এই ধরনের পোস্ট ঘুরছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।
সিবিআইয়ের এফআইআরে তিনি প্রধান অভিযুক্ত। তাঁর বিরুদ্ধে প্রয়াত বন্ধুর অ্যাকাউন্ট থেকে বিপুল টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিয়োগ রয়েছে। শুধু সিবিআই-ই নয়, ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁকে জেরা করছে আর এক কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা— এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট। কিন্তু সে তো আইনি দিক। এরই সমান্তরাল ভাবে চলছে তাঁকে নিয়ে লাগাতার ট্রোলিং, তাঁর জাতি ও লিঙ্গ পরিচয় তুলে লাগামছাড়া কুৎসা। দেশের আদালতের কাঠগড়ায় ওঠার আগেই সমাজমাধ্যমের কাঠগড়ায় তুলে দোষী সাব্যস্ত করে দেওয়া হল সুশান্ত সিংহ রাজপুতের বান্ধবী রিয়া চক্রবর্তীকে! যার মূল উপজীব্য— তিনি ‘বাঙালি ডাইনি’।
ঘটনার সূত্রপাত সুশান্তের অফিসের এক কর্মচারির উক্তি থেকে। তিনি মুম্বই পুলিশের কাছে দেওয়া বিবৃতিতে দাবি করেছিলেন, রিয়া সুশান্তের উপরে ‘কালোজাদু’ প্রয়োগ করেছিলেন। তার পরেই রিয়া যে হেতু ‘বাঙালি’, তাই সব বাঙালি মেয়েই যে ‘বিশ্বাসঘাতক’ ও ‘বিপজ্জনক’ সেই প্রচারও শুরু হয়ে গেল টুইটার-সহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায়।
টুইটার ও ফেসবুকের অসংখ্য পোস্টে ‘কর্তৃত্ববাদী’ ‘সুযোগসন্ধানী’ ‘ধূর্ত’, ‘কালোজাদু বিশারদ’ এমন সব বিশেষণই ব্যবহার করা হয়েছে বাঙালি মেয়েদের সম্বন্ধে। একটি টুইটে লেখা হয়, ‘‘বাঙালি মেয়েরা জানে, কী করে ছেলেদের বাগে আনতে হয়। তুমি যদি নিজের পরিবার ছেড়ে ওদের চাকর আর টাকার জোগানদার হয়ে থাকতে চাও, তা হলে যাও।’’ বরখা ট্রেহান নামে স্বঘোষিক এক ‘পুরুষ-স্বরের’ ওই টুইটটি ভাইরাল হয়। একটি হুমকিতে ব্যঙ্গ করা হয়েছে বাঙালি পুরুষদেরও। তাতে বলা হয়েছে, ‘‘বাঙালি পুরুষরা ভিতু। আমাদের মতো মেয়েদের ঠিক রাস্তায় রাখতে পারে না। তাই বাঙালি মেয়েরা সহজেই হাতের বাইরে চলে যায়।’’ বাঙালি মেয়েদের নিয়ে এই ‘ট্রোলিং’-এর বিরুদ্ধে লালবাজারের ক্রাইম সেলে এফআইআর দায়ের করেছেন এক মহিলা।
আরও পড়ুন: সুশান্তের ডায়েরির ছেঁড়া পাতা প্রকাশ্যে, তাতে লেখা...
পুরুষতন্ত্র, বা বলা ভাল, গো-বলয়ের পুরুষতন্ত্রের তৈরি করা ‘মেয়েদের জন্য ঠিক রাস্তা’-র সংজ্ঞার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে বাঙালি নারীদের প্রতি বিদ্বেষ ও আক্রমণের শিকড়, মনে করেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবী বিদ্যাচর্চা কেন্দ্রের ডিরেক্টর নন্দিতা ধাওয়ান। তাঁর কথায়, ‘‘দেশের অনেক প্রদেশের মেয়েদের থেকেই বাঙালি মেয়েরা পড়াশোনা, চাকরি, বিবাহ, যৌনতার মতো বিষয়ে পছন্দের সুযোগ অনেকটা বেশি অর্জন করেছে। অবাঙালি পুরুষতান্ত্রিক দুনিয়ার কাছে এই স্বাধীনতা অস্বস্তির। এই ঘটনায় তারই প্রকাশ।’’
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপিকা শমিতা সেন বলছেন, ‘‘আঙুল তোলা আর অপরাধ প্রমাণ হওয়ার মাঝের যে পদক্ষেপ তাকে স্বীকার না করে এই মিডিয়া ট্রায়াল সোশ্যাল মিডিয়া আসার আগেও ছিল। কিন্তু সেই মিডিয়া ট্রায়ালের ক্ষেত্রেও একটা ছাঁকনি ছিল। সোশ্যাল মিডিয়ায় তা একেবারেই চলে গিয়েছে। তবে এমন আক্রমণ যে শুধু নারীদের বিরুদ্ধে হয়, তা নয়। পুরুষদের বিরুদ্ধেও হয়। তবে নারীদের ক্ষেত্রে এই ঘটনা বেশি, তার কারণ আমাদের সমাজের নারী চরিত্রায়ণের দীর্ঘ ইতিহাস।’’
তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘ব্রাহ্মণ্যধর্ম বরাবরই নারীকে, নারীর যৌনতাকে পুরুষের আধিপত্যে রাখতে চেয়েছে। মনুবাদ বরাবরই নারীর ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেয়েছে। অভিযুক্ত মেয়েটির সঙ্গে জাদুর যোগ খোঁজা তারই খুব প্রত্যাশিত প্রকাশ। কোনও পুরুষ অভিযুক্ত হলে তার ক্ষেত্রে জাদুর প্রসঙ্গ আসে না। কারণ সে ক্ষমতাবান। সমাজে নারীর সম্পর্কে বদ্ধমূল ধারণা, তার ক্ষমতা থাকারই কথা নয়। সেই ধারণাই নারীর ক্ষেত্রে জাদুর মতো প্রসঙ্গ যুক্ত করার ভাবনার পরিসর তৈরি করেছে। সমাজের সেই ধারণাই সোশ্যাল মিডিয়ায় তাই প্রকট হয়ে উঠেছে।’’
আরও পড়ুন: নগ্ন অবস্থায় উদ্ধার হয়েছিল সুশান্তের প্রাক্তন ম্যানেজার দিশার দেহ?
এ দেশেই যে কোনও প্রমাণ-বিচার ছাড়া ‘ডাইন’ অপবাদ দিয়ে মেয়েদের খুন করা হয়ে থাকে! এই ঘটনার সঙ্গে সেই মানসিকতারও যোগ রয়েছে বলে মনে করছেন সমাজতাত্ত্বিকরা। দিল্লির অম্বেডকর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রুক্মিণী সেন মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘বাংলা, বিহার, অসমে ডাইন অপবাদ নিয়ে নারী নির্যাতনের ধারা রয়েইছে। আরও একটা বিষয় ভেবে দেখা প্রয়োজন। তা হল সাম্প্রতিক একাধিক জনপ্রিয় সিরিয়াল, সিনেমায় বাঙালি নারী চরিত্রকে যে ভাবে আধিভৌতিক বৈশিষ্ট্য দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে, তাও বাঙালি মেয়েদের এই কালোজাদুর মতো যুক্তিহীন বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত করার ধারণাকে পুষ্ট করছে কি না।’’
তবে শুধু পুলিশে অভিযোগ করে বা শুধু আইন করে এই মানসিকতা বন্ধ করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন নন্দিতা। তাঁর কথায়, ‘‘আইনি পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ। তবে শুধু আইন করে পণপ্রথা বা গার্হস্থ্য হিংসা রোধ করা যায় না। আসলে নারীদের বিরুদ্ধে আক্রমণের যুক্তি খাড়া করতে কখনও সামাজিক প্রথার
অজুহাত দেওয়া হয়, কখনও আবার আইনে অভিযুক্ত হওয়ার অজুহাত দেওয়া হয়। এই বাস্তবকে বদলাতে না পারলে সমাজ হিসেবে আমরা ব্যর্থ হব।’’
আইনি পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ হলেও, তা যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন রুক্মিণীও। তাঁর কথায়, ‘‘আত্মবিশ্বাসী, স্পষ্টবক্তা, স্বাধীন মহিলাদের নিয়ে পুরুষতন্ত্রের সমস্যা সর্বজনসিদ্ধ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, জয়ললিতা প্রিয়াঙ্কা গাঁধী বা স্মৃতি ইরানির মতো রাজনীতিবিদকেও কদর্য নারীবিদ্বেষী আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছে। এ সব ক্ষেত্রে কুৎসাটা প্রকাশ্যে করা হলেও ক্ষমা কিন্তু প্রকাশ্যে চাইতে দেখা যায় না! নারী আন্দোলন এমন ধারণা, স্টিরিওটাইপ ভাঙার জন্য দীর্ঘদিন কথা বলেছে। তা আরও দরকার।’’
তাঁকে নিজেকে প্রতিনিয়ত অনলাইনে এমন আক্রমণের মুখোমুখি হত হয় বলে জানাচ্ছেন অভিনেত্রী, সাংসদ নুসরত জাহান। তিনি টুইটারে এই কুৎসার প্রতিবাদও জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘আমিও
সুশান্তের মৃত্যুর বিচার চাই এবং বিচারব্যবস্থার উপরে আমার আস্থা আছে। কিন্তু অভিযুক্ত বাঙালি বলে সব বাঙালিকে আক্রমণ করা একেবারেই অনুচিত।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy