ছবির দৃশ্যে দর্শনা বণিক ও বিক্রম চট্টোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
বাস্তবধর্মী প্রেমের ছবি দেখতে আজকাল মন্দ লাগে না। বাস্তবধর্মী অর্থাৎ যেখানে আকাশ থেকে নায়ক উড়ে এসে আগুনলাগা বারান্দা থেকে প্রেমিকাকে বাঁচায় না বা মহাভারত রামায়ণ থেকে নায়ক নায়িকাকে টেনে এনে প্রেমের গল্প শোনানো হয় না। বিশ্ব সিনেমার মানচিত্রে প্রেমের ছবির ধারা বদলেছে। এর বাইরে সাধারণ জীবনের বাসস্টপেজে দেখা হওয়ার তিন মিনিটের প্রেমগুলি এখন আবার ফিরে আসছে ছবিতে। এই বাংলা ছবিতে অবশ্য প্রেম কোনও কালে কম পড়েনি। ‘অপুর সংসার’ থেকে ‘বসন্ত বিলাপ’, ‘বালিকা বধূ’ বা ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’, ‘হারানো সুর’ বা ‘দাদার কীর্তি’ প্রেমের নানা রূপ ধরা পড়েছে বার বার। কয়েক বছর আগে আদিত্যবিক্রম সেনগুপ্তর ‘আসা যাবার মাঝে’ ছবিতে দেখা মিলেছিল এক যুগলের, যাঁরা কর্পোরেট চাকরির ব্যস্ততায় একটু দেখা
করে উঠতেই পারে না। অথবা, হিন্দি ছবি ‘পিকু’-র নায়ক-নায়িকা বয়স্ক খিটখিটে বাবাকে নিয়ে নাজেহাল। তবু তাঁকে ছেড়ে আলাদা লাল-নীল সংসার পাততে পারে না।
‘সূর্য’ ছবির প্রেমের প্রসঙ্গেই উঠে পড়ে এত কথা। সদ্য মুক্তি পেয়েছে ছবিটি। মালায়ালম ছবি ‘চার্লি’ থেকে অনুপ্রাণিত। অনুপ্ররণা অবশ্য এ ক্ষেত্রে সদর্থক। কারণ ছবিতে যে ধারার প্রেম দেখা গেল, তা বাস্তবতা ছাড়ায়নি। এখানে নায়ক গাছেও চড়ে না, হেলিকপ্টার থেকে লাফও দেয় না৷ বরং বিজয়া দশমীতে আর পাঁচ জন বাঙালির মতোই বহুদিনের প্রেমিকাকে বিবাহ প্রস্তাব দেয়। অসুস্থ, নীপিড়িত, সন্তানহারা মানুষের পাশে থাকে। সে অপেক্ষা করে প্রেমের জন্য...
প্রেমের অপেক্ষা আজকাল আর ছবিতে খুব দেখা যায় না। নায়িকারা ডেট করেন বিকেলে। চাইলেই দ্রুত বার্তা পাঠিয়ে জানিয়ে দেন কখন, কোথায় দেখা করবেন। নায়করা সেই মতো হাজির হয়ে যান কফিশপে। অপেক্ষা বস্তুটাই তাই হাওয়া৷ শুধু ছবিতে নয়, এটাই বাস্তব। প্রেমও তাই এখন কয়েকদিনের গল্প হয়ে উঠে। এ ছবির নায়িকা তেমন নয়। সে বাড়িতে বিয়ের চাপ উপেক্ষা করে, গ্রামে চাকরি নিয়ে চলে যায়। সেখানে দৈবাৎ তার হাতে আসে নায়কের স্কেচবুক। যেখানে ছবি দেখতে দেখতে ক্রমে সে চিনতে পারে নায়ককে। অপেক্ষা করে একদিন তাদের দেখা হবে, ঠিক...
সেই কোন আদ্যিকালের ‘মেঘদূতম্’ থেকেই তো প্রেমের সঙ্গে এই অপেক্ষার সহবাস। তাই খুব নতুন কিছু নয় বিষয়টি। আসলে এ জগতে মৌলিক কিছু আর খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। যা-যা ভাবার, সৃষ্টি করার তা এতদিনে করা হয়ে গিয়েছে। তবু এ ছবিতে সেটাই উপাস্থপনার গুণে ভাল লাগে। এ ছবিতে আরেকটি দিকও উল্লেখ্য, যেখানে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা মানুষের দেহের পাহাড়ের গায়ে ‘আগামীকাল’ নামের এক বসতিকে দেখানো হয়।
নায়ক-নায়িকার প্রেমের নেপথ্যে এই প্রেক্ষিতের আবহ অন্য মাধুর্য তৈরি করেছে। কিন্তু এই প্রেক্ষিতকে আরও নিপুণ ভাবে ব্যবহার করা যেত; কোথাও যেন খামতি থেকে গেল। যেমন ছবির শুরুর ভাগে গল্পের চলনে নায়িকার বিয়ের কথার সময়ে পাত্র অনেক দিনের বন্ধু দেখানো হল, কিন্তু ছবিতে পরে এই চরিত্রটির কোনও উল্লেখ পাওয়া গেল না। এরকম আরও কিছু ‘সাব-প্লট’ কেন চিত্রনাট্যে ঠিক ভাবে রাখা হল না, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। তবে ছবির দ্বিতীয়ভাগে প্রেমের গল্পটিকে বিশ্বাসযোগ্য ভাবে বলার মধ্যে দিয়ে এই ফাঁক অনেকটাই ঢেকে গিয়েছে।
ছবির আরেকটি দিক ভাল লাগে। তা হল, প্রকৃতি। বাংলা ছবির বাজার এখন টালিগঞ্জ বালিগঞ্জের বাইরে খুব বেশি বেরোয় না। সাকুল্যে এক-আধটা আফ্রিকা বা বড়জোর থাইল্যান্ড। কিন্তু এ ছবি ঘরের কাছের পাহাড়ের ‘ল্যান্ডস্কেপ’ সুন্দর ভাবে ব্যবহার করেছে। মূল মালায়ালম ছবিতেও প্রকৃতির ব্যবহার ছিল অনবদ্য। সেই রেশ এ ছবিতেও মিলে যাবে।
ছবিতে ভাল অভিনয় করেছেন ছবির নায়ক বিক্রম চট্টোপাধ্যায় এবং নায়িকা মধুমিতা। তাঁদের নাম ছবিতে সূর্য আর উমা। নায়িকার নামের সঙ্গে মিল রেখেই এখানে বিজয়া দশমীতে নায়কের সঙ্গে মিলন হয় তাঁর। এই ঘটনাটি মন্দ লাগে না দেখতে। এ ছাড়াও ছবিতে ভাল লাগে দর্শনা বণিকের অভিনয়।
বাঙালির উৎসব দুর্গাপুজো চলেই এলো। গড়িয়াহাট-শ্যামবাজারে কেনাকাটার ঢল। দশমীর দিন অনেকের মিলনও হবে এ ছবির নায়ক-নায়িকার মত। এখন শ্রাবণ মাসের মেঘেই রয়েছে সে ইঙ্গিত। আপাতত দু’মাসের অপেক্ষা। কালিদাস থেকে জেন-জ়ি, অপেক্ষা ছাড়া কি প্রেম সম্ভব করতে পারবে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy