Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
a suitable boy

সৎপাত্রের সন্ধানে একটি দেশ ও অনেক চেনামুখ

মীরা নায়ারের ‘আ স্যুটেবল বয়’ সে সব ভাবনার কিছু কিছু জায়গা ছুঁয়ে গেলেও, বুঝিয়ে বলতে পারল না। ফলে বিক্রম শেঠের গল্প এবং মীরা নায়ারের অনুধাবনের মাঝে রয়ে গেল এক অর্থহীন দূরত্ব।

মান এবং সইদাকে ঘিরে গল্পে ঢুকে পড়া চরিত্রেরা প্রশ্ন তোলে মূল গল্পে। ছবি:সংগৃহীত

মান এবং সইদাকে ঘিরে গল্পে ঢুকে পড়া চরিত্রেরা প্রশ্ন তোলে মূল গল্পে। ছবি:সংগৃহীত

সুচন্দ্রা ঘটক
শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০২০ ১২:৫০
Share: Save:

অভিনয়: তব্বু, ইশান খট্টর, তানিয়া মানিকতলা, রাম কপূর, বিজয় বর্মা, রণবীর শোরে প্রমুখ

পরিচালনা: মীরা নায়ার

আ স্যুটেবল বয়। মানে সৎপাত্র!

সত্যিই শুধু তা-ই কি? ফিল্মের ভাষায় তর্জমা করলে বুঝি শুধু সেটুকুই হয়?

সৎপাত্র যদি হয়ও, তবে কার? জনৈকা রূপা মেহরার ছোট কন্যা লতা মেহরাকে পাত্রস্থ করার যে পরিকল্পনা এবং তা ঘিরে তৈরি হওয়া ঘটনাবলিই কি এই গল্পের নাম দিয়েছে ‘আ স্যুটেবল বয়’? বোধ হয় না। বিক্রম শেঠের উপন্যাসটি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ আধুনিক ভারতের গল্প কি না, তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলতেই পারে। তবে তাঁর উপন্যাসের প্রেক্ষাপটটা যে শুধু সৎপাত্রের সন্ধানের থেকে অনেক বড় এবং গাঢ়, সে বিষয়ে সন্দেহ থাকার কথা ছিল না। মীরা নায়ারের ‘আ স্যুটেবল বয়’ সে সব ভাবনার কিছু কিছু জায়গা ছুঁয়ে গেলেও, বুঝিয়ে বলতে পারল না। ফলে বিক্রম শেঠের গল্প এবং মীরা নায়ারের অনুধাবনের মাঝে রয়ে গেল এক অর্থহীন দূরত্ব। মীরার সৃষ্টি আটকে রইল এক কন্যার বরের খোঁজের কাহিনিতেই। বিক্রমের গল্প যদিও পঞ্চাশের দশকের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে নতুন তৈরি দেশের ভবিষ্যৎ খুঁজেছিল। এটি কখনও ‘দ্য ইন্ডিয়ান ম্যাচ মেকিং’-এর প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার কথা ছিল না।

সাহিত্য থেকে সিনেমা তৈরির চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা নতুন কিছু নয়। আগেও হয়েছে। আবারও হবে। বিভিন্ন মিডিয়াম নিয়ে কাজ করা এই যুগে কিছু কথা আরও বাড়বেই। তবে একটা বড় ফাঁদে পা অনেকেই দিয়ে ফেলেন এমন কাজ করতে গিয়ে, তা হল সবটা দেখানোর ইচ্ছে। মীরা নায়ারও সেই ফাঁদ এড়াতে পারলেন না। বিক্রম শেঠের মস্ত উপন্যাসের সব চরিত্র এবং সব ঘটনাকে জায়গা দিতে গিয়েই বোধ হয় হারিয়ে গেল নিজের ভাবনা। তার ফল যা হল, তা না হলেই ভাল হত। একটা উপন্যাস থেকে যখন ছবি তৈরি হয়, তখন সেটিও যে সেই গল্পের একটি ‘ক্রিটিক্যাল স্টাডি’, পরিচালকের চোখে সেই উপন্যাসের গুরুত্ব কোথায়, সেটি ফুটে উঠবে বলে আশা রাখেন দর্শকেরা। যেমনটা কিছুটা হলেও ফুটে উঠেছিল মীরার ‘নেমসেক’-এ।

বিক্রম শেঠের উপন্যাস ভিত্তি করে যে সিরিজ তৈরি হচ্ছে, তা নিয়ে উত্তেজনা কেন ছিল? শুধুই কি তা মীরা নায়ার করছেন বলে? তাতে তব্বু কাজ করছেন বলে? নাকি সিরিজটি বিবিসি-র জন্য তৈরি বলে? সেই সব ক’টি কারণ গুরুত্ব পাওয়ার যোগ্য হলেও, ‘আ স্যুটেবল বয়’ উপন্যাসটি দোষ-গুণ মিলিয়ে একটি জরুরি সময়ের কথা বলে। তেরোশো পৃষ্ঠার এই উপন্যাসে দেশভাগ পরবর্তী সময়ের ভারতবর্ষকে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাস্কৃতিক নানা দিক দিয়ে বিশ্লেষণের চেষ্টা রয়েছে।

আরও পড়ুন: নাইজেলের চ্যালেঞ্জ

মূলত চারটি পরিবারের ভূত-বর্তমান-ভবিষ্যতের টানাপড়েনে ফিরে ফিরে আসে সদ্য বিভক্ত ভারতের নতুন করে গড়ে ওঠার প্রচেষ্টা। ছবি:সংগৃহীত

বিক্রম শেঠের সেই চেষ্টার প্রজেক্টের কেন্দ্রে এক মা, রূপা মেহরাকে (মাহিরা কক্কর) দেখা যায় মেয়ে লতার (তানিয়া মানিকতলা) জন্য সুপাত্রের সন্ধান করতে। সেই খোঁজ ঘিরেই গল্পে ঢুকে পড়ে নানা চরিত্র। ব্রহ্মপুর নামে এক কাল্পনিক শহর থেকে গল্প কখনও যায় কলকাতা, তো কখনও লখনউ। মূলত চারটি পরিবারের ভূত-বর্তমান-ভবিষ্যতের টানাপড়েনে ফিরে ফিরে আসে সদ্য বিভক্ত ভারতের নতুন করে গড়ে ওঠার প্রচেষ্টা। পঞ্চাশের দশকের সেই দেশে জমিদারি ব্যবস্থার পতন, তা ঘিরে বিল পাশ, প্রথম বারের নির্বাচন— সবটা মিলে গল্প। এই বড় বড় বদলগুলোও এই গল্পের জরুরি চরিত্র। এ সব ঘটনাকে শুধু 'সিম্বল' বলে ছেড়ে দিলে ভূল হবে। ঠিক যেমন লতার মুসলমান প্রেমিক, অঙ্কের অধ্যাপকের ইতিহাস পড়ুয়া ছেলে কবীর দুরানিকে শুধুই সৎপাত্র হয়ে ওঠার রেসের এক জন চরিত্র বললে বাদ পড়ে যাবে অনেকটা। এই গল্পে সৎপাত্র শুধু এক লতার জন্য খোঁজা হচ্ছে, এমন তো নয়। ইংরেজ শাসন থেকে সদ্য স্বাধীন ভারত, রাজনৈতিক-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে সত্যিই কতটা স্বাধীন হল— তারও তো খোঁজ চলছে। সেই খোঁজের জন্যই বিক্রম শেঠের উপন্যাসে ঢুকে পড়ছে কখনও বনেদি বাড়ির ছেলে, বিলেত ফেরত কবি অমিত চাটার্জি (মিখাইল সেন), কখনও আসছে হিন্দু মন্ত্রীর মুসলমান জমিদার বন্ধু। তিন ধরনের পুরুষ চরিত্রকে দেখানো হচ্ছে লতার সৎপাত্রের দৌড়ে নাম লিখিয়েছেন। এক কবীর, দুই অমিত এবং তৃতীয় জন এই এলিট, তথাকথিত ইন্টেলেকচুয়াল সমাজের থেকে অনেক দূরের বিদেশি জুতো সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মী হরেশ খন্না। এখানে প্রতিটি সিম্বল যেমন চরিত্র, সব চরিত্রও এক-একটি সিম্বল। লতার বাবার মৃত্যুর পরে তাঁদের পরিবারে নানা ধরনের টানাটানি পড়েছে। মা চাইছেন মেয়ের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে। ঠিক সেই সময়েই একদল অভিভাবক চাইছেন দেশেরও ভবিষ্যৎ পোক্ত করে তুলতে। সেই চেষ্টার অঙ্গ হিসেবেই গুরুত্ব পায় লতার দিদি সবিতার (রসিকা দুগ্গল) শ্বশুরবাড়ির গল্প। তাঁর শ্বশুরমশাই মহেশ কপূর (রাম কপূর) লড়ে চলেন জমিদারি ব্যবস্থায় বদল আনতে। পাশ হয় বিলও। এ সবের পরেই আসে স্বাধীন ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচন। মীরা নায়ার শুধু কয়েক জনের ভোট দেওয়ার দৃশ্য দেখিয়ে ক্ষান্ত হলেও এ গল্পের নির্বাচন পর্ব বোধ হয় অত ছোট ছিল না। নির্বাচনটাই তো গল্প। দুটো স্তরে। ছোট গণ্ডিতে দেখলে তা লতার ভবিষ্যতের জন্য ঠিক মানুষটি নির্বাচন করা, আর বড় করে দেখতে গেলে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ঠিক কেমন মানুষের হাতে যাওয়া দরকার, তা ঘিরে ভাবনা।

মীরা নায়ার কি সে সব ভাঁজের কিছুই বুঝলেন না তবে? তিনি যদি না-ই বুঝতেন, তবে তাঁর সৃষ্টির সবচেয়ে বড় দু’টি নাম সইদা বাঈ এবং মান কপূরের ভূমিকায় কাজ করতেন না। জমিদারি ব্যবস্থার পড়ন্ত বেলায় এক মুসলমান বাইজির ভূমিকায় তিনিই তো এনেছেন তব্বুর মতো অভিনেতাকে। তার সঙ্গে মানানসই নির্বাচন মন্ত্রী মহেশ কপূরের ছোট পুত্র মান কপূরের ভূমিকায় ঈশান খট্টর। বয়সে দ্বিগুণ সইদার প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া মান কেন এত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায়, যদি সে না-ই রইল লতার সুপাত্র হওয়ার দৌড়ে? মান ছিল দেশের ভূত এবং ভবিষ্যতের মধ্যে যোগাযোগ ধরে রাখা এক চরিত্র। সইদারা কোথায় হারিয়ে যাবেন নতুন দেশের নতুন ব্যবস্থাপনায়? মুসলমান আর হিন্দু সমাজ কী কী ভাবে দূরে চলে যাবে নতুন করে দেশ গড়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষায়? মান এবং সইদাকে ঘিরে গল্পে ঢুকে পড়া চরিত্রেরা সে সব প্রশ্ন তোলে মূল গল্পে। মীরা নায়ারের গল্পে সে সব চরিত্র আসে-যায়, কথা বলে, কিন্তু নিজেদের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে পারে না। ফলে সইদার মেয়ে তসনিমের প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া আরবি শিক্ষক রাশিদ (বিনয় বর্মা) কেন হঠাৎ আত্মহত্যা করলেও দর্শকের কষ্ট হয় না, তা ভেবে পাওয়াই কঠিন হয়ে যায়। কেন ওয়ারিসের মতো কয়েক মিনিটের চরিত্রে রণবীর শোরে কাজ করেন, তা-ও বুঝিয়ে উঠতে পারে না এই সিরিজ। কিন্তু ওয়ারিস যে গুরুত্বপূর্ণ, তা নিশ্চয়ই বুঝেছিলেন পরিচালক। না হলে নামী অভিনেতাকে সে জায়গায় নিতেন কি? মহেশের শাগরেদ ওয়ারিস হঠাৎ তাঁরই বিরুদ্ধে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ক্যান্ডিডেট হয়ে ভোটে দাঁড়ায়। এ পারে থেকে যাওয়া মুসমান সমাজ যে ভাবে হয়তো বা চেষ্টা চালিয়েছিল স্বাধীন ভারতে নিজের স্বাধীনতাও খুঁজে নেওয়ার, তা-ই দেখার ছিল এই চরিত্রের মাধ্যমে। কিন্তু দেখা গেল কি? যা দেখা গেল এই চরিত্র থেকে, তা শুধুই বিশ্বাসঘাতকতার ইঙ্গিত। ফলে হিন্দু বাড়ির লতার কবীরের দিকে যে না ঝোঁকাই ভাল, সে দাবির পক্ষে আরও কিছু দর্শক-ভোট বাড়ায় মাত্র ওয়ারিস চরিত্র।

মীরা নায়ার শুধু কয়েক জনের ভোট দেওয়ার দৃশ্য দেখিয়ে ক্ষান্ত হলেও এ গল্পের নির্বাচন পর্ব বোধ হয় অত ছোট ছিল না। ছবি:সংগৃহীত

আরও পড়ুন: ভক্তদের মন্নতে...

বুদ্ধিজীবী সমাজের দুই দীপ্ত চরিত্র কবীর এবং অমিতকে বাদ দিয়ে অধ্যাপক কপূরের শ্যালিকা লতা বেছে নেয় হরেশকে নিজের স্বামী হিসেবে। সেই হরেশ, যে কি না তার পরিবারের সঙ্গে মানানসই দেখানোর জন্য পান খাওয়া ছেড়েছে। পনেরো বছর বয়সে নিজের বাড়ি ছেড়েছিল বাবার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করবে না বলে। তার পরে বিলেতে গিয়ে জুতো বানানোর টেকনোলজি নিয়ে পড়াশোনা করেছে। নামী সংস্থায় কাজ করেছে। তবু লতাদের মতো আদবকায়দা নেই তার। সে সব দিক দিয়ে খানিক পিছিয়েই যেন। তার শত চেষ্টার পরেও লতার ইংরেজি বলা দাদা-বৌদি হরেশকে পিছনে ‘কবলার’ বলেই উল্লেখ করে থাকেন। লতা তবু তাকেই বেছে নেয়। মন থেকে চায় না। বুদ্ধির আশ্রয় নেয়। আর সেই হরেশের সঙ্গে নতুন ভারতের ভবিষ্যৎ প্রতীকও হয়ে ওঠে নবীন প্রজন্মের ‘সেল্ফ মেড’, খেটে তৈরি হওয়া ব্যক্তিরা। কিন্তু মীরা নায়ার সে দিকে মন দেন না। গল্প ছেড়ে দেন লতার বিয়ে, কবীরের হতাশায়। যার ফলে ‘আ স্যুটেবল বয়’ বিদেশি দর্শকদের কাছে, ইংরেজি ভাষায় বলা, ভারতীয় ‘অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ’-এর আরও একটি উপাখ্যান হয়ে রয়ে যায়। যাকে ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান ম্যাচ মেকিং’ নাম দিলেও ভুল হত না!

অন্য বিষয়গুলি:

A Suitable Boy Mira Nayar Review Vikram Sheth
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy