‘যমালয়ে জীবন্ত ভানু’ ছবিতে দর্শনা বণিক ও শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় পুনর্নির্মাণ করেছেন ‘সাড়ে চুয়াত্তর’-এর একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত।
গত এক দশকে জীবনীচিত্রের প্রতি আকর্ষণ বেড়েছে চলচ্চিত্র নির্মাতাদের। বলিউড ছাড়িয়ে সেই প্রবণতা ঢেউ তুলছে টলিপাড়াতেও। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, উত্তম কুমারের পর এ বার ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। আত্মবিস্মৃত বাঙালি অনেক কিছু ভুলে গেলেও এঁদের আজও ভুলে যেতে পারেননি একেবারে। হয়তো তাই তাঁরা উঠে আসেন বার বার বিনোদনের পর্দায়। কিন্তু ‘কমেডিয়ান’ ভানু বন্দ্যোধ্যায়ের জীবনের গভীরে লুকিয়ে থাকা যে ইতিহাস, ডাকাবুকো বাঙাল ছেলের দেশপ্রেম, বিজ্ঞান চর্চা— তার কথা হয়তো জানেন খুব কম মানুষ। তাঁর আসল নামও যে ভানু নয়, সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায়, তা-ই বা জানেন ক’জন? তবে, ঠিক জীবনীচিত্র নয়। একটু অন্য রকম ভাবেই সেই মানুষটিকে পর্দায় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন পরিচালক কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়। ঘটনাচক্রে তাঁর নিজের জীবনেও বিজ্ঞান এবং কমেডি দুই নদীর মতো বয়ে চলেছে।
এ ছবিতে কী নেই! নামকরণেই কৃষ্ণেন্দু বেছে নিয়েছেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তম ছবি। ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’-এর ধারায় তিনি নাম দিয়েছেন ‘যমালয়ে জীবন্ত ভানু’। সেই কবে চিত্রগুপ্তের ভুলে ভানুর প্রাণ নিয়ে টানাটানি। তার পর হৈ হৈ কাণ্ড রৈ রৈ ব্যাপার গোটা যমালয় জুড়ে। এত বছর পর কৃষ্ণেন্দুর পরিচালনায় আবার এক কাণ্ড ঘটালেন চিত্রগুপ্ত (শুভাশিস মুখোপাধ্যায়)। এ কালের এক বিজ্ঞানী সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায়কে (অম্বরীশ ভট্টাচার্য) তুলে নিয়ে গেলেন যমালয়ে। পৃথিবীতে পড়ে রইল ‘টাইম মেশিন’ নিয়ে গবেষণা করা বিজ্ঞানী সাম্যময়ের দুর্ঘটনায় নিথর শরীর। পাপ ও পুণ্যের বিচার করে সাম্যময়ের ঠাঁই হল স্বর্গে। আর সেখানেই দেখা জীবন্ত ভানুর সঙ্গে। অভিনয় এবং রূপটানের গুণে অভিনেতা শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় যেন সত্যিই ‘জীবন্ত ভানু’। কৃষ্ণেন্দুর কাহিনি অনুসারে, জীবন্ত ভানু অনুভব করতে পারেন, সাম্যময়ের দুর্ঘটনায় মৃত্যু একেবারেই স্বাভাবিক ঘটনা নয়। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে দেবরাজ ইন্দ্র (সাহেব চট্টোপাধ্যায়) এবং বিধাতার (পরান বন্দ্যোপাধ্যায়) কাছে পৌঁছে যান ভানু ও সাম্যময়। জীবন্ত ভানু প্রতিশ্রুতি দেন, সাম্যময়কে সশরীরে পৃথিবীতে পৌঁছে দেবেনই।
ছবির নাম প্রকাশের পরই খানিকটা হলেও আন্দাজ করা গিয়েছিল এ ছবির কাহিনি এগোতে পারে কোন দিকে। তবু, বাঙালিকে আকর্ষণ করার মতো কী নেই এ ছবিতে। অতীতে ইতিহাস তৈরি করা ছবি ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’ এবং কিংবদন্তি অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম অথবা, ওই সময়ের বেশ কিছু জনপ্রিয় ছবির আকর্ষণীয় দৃশ্যের পুনর্নির্মাণ, মনকাড়া সংলাপ, মনে রাখার মতো গান এবং জীবন্ত ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। নিটোল হাসির ছবির প্রতিশ্রুতি নিয়ে শুরু হয় ‘যমালয়ে জীবন্ত ভানু’।
সচল চিত্রনাট্য ও নিটোল গল্পের যুগলবন্দি ছবিটিকে ছন্দোবদ্ধ ভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। টানটান হয়ে দেখতে থাকেন দর্শক। কিন্তু, খানিক পরেই সেই মনোরম ছন্দে একটু একটু করে শুরু হয় পতন। কোথাও যেন, হাসির ছবির মূল দর্শন থেকে ক্রমশ সরে যেতে থাকে ছবিটি। সব হাসির পিছনেই লুকিয়ে থাকে যন্ত্রণা। যে যন্ত্রণা থেকেই জন্ম নেয় হাস্যরস। কিন্তু, যদি শুরুতেই ভেবে নেওয়া হয় শুধুমাত্র মানুষকে হাসানোর জন্যই অভিনয় বা পরিচালনা, তা হলে একটি নিটোল হাসির ছবি হয়ে ওঠার সম্ভাবনা কমতে থাকে। হাসির গল্পের টানাপড়েনে চরিত্রের যন্ত্রণা ও সঙ্কট যেন যথাযথ ভাবে ফুটিয়ে তোলা গেল না এ ছবিতে।
এই ছবি শুরু হওয়ার আগেই ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’ এবং ‘ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়’ নাম দু’টি কৌশলে দর্শকের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এই দু’টি নাম বাংলা হাসির ছবির জগতে মাইলফলক। স্বাভাবিক ভাবেই দর্শক উজ্জ্বল ইতিহাসের সঙ্গে বাস্তবকে মেলাতে থাকেন। পরিচালকের লক্ষ্যও সেটাই ছিল বলে মনে হয়। কিন্তু তার জন্য নির্দিষ্ট একটি গতিতে ছবিটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হত। এই গতিই ভাল হাসির ছবির মূল বৈশিষ্ট্য। ছবি শুরুর মিনিট চল্লিশ পর থেকে সেই গতি ক্রমশ কমতে শুরু করে। অতিরিক্ত সংলাপ এবং বিক্ষিপ্ত চিত্রনাট্য ছবিটিকে ক্রমশ শ্লথ করে দেয়। ক্যামেরাও হঠাৎ কেমন যেন শান্ত হয়ে যায়। ‘কম্পোজিশন’ ছাড়া নির্দিষ্ট ফ্রেমে দাঁড় করিয়ে দীর্ঘ দৃশ্যের চিত্রায়ণের ফলে দর্শক অস্থির হয়ে যায়। অযথা বাড়তে থাকে গল্পের জটিলতা। দৃশ্যের দৈর্ঘ্য এবং সংলাপের পরিমাণ কমিয়ে ছবিটিকে আরও সহজ সরল ঝরঝরে করা যেতেই পারত।
বেশ কিছু দৃশ্যে যুক্তির অভাব অবাক করতে পারে। যেমন, সাম্যময়ের মতো বিখ্যাত বিজ্ঞানীর দেহ শ্মশানে ওই রকম সাদামাঠা ভাবে কেন আসে! এই যুগে এক বিজ্ঞানীকে কাঠের চুল্লিতে পোড়ানো হয় এমনকি তাঁর গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়ার দৃশ্যে যুক্তির অভাব বোধ হতে পারে।
তবে, এ ছবি বার বার ভাললাগাও তৈরি করে। যেমন, ভানু ও সাম্যময়ের ফাইল খোঁজা, শ্মশানে বৃষ্টি আসা বা গাড়ি চালাতে চালাতে ‘আশিতে আসিও না’ ছবির আদলে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় ও বাসবদত্তা চট্টোপাধ্যায়ের গান, ভানুর মুখে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবির সেই বিখ্যাত সংলাপ ‘মাসিমা মালপো খামু’ (এখানে অবশ্য ‘মাসিমা’ ‘পিসিমা’ হয়েছেন স্বত্বাধিকারের কবলে)-র পুনর্নির্মাণ, মনে রাখার মতো। এই দৃশ্যগুলি দর্শককে নিমেষেই ষাট বা সত্তরের দশকে পৌঁছে দেয়। ছবির আবহ এবং গান ভাল লাগে। ‘নেচে ওঠে মন, মানে না বারণ’ গানটিও দর্শককে ভাললাগার অনুভূতি দেয়।
এ ছবির সব থেকে জোরের অংশ হতে পারত অভিনয়। হতে পারত বলা হয়তো ভুল। সত্যিই তা জোরের জায়গা। ভানুরূপী শ্বাশত চট্টোপাধ্যায় পর্দায় অনবদ্য। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ম্যানারিজ়ম’ অনায়াসে পর্দায় এনেছেন শাশ্বত, সঙ্গে রয়েছে তাঁর ডাগর চোখ আর রূপটানের ক্যারিশমা। চিত্রগুপ্তের ভূমিকায় শুভাশিস মুখোপাধ্যায় এবং বিধাতার ভূমিকায় পরান বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয় নিয়ে আলাদা করে বলার মতো কী বা থাকতে পারে! কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়। কৃষ্ণেন্দুর দর্শককে দেওয়া প্রতিশ্রুতি এবং সাম্যময়কে দেওয়া ভানুর প্রতিশ্রুতি— কোনওটাই কি রক্ষা করা গেল?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy