রজনীকান্ত সেন ‘কান্তকবি’ নামেই বিশিষ্টতা অর্জন করেছিলেন। তাঁর গানের সমস্ত শ্রোতা তাঁকে কান্তকবি নামেই ভালবাসেন। সুদীর্ঘকাল ধরে তাঁর গান বাঙালি মননে এক হর্ষ-বিষাদের স্থান অধিকার করে রেখেছে। আজ তাঁর জন্মের সার্ধশতবর্ষে এই মানুষটিকে নিয়ে লিখতে বসে, বার বার মনে হচ্ছে, এই মানুষটির গান-কবিতা নিয়ে কেন আরও বেশি কাজ হল না?
বাঙালির চিত্তাকাশ যে ভাবে আবৃত করে আছেন রবীন্দ্রনাথ, বাকি তিন কবি, যথা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন এবং অতুলপ্রসাদ সেন কেন সেভাবে আবৃত করলেন না বাঙালি মননকে?
শিল্পী হিসাবে পৃথিবীর বাঙালি সমাজে যেহেতু ওই তিন কবির গান নিয়ে চর্চা করি, প্রতিনিয়ত তাই আমাকে এই প্রশ্ন তাড়া করে বেড়ায়। তবু আনন্দের কথা, আজ নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এই তিন কবির গান গাইছে, তাঁদের সম্পর্কে জানতে চাইছে। বাঙালির মনে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল, সেই শূন্যতা আস্তে আস্তে পূর্ণ করার চেষ্টা চলছে।
কে ছিলেন এই কান্তকবি? তাঁর জীবনী পড়লে জানা যায়, বাল্যজীবনে বিশেষ বৈচিত্র ছিল না তাঁর। আর পাঁচটা সংসারের জীবনধারা যেমন চলে, তেমনই একান্নবর্তী সচ্ছল ঘরের এই সন্তানটির বাল্যকাল কেটেছিল। পিতা গুরুপ্রসাদ সেন ছিলেন সরকারি কর্মচারী। বদলির চাকরি। সেই কারণে রজনীকান্তকে বাবার সঙ্গে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে হত। সেই সব দেশে ভ্রমণ, সেখানকার নদীর ঘাট, নদীতে স্টিমার লাগা, প্রাকৃতিক দৃশ্যাদি ভবিষ্যৎ জীবনে তাকে প্রভাবিত করে।
সন্ধ্যাবেলায় মাটির প্রদীপের সামনে বসা মায়ের কোলে বসতেন তিনি। মা বলতেন, রজন, এখন একটু পড়। যা পড়বে তাই আবার লেখ। তার পরেই মায়ের গলা জড়িয়ে আবদার, ‘মা, আজ মহাভারতের কথা কিছু বলো।’ বালক পুত্রের নিঃশব্দ একাগ্রতা ভাবিয়ে তুলত পিতা গুরুপ্রসাদকে।
একদিন রজনীকান্ত পিতাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচ্ছা বাবা! এ সব কে তৈরি করেছে?’
পিতা বললেন, কী সব!
পুত্র বললেন, এই নদী, এই নীল আকাশ, চাঁদ-তারা, এ সব কে তৈরি করল বাবা?
পিতা বললেন, তোমার মনে কী প্রশ্ন এসেছে বুঝতে পেরেছি। এই যা তোমার চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছ, সবই ঈশ্বরের তৈরি।
ওই যে ঈশ্বরের প্রতি সমর্পণ— শিশুবয়স থেকেই তা রজনীকান্তের মনে জাগ্রত ছিল।
রজনীকান্ত তাঁর স্বল্পায়ু জীবনে যে গানের ভাণ্ডার রেখে গেছেন, তার পরিধি রবীন্দ্র-নজরুলের মতো সংখ্যায় বিশাল না হলেও নিজস্বতার দীপ্তিতে ভরপুর। রাগ-রাগিণী পর্যাপ্ত পরিমাণে ব্যবহৃত হলেও, সুরারোপে খাঁটি বাঙালি ছিলেন রজনীকান্ত। বাউল ও কীর্তনের প্রভাব দেখা যায় তাঁর গানে। ভক্তি-স্বদেশ-হাস্য— এই তিনটি ধারা সাধারণত তাঁর গানে দেখা যায়। তবে ভক্তিমূলক গানই তাঁকে অমরত্বের অধিকারী করেছে।
রজনীকান্তের কন্যা শান্তিলতা রায়ের লেখাতে পাওয়া যায়— অনেক সময় কবি গান লিখে ফেলে রাখতেন। সব সময় গুছিয়ে রাখতেন না। কবির স্ত্রী হিরণ্ময়ী দেবী সেই গানগুলি যত্ন করে গুছিয়ে রাখতেন। কারণ, গাইবার সময় কবি অনেক সময় ছড়িয়ে রাখা গানগুলি খুঁজে পেতেন না। কিন্তু অসাধারণ তাৎক্ষণিক সঙ্গীত রচয়িতা হিসেবে খ্যাত ছিলেন তিনি। যে কোনও অনুষ্ঠানে বা সভায় আমন্ত্রণ এলে সঙ্গে সঙ্গে গান রচনা করে, সুর সংযোজন করে গেয়ে আসতেন।
শান্তিলতার কথায়: ‘‘রাত্রে বাবার ঘুম হয় না। উঠে বসে কাগজকলম নিয়ে লিখে যেতেন। রোগাক্রান্ত শরীরে যন্ত্রণার মধ্যে, ব্যথা ভুলে লিখে যাচ্ছেন— ‘এ উৎকট ব্যাধি দিয়ে কী সঙ্কটে ফেলে দিয়ে বুঝাইয়া দিয়েস মরে সকল চিকিৎসাতীত না হইলে নিরুপায়....তাই শরণ লইতে হল তোমারি চরণে পিতঃ। মধুরে ডেকেছ, তবুও চেতনা হয়নি প্রভু। অবিশ্রান্ত কষাঘাত না হলে কি জাগে চিতঃ?’
ডাক্তাররা পরামর্শ দিলেন বিলেত থেকে রেডিয়াম এনে একমাত্র চিকিৎসা সম্ভব। বাকি শরীরের যা অবস্থা তাতে রেডিয়াম এনে চিকিৎসা করতে দেরি হয়ে যাবে। সে ব্যবস্থার মধ্যে কেউ গেলেন না। মৃত্যুর কালো মেঘ ঘনিয়ে এসেছে। তার মধ্যেই বাবা আরও কয়েকটি গান বা কবিতা, যাই বলি, লিখলেন— ‘দাও ভেসে যেতে দাও তারে, এ প্রেমময় পরমেশ পাদোদক! তাহার চরণামৃত জুটেছে যে অশ্রুরূপে, দিও নাকো বাধা। যেতে দাও। আমার মরাল-মন ঐ চলে যায় কার গান গেয়ে, শোনো ঐ স্রোতোবেগ মধুর তরঙ্গ তুলি যেতে দাও। আসিয়াছে যেথা হতে— সে চরণে ফিরে চলে যাক।’
বোধহয় এটি বাবার শেষ রচনা।’’
আরও পড়ুন: আসছে দশেরা, ‘রাবণ ইন্ডাস্ট্রি’তে ব্যস্ততা এখন তুঙ্গে
দ্বিজেন্দ্রপুত্র দিলীপকুমার রায়ের কথায়: ‘‘এক এক জন মানুষ আসে, তাদের কীর্তি মুছেও যায়। স্বামী বিবেকানন্দ বলতেন তাঁর শিষ্যদের, ‘ওরে এসেছিস যদি, একটা দাগ রেখে যা।’ কান্তকবি রজনীকান্ত এমনই একটা দাগ রেখে গেছেন তাঁর গানে, কবিতায়, ছড়ায়, নকশায়। সর্বোপরি তাঁর ভক্তসমাজে। এ দাগ রেখে যেতে পারেন কেবল তাঁরাই, যাদের স্বধর্ম-ভক্তি, বা বলা যেতে পারে, যাঁদের ভগবান বরণ করে কাছে ডেকে নিয়েছেন ভক্তের টিকা ললাটে পরিয়ে। আমার পিতৃদেব তাঁকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলেন। দেখে এসে চোখের জল ফেলেছিলেন। আজও মনে আছে, তিনি বলেছিলেন, ‘ওরে ঘোর কলিতেও ভক্ত জন্মায় রে, জন্মায়। দেখে এলাম যা দেখবার মতো, যা কালেভদ্রে চোখে পড়ে। কী দারুণ রোগ! কিন্তু মুখে কী নির্মল হাসি রে! কথা বলার শক্তি নেই, কিন্তু প্রণাম করল আমাকে তেমনই প্রসন্ন মুখে। করুণা যার কাছে সত্য নয়, সে এ পাবে নারে পাবে না।’’
২০১১ সালে যখন আমি প্রথম ‘পঞ্চকবির গান’ নিয়ে শ্রোতাদের কাছে এলাম তখন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন, রজনীকান্ত সেনের গান মুষ্টিমেয় মানুষ গাইতেন। গত পাঁচ বছরের চেষ্টার ফসল এই গানের যুগান্তকারী নিজস্বতা নিয়ে বিস্তার। আমি কৃতজ্ঞ, ‘পঞ্চকবি’ আমার কাঁধে হাত রেখেছেন, পথ চলতে সাহায্য করছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy