কেমন হল ‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’? ছবি: সংগৃহীত।
ভারতবর্ষের ন্যায়সংহিতায় ১৯৭৩ সালে ঔপনিবেশিক আইন অনুযায়ী নির্ণায়ক সভার (জুরি বোর্ড) অংশগ্রহণ অবলুপ্ত করা হয়। তার ৫২ বছর পর যদি একটি মুক্তিপ্রাপ্য বাংলা সিনেমায়, আমেরিকার পঞ্চাশের দশকের নির্ণায়ক সভার আবহ ফেরত আনতে হয় এবং সেই সিনেমাকে যদি বাণিজ্যিক ভাবে সফল করতে হয়, তা হলে পরিচালককে কিছু বাড়তি চিন্তাভাবনা করতে বাধ্য হতেই হয়। সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’ ছবি শুরু হয় ঠিক এই তথ্যটিকে অন্যতম প্রধান চরিত্রের সংলাপ হিসাবে বলিয়ে।
‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’ আসলে ১৯৫৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সিডনি লুমেট পরিচালিত হলিউডি ছবি ‘১২ অ্যাংরি মেন’ অবলম্বনে। যে ছবি আবার রেজিনাল্ড রোজ় রচিত ওই একই নামের একটি মৌলিক টেলি-নাটক অবলম্বনে। হলিউডি ছবিটি বহু প্রশংসিত এবং অস্কার ও অন্যান্য চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কারপ্রাপ্ত। বাংলা সিনেমাটিতে অবশ্য এ সব হলিউডি ইতিহাসের কোনও ইঙ্গিত অন্তত স্বীকার করা হয়নি। যেটি স্বীকার করা হয়েছে, সেটি হল ১৯৮৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত বাসু চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত, হিন্দি ছবি ‘এক রুকা হুয়া ফ্যায়সলা’। সেই হিন্দি ছবির চিত্রনাট্য এবং সংলাপ কিন্তু পুঙ্খানুপুঙ্খ ছিল ‘১২ অ্যাংরি মেন’-এর অনুবাদ।
কিন্তু এমন একটি চিত্রনাট্য, যার চলনটিই সম্পূর্ণ ভাবে একটি তাঁবাদি হয়ে যাওয়া বিচার পদ্ধতির উপর নির্ভরশীল, তাকে মূল উপজীব্য করে চিত্রনাট্য গঠন করতে গেলে, হয় তাকে ‘পিরিয়ড পিস’ হিসাবে তৈরি করতে হয়, নয় সেই বিষয়টিকে সমকালীন করতে, চিত্রনাট্যটিকে খানিক সমকালীন করতে হয়। সৃজিত দ্বিতীয় পথটি বেছেছেন। আর এই পথটি নেওয়ার জন্য তাঁর আলাদা প্রশংসা প্রাপ্য। পথটি যে খুব নতুন কিছু, তা নয়। কিন্তু অনস্বীকার্য ভাবে বাণিজ্যিক জ্যামিতিতে বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। সেটি হল, এই নিয়ন্ত্রক সভাটিকে সম্পূর্ণ ভাবে একটি স্বপ্নদৃশ্যে নিয়ে দেওয়া। সেটি এক বিচারকের দেখা স্বপ্ন। ঘুমনোর আগে যে মামলায় তিনি রায় দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন, সেই মামলা নিয়ে ভাবতে ভাবতে তিনি গান শুনছিলেন। গানটি একটি অধুনা বহুল জনপ্রিয় বাংলা বাউলগীতি—“তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা, মন জান না...”। বিচারকের স্বপ্নে সুতরাং স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর ‘মনের কয়জনা’ ফিরে আসে, বিচারসভা বসায় সেই একই মামলাকে ভিত্তি করে। মজা হল, মৌলিক চিত্রনাট্যে যদিও এই সভার অংশগ্রহণকারীরা কেউ কাউকে চেনে না, স্বপ্নের বিচারসভায় অংশগ্রহণকারীরা হয় বিচারকের বন্ধু, না হলে আত্মীয়, নয়তো পরিচিত। কেবল একজন ছাড়া, যার উপস্থিতির ভিত্তি বিচারকের এক গভীর স্মৃতি থেকে উত্থিত। এমনই এক স্মৃতি যাকে বিচারক অস্বীকার করতে চায়, চায় ভুলে যেতে। সেই চরিত্রের উপস্থিতি ছবির শেষে বেশ জমাটি একটি মৌলিক চমক নিয়ে আসে। এই দিকটি মৌলিক ইংরেজি নাটক বা সিনেমার চিত্রনাট্যে ছিল না কোনও ভাবেই, ছিল না বাসুবাবুর ছবিতেও এবং এটি সম্পূর্ণ ভাবে চিত্রনাট্যকার সৃজিতের মস্তিষ্কপ্রসূত। সে কারণেই মূল চিত্রনাট্যের একটি উত্তরণ ঘটে এবং তা অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য।
‘১২ অ্যাংরি মেন’ ছিল আমেরিকায় রাষ্ট্রপতি নিক্সনের সময়ের বিচারব্যবস্থায় নির্ণায়ক সভার কাজকর্মের একটি সমালোচনা। সেই মর্মবিন্দু অক্ষুণ্ণ রেখেই ‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’ ছবিতেও সমকালীন বিভিন্ন বিতর্কিত মূল্যবোধও উঠে এসেছে। এসেছে আজকের সময়ে মাথা তোলা জাতিবিদ্বেষ, হিন্দুত্ববাদী মতবাদ, এমনকি ভাষাগত সংকীর্ণতাও উঠে এসেছে বিচারসভায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে নানা সংলাপে। আরও এসেছে সেই সব সামাজিক সংকীর্ণতা যা সমাজের প্রান্তবাসীদের প্রতি আজও তথাকথিত ভদ্র মানুষের মধ্যে ভীষণ ভাবে বর্তমান। আর এর প্রত্যেকটির নেপথ্যে দেখানো হয়েছে একটিই কারণ। যা কোনও না কোনও ভাবে এই অংশগ্রহণকারীদের চারিত্রিক ইতিহাসে কিছু কিছু ঘটনার উপস্থিতি, যা সেই চরিত্রকে কোনও একটি মতবাদে বিশ্বাসী করে তুলেছে। আসলে সবটাই ঘটছে বিচারকের মাথায়, কারণ মনুষ্যমস্তিষ্ক এ ভাবেই যে কোনও ধাঁধার সমাধানে উপনীত হয়। ওই যে “তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা, মন জান না”।
নাটক থেকে সিনেমা করার সমস্যা হল, সিনেমার ব্যাকরণের একটি মূলসূত্র নাটকের পক্ষে মেনে চলা অসম্ভব। দর্শকের অস্বস্তি এবং একঘেয়েমী কাটানোর জন্য সিনেমাকে কিছুতেই চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে রাখা যায় না। প্রত্যেক অন্দরদৃশ্যের জবাবে অন্তত একটি লম্বা বহির্দৃশ্যের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে সিনেমা। সেটি মঞ্চে সম্ভব নয়। কিন্তু ‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’ ছবিতে সৃজিত মূল বিচারসভাটিকে স্বপ্নদৃশ্যে নিয়ে গিয়ে সেই সমস্যার সমাধান করেছেন মসৃণ ভাবে। আরও যেটি তিনি করেছেন তা হল বড় পর্দার দাবি পূরণ। অর্থাৎ এক ঢিলে দুই পাখি মারা। যে হেতু স্বপ্নদৃশ্য তাই সেটি যে কোনও জায়গাতেই ঘটতে পারে। সুতরাং চার দেওয়ালের মধ্যে বদ্ধ একটি নাটককে, সৃজিতের কল্পনা কখনও ফেলেছে গল্ফ খেলার ময়দানে, কখনও নাট্যঘরে, কখনও জঙ্গলে, কখনও ঢেউ আছড়ে পরা সমুদ্রতটে, চরিত্রদের অবস্থানটুকু এক রেখে। এর ফলে ক্যামেরার কাজও (সিনেমাটোগ্রাফি: প্রসেনজিৎ চৌধুরী) কিছু দেখানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে। আর নাটকঘরে কাহিনিকে নিয়ে গিয়ে নিঃশব্দে সৃজিত রোজ়কেও স্বীকৃতি দিয়েছেন। এখানে শিল্প নির্দেশনায় একটি বিশেষ মাত্রা যোগ হয়েছে। সভায় উপস্থিত বারো জনের বসার কেদারাগুলির মাথায় খোদাই করা বারোটি রাশিচিহ্ন। যেগুলি প্রত্যেক চরিত্রের মূল বৈশিষ্ট্যের পরিচায়ক।
যে বারো জন অভিনেতাকে নিয়ে সৃজিত এই বিচারসভাটি গড়েছেন, তাঁরা এই মুহূর্তে বাংলা সিনেমার অন্যতম শক্তিশালী অভিনেতা। পর পর নামগুলি বলে নেওয়া বাঞ্ছনীয়। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, কোশিক সেন, ঋত্বিক চক্রবর্তী, অনন্যা চট্টোপাধ্যায়, ফাল্গুনী চট্টোপাধ্যায়, রাহুল অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যায়, কাঞ্চন মল্লিক, সুহোত্র মুখোপাধ্যায়, সৌরসেনী মৈত্র, অর্জুন চক্রবর্তী, অনির্বাণ চক্রবর্তী এবং অবশ্যই পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। পরমব্রতের নামটি শেষে উল্লেখ করা হল, কারণ যে চরিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন সে রকম চরিত্রে এর আগে তিনি অভিনয়ের সুযোগ পাননি। দু’কানে ঝোলা দুল, চোখে হালকা কাজলের ছোঁয়া, পরনে ধুতি-কুর্তা উত্তরীয়, হাত নেড়ে কথা বলায় পরিষ্কার একটি মেয়েলি টান। তাঁর চরিত্রটির উপস্থিতি দেখলেই বোঝা যায়, তিনি সামাজিক ভাবে প্রান্তবাসী, সমলিঙ্গে বিশ্বাসী একটি চরিত্র এবং কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় ছাড়া এটিই প্রধান চরিত্র এই বিচারসভায়। এ রকম একটি ব্যতিক্রমী চরিত্রকে পরমব্রত যতটা সম্ভব শোষণ করেছেন এবং ভীষণ ভাবে ছাপ ফেলেছেন ১২ জনের মধ্যে। বিতর্কের সুযোগ রেখেই দাবি করা যায়, সৃজিতের ছবিতে এটিই এখনও পর্যন্ত তাঁর সেরা অভিনয়। ‘বাইশে শ্রাবণ’ এবং ‘হেমলক সোসাইটি’কে মাথায় রেখেই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। এ ছাড়া অনির্বাণ চক্রবর্তী যে চরিত্রে অভিনয় করেছেন, সেটিও বেশ আকর্ষণীয় । এ পর্যন্ত তিনি বাংলায় বসবাসকারী কোনও অবাঙালি চরিত্রে অভিনয় করেননি। তাঁর চরিত্রের বিশেষত্ব হল চরিত্রটি আসলে বহিরাগত এবং সেই বিষয়ে সে ভীষণ ভাবে সচেতন। সেই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য তার অন্যতম হাতিয়ার হল বাংলা ভাষায় কথা বলার চেষ্টা। তাতে যেটা ঘটে, তার ভাষাটি না হয়ে ওঠে সম্পূর্ণ বাংলা, না হয় হিন্দি। যা হয় সেটিকে সবচেয়ে কাছাকাছি যে ভাবে বোঝানো যায় হিন্দি ব্যাকরণআশ্রিত বাংলা হিসাবে। অনির্বাণের চরিত্রে এই শিকড়বিচ্ছিন্ন যাপন ভারী স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় বা কৌশিক সেন অবশ্য বিশেষ কিছু নতুনত্ব আনেননি। এই ধরনের চরিত্রে তাঁরা আগেও অভিনয় করেছেন। প্রথম জন বদরাগী, সফল পেশাদার, দ্বিতীয় জন অতিভদ্র শহুরে সফল পেশাদার। রাহুল অরুণোদয়, কাঞ্চন, ঋত্বিক এবং সুহোত্র নিজেদের চরিত্রে অভিনয় নয়, ব্যবহার করেছেন। অনন্যা এবং সৌরসেনী যেটুকু সুযোগ পেয়েছেন, তার সদ্ব্যবহার করেছেন।
কথাটি ফাল্গুনী এবং অর্জুনের ক্ষেত্রেও খাটে। বাহুল্য হবে না এটাও উল্লেখ করলে যে, সিনেমাটির মুক্তির সময়ে একটি অদ্ভুত ঐতিহাসিক সমাপতন ঘটে গিয়েছে। এই সপ্তাহটি শুরু হয়েছিল এ রাজ্যে হইচই ফেলে দেওয়া আর জি কর হাসপাতালে কর্মরত অবস্থায় এক তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের মামলার রায় ও শাস্তি ঘোষণার মাধ্যমে। মামলায় দোষীর শাস্তি নিয়েও নানা মহলের নানা মত ছিল। নিম্ন আদালতে বিচারক দোষীকে আমৃত্যু কারাদণ্ডের আদেশ দেন। আর এই সিনেমাটির কাহিনি আবর্তিত হচ্ছে একটি ভাতৃহত্যার বিচার ঘিরে। দু’টি ক্ষেত্রেই দোষী অভিযোগ অস্বীকার করেছে। যে সপ্তাহ শুরু হয়েছিল এমন একটি ঘটনা দিয়ে, সেই সপ্তাহান্তে এমন একটি বাংলা সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে। এই সমাপতনটি হয়ত অচিরেই সিনেমাটিকে বক্স অফিস বাণিজ্যে লক্ষ্মীলাভে সাহায্য করবে।
শেষে একটি ছন্নছাড়া মত। পরিচালক সৃজিত, মানুষ হিসাবে বিশাল খাদ্যরসিক। তিনি রন্ধনে পারদর্শী কি না জানা নেই, তবে তাঁর পরিচালিত বেশির ভাগ সিনেমাই তিনি মন দিয়ে রাঁধেন তা ঐতিহাসিক ভাবে প্রমাণিত। তাঁর পরিচালনায় ‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’ কে যদি কোনও সুখাদ্যের সঙ্গে তুলনা করতে হয় তা হলে বলা যায়, এই সিনেমাটির স্বাদ খাঁটি ঘিয়ে সেঁকা নির্ভেজাল আওধি তুণ্ডে কাবাবসম হয়েছে। নরম, মাখন মোলায়েম, স্বাদে-গন্ধে ভরপুর এবং খিঁচহীন। অথচ সহজপাচ্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy