এই ছবির মার নেই। পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় রণ পায়ে চড়ে লম্বা ছুট লাগিয়েছেন। একটি পায়ের নাম কিশোরকুমার, অন্যটি প্রসেনজিৎ। কখনও খেলাচ্ছলে ‘শিং নেই তবু নাম তার সিংহ’ গাইতে গাইতে রাজেশ শর্মার চোখে জুতোর ধুলো ছিটিয়ে দিচ্ছেন প্রসেনজিৎ, কখনও বা অস্তগামী সূর্যের আলোয় ‘উও শাম কুছ অজীব থি’। কুমার শানু বহু দিন পরে ফাটিয়ে গেয়েছেন। রণ পা তৈরিতে তাঁর কারিগরিও অস্বীকার করা যাবে না।
একদা দৌড়ের মাঠ অবশ্য ছিল! আগে পুজোর সময়েই রিলিজ় করত ‘দেয়া নেয়া’, ‘শঙ্খবেলা’, ‘দাদার কীর্তি’র মতো ছবি। এখন সিনেমার সে গান নেই, দিকশূন্যপুর নেই।
হারিয়ে যাওয়া দিকশূন্যপুরেই ওঁরা ছিলেন। কিশোরকণ্ঠী, লতাকণ্ঠী মাচাশিল্পীরা। রাতের পর রাত জলসা টেনেছেন, কিন্তু সম্মান পাননি। এই ছবি সেই জায়গাটা ধরেছে। মাঝরাতে স্টেজ পেয়ে, আকণ্ঠ মদ খেয়ে কিশোরকুমার জুনিয়র (প্রসেনজিৎ) স্টেজে উঠছে, শেষ রাতে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ধাবায় তরকা-রুটি। বাড়ি ফিরলে তিতিবিরক্ত বউ (অপরাজিতা আঢ্য) আর ছেলের (ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়) সঙ্গে ঝগড়া: ‘সিন ক্রিয়েট কোরো না। তোমার মতো গাইয়ে অনেক আছে’। পরের দিন চায়ের দোকানে লুঙ্গি, পাঞ্জাবি পরে সেই জুনিয়রই গাইতে থাকে, ‘কী আশায় বাঁধি খেলাঘর’। আস্তে আস্তে ভিড় জমে, ছেলে পিছন থেকে বলে, ‘মা খাবার করে রেখেছে। বাড়ি যাও।’ কপি সিঙ্গাররা এই ভাবেই চায়ের দোকানে আড্ডা মারতেন, শিল্প-অভিমানের গজদন্ত মিনার তাঁদের ছিল না।
কিশোর কুমার জুনিয়র পরিচালনা: কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় অভিনয়: প্রসেনজিৎ, অপরাজিতা, ঋতব্রত, রাজেশ ৬.৫/১০
প্রসেনজিৎ এই ছবিতে তাই রেট্রো লুকে। রং-করা এলোমেলো লম্বা চুল, গলার চেনে কিশোরকুমারের লকেট। মুখে মদের গন্ধ ছড়াতে ছড়াতে ছেলের পড়াশোনার খোঁজ নিতে যায়। কপি সিঙ্গার এবং মাচাশিল্পীদের বুকেও তো ছিল শিল্পীর যন্ত্রণা! এই ছবি সেই গোপন দুঃখে কান পেতেছে। শেষ দিকে অপরাজিতার চমৎকার একটি সংলাপ: ‘শিল্পী হতে ট্যালেন্ট লাগে, শিল্পীর বউ হতে সাহস লাগে।’
আড়াই ঘণ্টার ছবিতে অতঃপর ঢুকেছে মরুভূমিতে শিল্পীদের অপহরণ, ভারত-পাকিস্তান, হিন্দু-মুসলমান, কিশোর-রফি ইত্যাদি। কৌশিক শুধু রণ পায়ে তুষ্ট হননি, অপহরণের এই সাবপ্লটটিকে বিভিন্ন মশলা ছড়ানোর কাজে ব্যবহার করেছেন। যেমন এক, বাঙালি জাত্যভিমান: প্রসেনজিৎ বলে, ‘তুমি বা* বাঙালির কী বোঝ?’ অপরাজিতার হাতে বাঙালি রান্না খেয়ে ডাকাতরা বুঁদ। দুই, আবেগ: অপরাজিতা ডাকাতদের রেঁধে খাওয়ালেও নিজে দাঁতে কুটোটি কাটবে না। সোনায় বাঁধানো হৃদয় নিয়ে কিশোরকুমারের ভক্ত ডাকাত রাজেশ শর্মা সব জেনেবুঝে সবাইকে পালাতে দেয়। কিংবা যে ছেলের সঙ্গে প্রসেনজিতের বনে না, সে অসুস্থ বাবার সামনে কিশোরেরই গান গাইবে। তিন, অপরাজিতার মুখে চিরাচরিত চর্বিত চর্বণ: ‘আমরা শিল্পী, সাধারণ মানুষ। হিন্দু-মুসলমান, ভারত-পাকিস্তান আমরা বুঝি না’।
এই সব আবেগপ্রবণ মশলাদার রান্না অন্য সময়ে গুরুপাক, কিন্তু কিশোরের পুরনো ‘জ়িন্দেগি এক সফর’ বা ‘আমার স্বপ্ন তুমি’ শুনতে শুনতে গিলে ফেলেছি। আসলে পরিচালক ঝুঁকি নেননি। একটার পর একটা গান ঢুকিয়ে ছবির দৈর্ঘ্য বাড়িয়েছেন। প্রসেনজিৎও পাল্লা দিয়ে অভিনয়ে অনেক রং নিয়ে এসেছেন। প্রথমে উচ্ছল মাচা-গায়ক, মাঝে টিমের দাদা, দায়িত্বশীল বাবা ও স্বামী। শেষে হুইলচেয়ারে নীরব, শুধু চোখ দিয়ে জল পড়ে।
দুটো রণ পা চ়ড়েই তাই ছবির দৌড়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy