save:

শোয়ের সময় সন্ধে ৬টা। অথচ বিকেল সাড়ে তিনটেতেই নন্দনে ঢোকার লাইন ছাড়িয়ে গিয়েছে শিশির মঞ্চের গেট। দুপুর ১টার শোয়ের ক্ষেত্রেও একই রকম ভিড়, উন্মাদনা। বিগত কয়েক দিন ধরেই নেটদুনিয়ায় কথা ঘুরছিল— ‘হাওয়া বইবে কলকাতায়’। অনেক মানুষ আগ্রহ দেখিয়েছিলেন, জানতে চেয়েছেন কী ভাবে দেখা যেতে পারে এই ছবি। উদ্‌গ্রীব দর্শকের ঢল সামলাতে গিয়ে হিমসিম পুলিশ, সিকিউরিটি গার্ড, ছবি শুরু হতে হতে সাড়ে ছ’টা। অনেক ক্ষণের অপেক্ষার পর যখন আলো নিভল হলে, নন্দন ফেটে পড়ছে সমস্বর উল্লাসে। এই উল্লাসের বহর অবশ্য চলল গোটা ছবি জুড়েই, একাধিক সংলাপে হাসির কলরোল, সিটি, হাততালি কিছুই বাকি থাকেনি। কোনও চলচ্চিত্র উৎসবে নন্দনে এমন অভিজ্ঞতা অচেনা বললেও অত্যুক্তি হবে না। কিন্তু এই পরিমাণ উল্লাসের কতটুকু প্রাপ্য ‘হাওয়া’ ছবির?

মেজবাউর রহমান সুমনের প্রথম ছবি ‘হাওয়া’। পোস্টার, ট্রেলার, প্রচার— সব কিছুই ইঙ্গিত দিয়েছিল একটি টানটান থ্রিলারের। অভিনয়ে তারকাখচিত সব নাম। ক্যামেরা ও সিনেমাটোগ্রাফি যে নজরকাড়া হতে চলেছে, তার ঝলক মিলেছিল ট্রেলারেই। এ ছাড়া ছবির গান ‘সাদা সাদা কালা কালা’র জনপ্রিয়তাও দেশের গণ্ডি পেরিয়ে গত কয়েক মাস যাবৎ আপামর বাঙালির মুখে মুখে। তবে দু’ঘণ্টা দশ মিনিট জুড়ে পর্দায় মুগ্ধ হওয়ার মতো দৃশ্য ও ফ্রেম যেমন মিলল, তেমন দুর্বলতাও চোখে পড়ল বিস্তর। একাধিক বুদ্ধিদীপ্ত সিনেম্যাটিক সম্ভাবনা তৈরি করে নিজেই ভেঙে দিল ‘হাওয়া’।

দর্শকের ছবি দেখার অভ্যস্ত চোখকে সামান্য ধাক্কা দিয়েই শুরু হয় সুমনের ছবি। ‘হাওয়া’ শুরু হয় অসম্ভব ঝাঁকুনি দিয়ে। প্রথমেই পর পর কয়েকটি শটে ক্যামেরা দ্রুত গতিতে প্যান করতে‌ থাকে। একাধিক মানুষের অস্বাভাবিক ক্লোজ-আপের ছেঁড়া ছেঁড়া ইমেজ, মাছ কেনাবেচার ঝটিতি কিছু ফ্রেম, কখনও আবার ক্যামেরায় নীল সাগর, বিশাল আকাশে পাখি উড়ে যাওয়ার দৃশ্য, এবং এ সবের সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ত জনতার কোলাহল: প্রথম দুই-তিন মিনিটে দর্শক যখন ভেবে কূল পাবেন না কী হচ্ছে, তত ক্ষণে নৌকা ছেড়ে দিয়েছে মাঝদরিয়ার উদ্দেশে। নন্দনের বিরাট পর্দা জুড়ে তখন ড্রোন শটে অনন্ত সমুদ্র ও তার মাঝে একটি নৌকা। পর্দায় ভেসে উঠছে ছবির নাম।

‘হাওয়া’ ছবির একটি দৃশ্যে নাজিফা তুষি।

‘হাওয়া’ ছবির একটি দৃশ্যে নাজিফা তুষি। ছবি: সংগৃহীত।

এর পর ছবি ধীরে ধীরে পরিচয় করায় জেলেদের সঙ্গে। অনেক আশা নিয়ে তারা সমুদ্রে বেরিয়েছে মাছ ধরতে। এরাই ছবির মূল চরিত্র, গল্পের চালক। চান হল নৌকার ক্যাপ্টেন। বাকি সকলে— উর্কেস, পার্কেস, নাগু, মোরা, ফনি, এজা— সবাই চানের কথামতো চলে। কেবল থেকে থেকে বেঁকে বসে টাকার সমান ভাগ চাওয়া ইঞ্জিনঘরের দায়িত্বপ্রাপ্ত ইবা‌। তবে চান ক্ষুরধার। বাকি সকলকে বুঝিয়ে ইবাকে সে দাবিয়ে রাখতে পারে সহজেই। গল্পের মোড় ঘোরে এক রাতে জালে এক যুবতী ধরা পড়ার পর। সেই মেয়ে কথাও বলে না, উত্তরও দেয় না। বোটে মেয়েদের থাকার নিয়ম নেই। নৌকাবোঝাই পুরুষ মাঝিমাল্লাদের মধ্যে হঠাৎ এক জলজ্যান্ত নারীর উপস্থিতি এক নতুন উপদ্রব। তবে নাম-পরিচয়হীন এই যুবতীর আকস্মিক আগমন তার চেয়েও বেশি রহস্যের। বস্তুত, এখান থেকেই দানা বাঁধে ছবির মূল রহস্য, যা ছবি এগোনোর সমান্তরালে খানিক অলৌকিকতার দিকে যাত্রা করে। সঙ্গে আসে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের অতীত এক জগৎ।

প্রাথমিক পর্ব জুড়ে মূল যে ভাষ্য বার বার উঠে আসে সেখানে রহস্য কম, যৌন উৎকণ্ঠা বেশি। সামগ্রিক ভাবে একটি পুরুষ পরিসরে হঠাৎ এই যুবতীর আবির্ভাব পরবর্তী চাপান-উতোরের উৎস। কারণ, প্রায় সকলেই চায় তার শরীর। তার নিছক অস্তিত্বটুকুও বোঝা হয়ে দাঁড়ায়, পুরুষের দৃষ্টিতে সে কেবল সম্ভোগের বস্তুমাত্র। যে কোনও পুরুষ-শাসিত পরিসরেই একটি মহিলার এই যে উদ্বেগ ও অস্বস্তি তা বিভিন্ন দৃশ্যে ‘হাওয়া’ ধরে রাখে সযত্নে। যুবতীর মুখে কোনও সংলাপ না থাকায় তার ভাবপ্রকাশের ভাষা অনেকটাই শারীরিক— সে হাত-পা নেড়ে, মুখ-চোখের অঙ্গভঙ্গি করে জানায় মনের ভাব, নিজের জন্য সে সৃষ্টি করে নেয় এক স্বকীয় ভাষা, যা পুরুষের বোধগম্যতার বাইরে। অসহায় চান কবুল করে যে, সে কিছুই বুঝতে পারছে না তার কথার মানে। এ পর্যন্ত ‘হাওয়া’ পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক চমৎকার রাজনৈতিক সমালোচনার ভাষ্য তৈরি করে, যা চিরাচরিত ধারার বাইরে। কেবল বিবিধ ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল দিয়ে পুরুষের বাসনা-লালিত উগ্র দৃষ্টির প্রতি দর্শককে সচেতন করেই ‘হাওয়া’ থেমে থাকে না, এই ছবি নিয়ে আসে ভাষা সংক্রান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। সমাজ-স্বীকৃত যে ভাষায় আমরা কথা বলি, বিনিময় করি মনের ভাব, তা পুরুষ-নির্মিত, পুরুষের জন্যই ব্যবহৃত। নারীর নিজস্ব অভিজ্ঞতার প্রকাশ এই ভাষায় কতটা সম্ভব বহু বছর ধরে মানবীচেতনাবাদীরা এই প্রশ্ন তুলে আসছেন শিল্পে ও সাহিত্যে। ‘হাওয়া’ তার সেই প্রশ্নকে নিয়ে আসে পর্দায়। তৈরি হয় এক নতুন সম্ভাবনা। অথচ, সেই সম্ভাবনাকে এই ছবি নিজেই ধ্বংস করে।

কিছু ক্ষণের মধ্যেই যুবতীর মুখে সংলাপ আসে, জানা যায় তার নাম গুলতি, পরিচয় বেদেনি। জলের মধ্যে গলা অবধি ডুবে রাতের আঁধারে সে ইবাকে জানায়, নৌকা ডুবোতে তার আবির্ভাব। দেবীর নির্দেশ। এর পর একে একে নৌকায় অনিষ্ট— জালে মাছ না পাওয়া, ইঞ্জিন খারাপ, তেলের ট্যাঙ্ক ফুটো— এমন অনেক আশ্চর্য ঘটনা পর পর ঘটে যেতে থাকে। রহস্যও মূলত দ্বিতীয় পর্বে ঘনীভূত হয় ক্রমাগত অস্বাভাবিক কিছু ঘটনার ধারাবাহিকতায়। গতি বাড়ে দ্বিতীয়ার্ধেই। ছবি দেখতে দেখতে দর্শকের কখনও মনে পড়বে স্যামুয়েল টেলর কোলরিজের বিখ্যাত ‘রাইম অব দি এনশিয়েন্ট মেরিনার’-এর কথা, বিশেষ করে নৌকার শালিক পাখিটিকে যখন শেষের দিকে উন্মাদপ্রায় চান মেরে ফেলে, তখন অ্যালবাট্রসের কথা মনে আসে। ছবির শেষ আবার মিলিয়ে দেয় বেহুলা-লখিন্দরের গল্পের সঙ্গে, ‘চান’ নামটির সঙ্গেও অদ্ভুত মিল মনসামঙ্গলের চাঁদের।

গল্পটি আরও অনেক শাণিত ও বুদ্ধিদীপ্ত হতে পারত যদি শেষ পর্যন্ত ভিতরের গল্প উন্মোচন করে কার্য-কারণ ব্যাখ্যা করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারত। গোটা ছবি জুড়েই যদি গুলতি নির্বাক থাকত, তা হলে দু’দিক থেকে বহুমাত্রিকতা লাভ করত ‘হাওয়া’। গুলতির শরীরী বিভঙ্গের প্রতি ছবির চরিত্ররা যত বার তির্যক ও ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করেছে, রসিকতায় মজেছে নিজেদের মধ্যে, প্রায় প্রতি বারই নন্দনের মতো প্রেক্ষাগৃহের দর্শকও ফেটে পড়েছে হাসিতে, উল্লাসে। এই পরিস্থিতির জন্য দর্শক দায়ী নিশ্চয়ই, কিন্তু ছবিও কি একেবারে দায়মুক্ত? প্রশ্ন ওঠে, তা হলে সমালোচনার পরিবর্তে ছবির মধ্যেই কি নিহিত ছিল পুরুষতান্ত্রিক প্রবণতাগুলির এক প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় বা উদ্‌যাপন? আর রহস্য-সমাধানের তাগিদে সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কি একান্ত প্রয়োজনীয় ছিল?

থ্রিলার হিসেবে ‘হাওয়া’ কেমন? থ্রিলারের মূল উপাদানগুলি প্রকট হতে শুরু করে দ্বিতীয়ার্ধে। অথচ, যে আতঙ্কের আবহাওয়া ছবিটির প্রতি প্রত্যাশা তৈরি করল, তা ভাল মতন জমাট বাঁধার আগেই চলে এল ক্লাইম্যাক্স, তার পর একে একে কয়েকটি খুন ও যবনিকা পতন। ‘থ্রিল’ যথাযথ ভাবে তৈরি হওয়ার ও দর্শকের মনে রোমাঞ্চ সঞ্চার করার প্রয়োজনীয় সময়টুকু পেল না। শেষের দিকে মৃতদেহ-বোঝাই নৌকায় ভূতগ্রস্ত চানের পোষা শালিক পুড়িয়ে খাওয়ার দৃশ্যে সে যখন অদ্ভুত ভাবে দাঁত বার করে হেসে জিজ্ঞেস করে— ‘‘ভয় পাসসিস?’’, তখন দর্শক আদৌ ভয় পায় না, ফেটে পড়ে হাসিতে। ফলে, আতঙ্ক সৃষ্টি করতেও এই ছবি কতটা সফল সেই নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।

তবে অনস্বীকার্য যে, বেশ কিছু জায়গায় ‘হাওয়া’ চমকে দিয়েছে, মুগ্ধ করেছে। প্রথমেই নিঃসন্দেহে উল্লেখ করতে হয় অভিনয়ের কথা। কেবল চোখেমুখে বিবিধ আবেগের প্রকাশভঙ্গি নয়, শরীরী ভাষায় যেভাবে অভিনেতারা তাঁদের চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন তাতে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, তাঁরা শহরের মানুষ। সমান ভাবে উল্লেখ্য প্রত্যেকের সংলাপ বলার ধরন। কারও মুখেই জেলে সম্প্রদায়ের আঞ্চলিক ভাষার টান বেমানান মনে হয়নি। চঞ্চল চৌধুরী চানের মতো নেতিবাচক ভূমিকায় অতুলনীয়। নিজেকে তিনি চরিত্রের জন্য যে ভাবে ভেঙেছেন, তা কুর্নিশ জানানোর মতো। ইবার চরিত্রে সরিফুল রাজ মনে রাখার মতো। গুলতির চরিত্রে নাজিফা তুশি নজরকাড়া। কিন্তু বেদের মেয়ের তুলনায় তার রূপটান চড়া। মাঝদরিয়া থেকে উদ্ধার হওয়ার পরের দিন সকালেই তার চোখের নীচে পরিপাটি করে পরা কাজল, ঠোঁটে লিপস্টিক কিঞ্চিৎ বেমানান।

যেখানে ‘হাওয়া’ বাজিমাত করেছে তা হল ক্যামেরার কাজ। কামরুল হাসান খসরুর ক্যামেরা কথা বলেছে। সমুদ্রের নিরবচ্ছিন্ন ঢেউয়ের তালে গোটা ছবিই ছন্দময়, মৃদু দুলুনিতে জলের ওঠানামা আর গল্পের চড়াই-উৎরাই মিলে গিয়েছে‌। আলাদা করে মনে থেকে যায় ইবার পিছনে ফ্রেমের প্রেক্ষাপটে সাগর ঢেউয়ের ছন্দে কখনও দৃশ্যমান, আর কখনও অদৃশ্য। বাঁচার তাগিদে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া এক জেলে যখন মরীচিকা ধরতে ঝাঁপ দেয় মাঝসমুদ্রে, তার মরিয়া সাঁতারে বেশ কিছু দূর চলে যাওয়ার পর ক্যামেরায় ঢেউ উঠছে ও নামছে। জলের উপর অস্তগামী সূর্যের করুণ প্রতিফলন, আর নীচে অতল জল। মুগ্ধ করা একটি শটে ক্যামেরা ধরে রাখল এই বৈপরীত্য। রাতের শটগুলিও স্মরণীয়।

কিছু দুর্বলতা সত্ত্বেও এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, ‘হাওয়া’ যথেষ্ট যত্ন নিয়ে বানানো একটি ছবি। গোটা ছবি জুড়েই পরিচালক সুমনের যত্নের ছাপ স্পষ্ট। টিম ওয়ার্ক হিসেবেও এই প্রয়াস প্রশংসার দাবি রাখে। ছবির উপান্তে ড্রোন শটে নৌকা উপর দিকে ফ্রেমের বাইরে চলে গেলে যখন ক্যামেরা আবার উপর দিকে ওঠে, তখন কেবল অনন্ত দরিয়া। নৌকা নিশ্চিহ্ন। দু’ঘণ্টা দশ মিনিট জুড়ে দর্শক যা দেখল তাকেই প্রশ্নের মুখে ঠেলে থামল ‘হাওয়া,’ কিন্তু তার চেয়েও বেশি বোধহয় ছবিটি বলে যেতে চাইল— এটি একটি কিস্‌সা। যত্ন নিয়ে বোনা একটি কিস্‌সা। যার সত্যাসত্য যাচাই নিষ্প্রয়োজন।

অন্য বিষয়গুলি:

Hawa Chanchal Chowdhury Bangladeshi Film
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy