‘বিনিসুতোয়’ ছবিতে ঋত্বিক চক্রবর্তী ও জয়া আহসান।
‘কী নাম তোমার?’- এই প্রশ্নটা একটা ফিল্ম বা গল্পের শুরু হতে পারে। নাম-ঠিকানা-পরিচয় বিনিময়ের মাধ্যমেই তো শুরু হয় কত আলাপ। এবং প্রসঙ্গত, আলাপ থাকেও শুরুতেই, তা রাগ-সঙ্গীতের ক্ষেত্রেই হোক, বা জীবন। কিন্তু, শেষ? আলাপ কি কখনও পরিসমাপ্তি হতে পারে? ছবির নাম যদি হয় অতনু ঘোষের ‘বিনিসুতোয়’, তবে এর উত্তর ইতিবাচক। বিনি-সুতোয়, অর্থাৎ সুতোর বাঁধন ছাড়া। ছবির ইংরেজি নামও তাই 'উইদাউট স্ট্রিংস'। সমাজের ভিন্ন দুই অবস্থান থেকে উঠে আসা দু'টি মানুষ আলগা সুতোর মতোই জুড়ে যায় একে অন্যের সঙ্গে, অথচ জড়িয়ে যায় না। সমান্তরাল দুই জীবন ক্ষণকালের জন্য কোনও বিন্দুতে মিলিত হলে খুলে যায় অনেক সম্ভাবনা, সেখান থেকে তৈরি হতে পারে কত অজস্র গল্প! বস্তুত, এই গল্পের ধারণাকে পুঁজি করেই অতনু ঘোষের ছবি এগিয়ে চলে। গল্পের প্রয়োজনীয়তা, গুরুত্ব, প্রকৃতি-- এমন অনেক ভাষ্য উঠে আসে টুকরো টুকরো দৃশ্য ও প্রেক্ষিতে। তবে বিষয়ের পাশাপাশি গল্পের গুণগত মান অনেকটাই নির্ভরশীল গল্প-বলার ওপর, এই ছবির ক্ষেত্রে যা খানিকটা হতাশ করে।
ছবির শুরু রুশ সাহিত্যিক দস্তয়েভস্কির উক্তি দিয়ে: ‘ফর দ্য সিক্রেট অব ম্যানস বিইং ইজ নট অনলি টু লিভ বাট টু হ্যাভ সামথিং টু লিভ ফর’ অর্থাৎ ‘মানব জীবনের গোপন উদ্দেশ্য নিছক বেঁচে থাকা নয়, বরং তা কোনও কিছুর জন্য বেঁচে থাকা’। তার পরে ছবির পর্দায় যে প্রথম দৃশ্য ফুটে ওঠে তাতে এক বিগ লং শটে ধরা হয়েছে একটি সুবিস্তৃত গাছ, তার তলা দিয়ে চলে যাচ্ছে একটি সাইকেল। পিছনে ধারাভাষ্যে শোনা যায় ঋত্বিক চক্রবর্তীর গলা, ‘‘প্রতিদিন কেউ না কেউ আমাদের ঘুম ভাঙাতে আসে। কখন আসবে, আগে থেকে জানা থাকে না। কিন্তু সে আসবে।’’ এই অনিশ্চয়তা কেবল মানুষটির আগমনের নয়, তার পরিচয়েরও। কে আসবে, আমরা তা নিশ্চিত ভাবে জানি না। মানুষের পরিচয় ঘিরে ঠিক এই আশ্চর্য অনিশ্চয়তাই এ ছবির কেন্দ্রবিন্দু।
‘কে পাবে ৫০ লাখ’ শীর্ষক এক রিয়্যালিটি শোয়ের অডিশনে দেখা হয়ে যায় শ্রাবণী বড়ুয়া (জয়া আহসান) ও কাজল সরকারের (ঋত্বিক চক্রবর্তী)। শ্রাবণী বেশ জড়সড়, ভীতু এক ছাপোষা গৃহবধূ। যখন তাকে প্রশ্ন করা হয় নিজের বিষয়ে কিছু বলতে, সে বেশ বিপাকে পড়ে। অন্যের ভিডিয়ো করার সময়ে ক্যামেরার সামনে দিয়ে খেয়াল না করেই হেঁটে যায়। মোটের উপর, অডিশনের সেটে সে বেশ বেমানান। অন্য দিকে, কাজল বেশ চটপটে। খোলা মাঠে হঠাৎ শ্রাবণী পড়ে গেলে সে-ই তাকে নিয়ে যায় ডাক্তারখানায়, প্রাথমিক চিকিৎসা হয়ে গেলে চা খাওয়ায়। দু’জনেই দু’জনের গল্প বলে, হিসেব অনুযায়ী দুই ব্যক্তিমানুষের পরিচয় বিনিময় হয়। ক্যামেরা ফ্ল্যাশব্যাকে দেখায় সেই নির্দিষ্ট দিনের শুরুর ঘটনাপ্রবাহ, তাদের দেখা হওয়ার প্রাক-কথন। তারপর বাকি দিনটা তারা একসঙ্গেই কাটায়। দিনান্তে, প্রত্যাশা মতো, তারা যে যার বাড়ি ফেরে।
তারা ফিরে যায় বটে, তবে ফিরে যায় অন্য রূপে ও পরিচয়ে। এইখানেই গল্পের মোচড়। নতুন পরিচয় কী, তাদের কোন পরিচয়ই বা আসল, তা নিয়ে পরিচালক দীর্ঘক্ষণ ধন্দে রেখে দেন। শেষে কী হয় তা অবশ্যই তোলা থাক দর্শকদের জন্য, তবে পরিচয়ের এই দ্বন্দ্বই গল্পের মূল মজা। কয়েকশো বছর আগে ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বিখ্যাত নাট্যকার লিখে গিয়েছিলেন— বিশ্বরঙ্গমঞ্চে সব মানব-মানবীই অভিনেতা মাত্র। অতনু ঘোষের এই ছবি দেখতে দেখতে এই উক্তি কখনও মনের কোণে উঁকি দিলেও দিতে পারে।
ছবির গল্প লিখেছেন অতনু নিজেই। গল্প সত্যিই প্রশংসনীয়। বস্তুত, গল্পের ধারণা ও সংজ্ঞা এখানে এই ছবির প্রধান নির্ভরতার জায়গা। ট্রেলার দেখে, এমনকি ছবির শুরুতেও মনে হচ্ছিল হয়তো প্রচলিত ছক মেনে এই ছবিতেও দুই প্রধান চরিত্রের মধ্যে এক বিবাহ-বহির্ভূত প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হবে। তার যথেষ্ট উপকরণ বা সম্ভাবনাও মজুত ছিল। কিন্তু তা হয় না, পরবর্তী ক্ষেত্রে গড়ে ওঠে কিনা জানার উপায়ও থাকে না। কারণ তার আগেই ছবি শেষ।
তবে ‘বিনিসুতোয়’ ছবির মূল সমস্যা গল্প-বলাতেই। সিনেমার গল্প অনেকটাই নির্ভর করেক দৃশ্য ও সংলাপের ওপর, যে দু’টিই কিছুটা দুর্বল ঠেকে— বিশেষ করে সংলাপ। ছবির শুরু বেশ পোক্ত, তা যথেষ্ট প্রত্যাশাও তৈরি করে। কিন্তু ছবি যত এগোয়, গ্যাদগ্যাদে ও দুর্বল সংলাপের ফলে তা ছড়িয়ে যায়। বেশ কিছু দৃশ্য আরোপিত মনে হয়, যেমন শ্রাবণীর দাদার বাড়ির দৃশ্য। অতীতের কিছু মনোমালিন্যের পরে বোনকে দেখে দাদা (কৌশিক সেন) বেশ রেগেই যায়, তাকে বাড়ি থেকে বের করতে উদ্যত হয়। এই দৃশ্যে হঠাৎ শ্রাবণীর দাদার লেখা কবিতার খানিক প্রথমে তার স্ত্রী, ও পরে সে নিজেই পাঠ করতে শুরু করে যা গল্পের প্রবাহে খাপছাড়া লাগে, যেন জোর করে এক কাব্যিক মাত্রা দেওয়ার প্রচেষ্টা শিল্পের খাতিরে। হয়তো 'গল্প'-কে ছবি জুড়ে এতটা প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে বলেই ফিল্মের গল্প-বলার দুর্বলতাগুলি বেশি প্রকট হয়ে ওঠে।
তার সঙ্গে জয়া আহসানের উপস্থিতি পর্দা থেকে চোখ সরাতে না দিলেও, তাঁর অভিনয় খানিক সীমিত মনে হয়। মুখের প্রকাশভঙ্গী গোটা ছবি জুড়ে অনেকটাই স্থির, অপরিবর্তনীয়। বরং, ছবি অনেকটা উতরে গিয়েছে ঋত্বিকের স্বভাবসিদ্ধ ঢংয়ের সাবলীল অভিনয়ে। কৌশিক সেন ছোট চরিত্রে ভাল, ও চান্দ্রেয়ী ঘোষ কাজলের স্ত্রীয়ের চরিত্রে আশানুরূপ।
ছবিতে উল্লেখযোগ্য কিছু ফ্রেম রয়েছে যা মনে থেকে যায় ছবি শেষের পরেও। যেমন, পুরনো বাড়ির রেলিংয়ে রোদ-ছায়ার অদ্ভুত সংমিশ্রণের পাশে রাখা একটি কমলালেবু অথবা হঠাৎ বৃষ্টিতে চায়ের দোকানের ছাউনির তলায় অপেক্ষারত শ্রাবণীর শট। শেষ ফ্রেমে ‘শ্রাবণী’ নামের সঙ্গে মিলে মিশে যায় বৃষ্টির অঝোর ধারা, শ্রাবণী প্রকৃত অর্থেই হয়ে ওঠে শ্রাবণের প্রতীক। মাঝের অনেকটা অংশ শ্লথ গতি ও দুর্বল চিত্রনাট্যের জন্য পড়ে গেলেও, ছবির শেষটুকু আবার স্মরণীয়। বিশেষ করে শেষের দিকে জয়ার গলায় ‘সুখের মাঝে তোমায় দেখেছি’ তৈরি করে এক অদ্ভুত স্নিগ্ধ পরিসর। যথাসম্ভব অনাড়ম্বর সঙ্গীতায়োজনে এই রবীন্দ্রগানটিও সার্থকতা পেয়েছে। ভাল-মন্দ মিশিয়ে অতনু ঘোষের নতুন ছবি এক অন্য স্বাদের গল্প বলে। তার উপর এত দিন পরে সিনেমা হল খুলেছে। এক বার গিয়ে দেখে আসতেই পারেন ‘বিনিসুতোয়’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy