কেমন হল ‘শ্রীকান্ত’? ছবি: সংগৃহীত।
হিন্দি ছবির ইতিহাসে এর আগেও আমরা দৃষ্টিশক্তিহীন চরিত্রকেন্দ্রিক গল্প অনেক দেখেছি। ‘অনুরাগ’, ‘স্পর্শ’, ‘ব্ল্যাক’, ‘ধনক’, ‘কাবিল’ প্রভৃতি ছবিতে প্রধান বা নেতিবাচক ভূমিকায় দৃষ্টিহীন চরিত্রকে ঘিরে গল্প অগ্রসর হয়েছে। পরিচালক তুষার হীরানন্দানি ‘শ্রীকান্ত’ ছবিটি বানিয়েছেন বোল্যান্ট ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম কর্ণধার শ্রীকান্ত বোল্লার জীবনকে কেন্দ্র করে। ‘শ্রীকান্ত’ আগামী ১০ মে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেতে চলেছে।
নব্বইয়ের দশকে একটি তেলুগু কৃষক পরিবারে শ্রীকান্ত দৃষ্টিশক্তিহীন হয়েই জন্মগ্রহণ করে। বাবা দামোদর জন্মের পরই অন্ধ সন্তানকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মা মৃত্যুর মুখ থেকে শ্রীকান্তকে ফিরিয়ে আনেন এবং স্বামীকে প্রতিশ্রুতি দেন, ছেলেকে নিজের আঁচলে বেঁধে রাখবেন, তাকে চোখের আড়াল করবেন না। কিন্তু, মায়ের প্রতিশ্রুতি কঠিন বাস্তবের সামনে বেশি দিন টিকল না। পদে পদে কিশোর শ্রীকান্তকে প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়। দৃষ্টিহীনতা শ্রীকান্তকে কোনও দিনই পড়াশোনা থেকে দূরে রাখতে পারেনি, খুব ছোট্ট বয়স থেকেই আমরা তার বুদ্ধির পরিচয় পাই, বিশেষত গণিত এবং বিজ্ঞানে, শ্রীকান্তের প্রখর জ্ঞান তাকে অন্য ছাত্রদের থেকে পৃথক করে। এক জন মেধাবী ছাত্রের মতো শ্রীকান্তও চায়, সে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করবে। কিন্তু বাধা দেয় আমাদের শিক্ষামাধ্যম, এক জন অন্ধ ছাত্র কোনও ভাবেই বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করতে পারবে না। নিজের অদম্য জেদ, ইচ্ছাশক্তি এবং সহনশীলতা শ্রীকান্তকে সাহস দেয় ‘সিস্টেম’-এর বিপরীতে লড়তে। তার জীবনের একটাই লক্ষ্য, সে ভারতের প্রথম দৃষ্টিশক্তিহীন রাষ্ট্রপতি হতে চায়, এবং ঘটনাক্রমে শ্রীকান্তের রাষ্ট্রপতি আব্দুল কালাম আজাদের সঙ্গে দেখাও হয়ে যায়, এবং তাঁকে মনের কথা জানায় সে। তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই, পরবর্তী কালে যখন শ্রীকান্ত নিজের ‘স্টার্টআপ’ খোলার জন্য বিনিয়োগকারী খুঁজছিল, তখন স্বয়ং রাষ্ট্রপতি তাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করেন, স্বনামধন্য শিল্পপতি রতন টাটাও শ্রীকান্তকে সাহায্য করেন তার অধ্যবসায় দেখে।
গল্প এগোয়, যখন শ্রীকান্তের জীবনে আবির্ভাব ঘটে মা যশোদার ভূমিকায় শিক্ষিকা দেবিকা (জ্যোতিকা)-র, যাঁকে শ্রীকান্ত নিজের আদর্শ মানে। ‘সিস্টেম’-এর বিরুদ্ধে লড়াই করে প্রথম দৃষ্টিশক্তিহীন ছাত্র হিসেবে বস্টনে এমআইটি-তে পড়াশোনাও করতে চলে যায়। ‘আমেরিকান ড্রিম’-এ কিছু দিন শ্রীকান্ত ডুবে থাকলেও শেষ পর্যন্ত সে দেশে ফিরে আসে এবং বন্ধুসম ব্যবসায়িক অংশীদার রবি মান্থার (শরদ কেলকার) সহযোগিতায় বোল্যান্ট ইন্ডাস্ট্রি শুরু করে। ‘শ্রী কা’ন্ট’ নয় ‘শ্রী ক্যান’— এটাকেই লক্ষ্য করে এগিয়ে চলে।
জগদীপ সিধু এবং সুমিত পুরোহিত ‘শ্রীকান্ত’-এর লেখকদ্বয় ছবির প্রথম ভাগে খুব সুন্দর ভাবে গল্পকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন, শ্রীকান্তের জীবন এবং পরিস্থিতি কঠিন হলেও দর্শকের মনে কখনও দয়ার উদ্রেক হয় না। উচ্চাকাঙ্ক্ষী শ্রীকান্ত কঠিন সময়ের সম্মুখীন না হয়ে কোনও দিন পালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবেনি। ছবির বার্তা এটাই।
অভিনয়ের দিক থেকে রাজকুমার রাও শ্রীকান্তের ভূমিকায় অতুলনীয়, এক জন অন্ধ ব্যক্তির শারীরিক ভাষা থেকে আচরণ, সব কিছু নিখুঁত ভাবে তুলে ধরেছেন। ছবির দ্বিতীয় ভাগে শ্রীকান্তের ক্রোধ, অহঙ্কার এবং নৈরাশ্যকে রাজকুমার দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন। যে কোনও আত্মজীবনীমূলক ছবিতে চরিত্রায়ন খুব বড় ভূমিকা পালন করে, রাজকুমার রাও ব্যতীত এই চরিত্র আর কেউ করতেই পারতেন না বলে মনে হয়। শুটিং শুরুর আগে রাজকুমার, শ্রীকান্ত বোল্লার সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছিলেন আর সেটা যে কতখানি কার্যকর ছিল, সেটার প্রমাণ পাওয়া যায় রাজকুমারের অভিনয়ে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমরা ছবিতে দৃষ্টিহীন চরিত্রকে কালো চশমা পরতে দেখি, কিন্তু ‘শ্রীকান্ত’-এ সেটা ব্যতিক্রম। রাজকুমার ছবিতে ‘প্রস্থেটিক লেন্স’ পরেছেন আগাগোড়া।
শিক্ষিকা দেবিকার ভূমিকায় জ্যোতিকা মানানসই। ‘শয়তান’ ছবির পর তিনি বুঝিয়ে দিলেন, ছবির জগতে তাঁর ফিরে আসাটা আকস্মিক নয়। শরদ কেলকারের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরের সঙ্গে তাঁর দৃপ্ত অভিনয়ও মনে দাগ কাটবে। ছবির নায়িকা আলায়া এফ-এর চরিত্র সীমিত। তাঁকে নিয়ে বেশি কিছু বলার নেই। ছবিতে ‘পাপা কহতে হ্য়ায়’ গানের ব্যবহার যথাযোগ্য এবং গানটিকে পুনরায় খুব সুন্দর ভাবে গাঁথা হয়েছে।
পরিচালক তুষার হীরানন্দানি, যিনি এর আগে ‘সান্ড কি আঁখ’, ‘স্ক্যাম ২০০৩’ পরিচালনা করেছেন, তিনিই ‘শ্রীকান্ত’ বানিয়েছেন খুব বাস্তবসম্মত ভাবে। ছবি দেখতে গিয়ে চোখের কোনা ভিজলেও পরমুহূর্তে হাসির ঝলকও দেখা যাবে। সেখানেই পরিচালকের কৃতিত্ব। কোনও রকম সমবেদনা না দেখিয়ে যে ভাবে ছবির বিষয়কে পরিচালক কৌতুকের মোড়কে পর্দায় তুলে ধরেছেন, তা বেশ প্রশংসনীয়। ছবির কিছু সংলাপ মনে দাগ কেটে যাওয়ার মতো— “দৃষ্টিহীন মানুষদের ব্যাপারে আপনারা একটা আলাদা ধারণা বানিয়ে রেখেছেন। আমরা নিছক সমবেদনার পাত্র নই, আমাদের বেচারা একদমই ভাববেন না।”
শ্রীকান্তের সীমাবদ্ধতাকে সহানুভূতিপূর্ণ ভাবে না দেখিয়ে, তাকে পরিবেশন করেছেন দক্ষতার সঙ্গে, খুব কম পরিচালক সেটা করতে পারেন। মধ্যান্তের পর ছবির গতি একটু মন্থর হয়ে গেলেও ২ ঘণ্টা ২ মিনিটের এই ছবি আপনাকে অনুপ্রাণিত করবে, সাহস জোগাবে, ভাবতে বাধ্য করবে যদি শ্রীকান্ত পারে, তা হলে আপনি এখনও কেন অপেক্ষা করে বসে আছেন? আমরা অনেক সময়েই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে দোষারোপ করি, কেন ভাল বাণিজ্যিক ছবি বানানো হচ্ছে না বলে। কিন্তু যখন বানানো হয়, তখন আমরা ছবিটির ওটিটি মাধ্যমে মুক্তির অপেক্ষায় থাকি। এটা ইন্ডাস্ট্রির সমস্যা নয়, দর্শকের মনোভাবের সমস্যা— এটা আমরা ভুলে যাই। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ‘লাপতা লেডিস’-এর পর ‘শ্রীকান্ত’-এর কপালেও হয়তো তা-ই লেখা আছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy