২০১০ সাল থেকে তাঁদের পথচলা শুরু। ১৩ বছরে একসঙ্গে আটটি ছবি করে ফেলেছেন তাঁরা। এ বার পুজোর ‘দশম অবতার’ তাঁদের একসঙ্গে নবম ছবি। না, কোনও নায়ক-নায়িকা জুটি নয়। তবে, এই জুটি দর্শকের কাছে যে কোনও নায়ক-নায়িকার চেয়ে বেশি সুপারহিট— প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় এবং সৃজিত মুখোপাধ্যায়। ‘অটোগ্রাফ’, ‘২২শে শ্রাবণ’, ‘জাতিস্মর’-এর মতো একাধিক হিট ছবি দিয়েছেন যাঁরা। এই পুজোয় আবার থ্রিলার নিয়ে ফিরছে এই জুটি। যে-সে থ্রিলার নয়। ‘২২শে শ্রাবণ’ এবং ‘ভিঞ্চি দা’-র দুনিয়া মিলিয়ে কপ ইউনিভার্স তৈরি করেছেন পরিচালক। একসঙ্গে সিরিয়াল কিলারকে ধরবে প্রবীর রায়চৌধুরী ও বিজয় পোদ্দার। তা হলে বাঙালির পুজো এ বার ভালই কাটবে? আনন্দবাজার অনলাইনকে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘‘মনে তো হচ্ছে।’’
‘দশম অবতার’-এর ট্রেলার মুক্তি পেয়েছিল বেশ কিছু দিন আগেই। সেখানেই ঝলক মিলেছে ‘২২শে শ্রাবণ’, ‘ভিঞ্চি দা’ এবং খানিকটা ‘দ্বিতীয় পুরুষ’-এর মারকাটারি কিছু সংলাপের। নস্ট্যালজিয়া উস্কে দেওয়ার জন্য সেটুকুই যথেষ্ট। প্রসেনজিৎ অবশ্য বললেন, ‘‘সৃজিত অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপ লেখে। ভাল সংলাপ অনেকেই লেখে। কৌশিক (গঙ্গোপাধ্যায়) যেমন দারুণ সংলাপ লেখে। কিন্তু অঞ্জনদা (চৌধুরী) এবং পরে খানিকটা সলিল যেটা পারত, সেই ক্ষমতা এখন সকলের নেই। সংলাপেই হাততালি পড়বে। হিন্দিতে এখনও এমন সংলাপ পাওয়া যায়। বাংলায় একমাত্র সৃজিত সেটা পারে।’’

‘দশম অবতার’ ছবিতে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
সৃজিতকে নিয়ে যে কোনও কথা বলার সময়ে প্রসেনজিতের কণ্ঠে ভেসে ওঠে স্নেহের সুর। তা হওয়াটাও স্বাভাবিক। প্রায় এক যুগ ধরে দেখেছেন পরিচালককে। একদম প্রথম ছবি থেকে। শিল্পী হিসাবে কতটা বদলাতে দেখলেন সৃজিতকে? উত্তরে প্রসেনজিৎ বললেন, ‘‘প্রথম ছবিতে ও যতটা আত্মবিশ্বাসী ছিল, এখনও ততটাই আছে। তবে যে কোনও পেশায় অভিজ্ঞতা মানুষকে আরও পরিণত করে। সেটা ওরও হয়েছে। এখন পোস্ট প্রোডাকশনের ভাবনাটা নিয়েই সেটে মনিটরে বসে। বলে দিতে পারে কোন লেন্স লাগালে কোন শটে বেশি ভাল লাগবে। তবে একটা জিনিস আমি আলাদা করে বলতে চাই। অভিনেতাদের নির্দেশনার ক্ষমতা ওর বরাবরই তুখড়। হয়তো ও নিজে থিয়েটার করত বলে অভিনয়ের প্রতি দুর্বলতা রয়েছে। নিজে কিন্তু কখনও অভিনয় করে দেখায় না। কিন্তু ফ্লোরে অভিনেতাদের ভেঙে কী ভাবে যেটা চাইছে, সেটা বার করে নিতে হয়, সেটা ও খুব ভাল ভাবে জানে।’’ ‘অরুণ’, ‘প্রবীর’, ‘কুশল’— বহু বার বহু বৈগ্রহিক চরিত্রে প্রসেনজিৎকে ভেবেছেন সৃজিত। এবং বার বার তাঁকে অভিনেতা হিসাবে ভাঙতে বাধ্য করেছেন। প্রথম ছবির স্মৃতিতে ডুব দিলেন প্রসেনজিৎ, ‘‘অটোগ্রাফে একটি দৃশ্য ছিল, যেখানে মদের গ্লাস হাতে কথা বলছে অরুণ। সেখানে আমার মনে আছে, সিগারেটের ছাই কী ভাবে পড়বে, তা-ও ওর জানা। অনেক সময়ে ফ্লোরে সৃজিতের অনেক জিনিস বাড়াবাড়ি মনে হয় আমাদের। ভাবি, ঠিকই তো আছে, আবার কেন একটা শট লাগবে? পরে যখন পর্দায় দেখি, তখন বুঝি, ও যেটা চেয়েছিল, সেটাই বেশি ভাল।’’
পরিচালক যে প্রসেনজিতের বিশেষ স্নেহের পাত্র, তা তো স্পষ্ট। কিন্তু স্নেহের পাশাপাশি শাসনও কি করেন অভিনেতা? এত বছরে পরিচালকের কোনও ছবি দেখে খারাপ লাগলে সেগুলি নিয়ে কি আলোচনা হয় দু’জনের। প্রশ্ন শুনেই প্রসেনজিৎ বললেন, ‘‘যেটা ভাল লাগে, সেটা বলি। কিন্তু যেটা খারাপ লাগে সেটা অনেক সময়ে বলি না। নিজের মতো করে বলি অবশ্য। হয়তো ওকে ডেকে বললাম, ‘সৃজিত, এ বার একটা ফর্মে হোক’। (হাসি) আসলে ক্রিকেটারদের মতো আমাদের জীবনেও ফর্ম মাঝেমাঝে চলে যায়। আমাদের নিজেদেরই ফিরতে হয়। অনেক সময়েই আসলে আমরা একটু অন্য রকম কাজ করার চেষ্টা করি, যেগুলি ঠিক খাপে খাপ হয় না। ওকে যেমন মাঝেমাঝে বলি, ঠিক আছে দুটো ছবি বানিয়ে ফেলেছিস, এ বার তোর একটা ফর্মের দে তো। ‘দশম অবতার’ ওর ফর্মের ছবি।’’
‘২২ শে শ্রাবণ’-এর মতো ছবি করার ইচ্ছা প্রসেনজিতের অনেক দিন ধরেই ছিল। সৃজিতকে তিনি জানিয়েছিলেনও। তবে প্রিক্যুয়েলের ভাবনা যে সৃজিত ফাঁদবেন, তা কল্পনাও করতে পারেননি অভিনেতা। এতে মুশকিল একটাই হয়েছে। ২০ বছর বয়স পিছিয়ে যেতে হয়েছে। শরীরের সেই গঠন পাওয়ার জন্য বিস্তর পরিশ্রম করতে হয়েছে প্রসেনজিৎকে। তবে তিনি চ্যালেঞ্জটা খোলা মনে নিয়েছিলেন। কারণ, তিনি বিশ্বাস করেন, বৈগ্রহিক চরিত্রদের পর্দায় ফিরে আসা উচিত। তিনি বললেন, ‘‘বিশ্ব জুড়ে এটাই তো চলছে। আইকনিক চরিত্রদের সোয়্যাগেই ছবি চলে। হলিউডে হলে এখানে আমরা কেন পারব না। আমাদের উচিত, নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে সব স্বত্ব সামলে নেওয়া। কাকাবাবু, ফেলুদা, ব্যোমকেশ কেন একটা ছবিতে একসঙ্গে রহস্যের সমাধান করতে পারবে না! মানুষ বসে আছেন এই ধরনের ছবি দেখার জন্য।’’
আরও পড়ুন:
এ বছরটা অভিনেতা প্রসেনজিতের জন্য খুবই ভাল। একসঙ্গে অনেক ধরনের চরিত্রে তাঁকে দেখা গিয়েছে। কখনও ‘কাবেরী অন্তর্ধান’, কখনও ‘শেষ পাতা’, কখনও ‘স্কুপ’, আবার কখনও ‘জুবিলি’— প্রত্যেকটা ছবি বা সিরিজ়েই তাঁকে অন্য ভাবে দেখা গিয়েছে। এ বার ‘দশম অবতার’-এর প্রবীরকে দেখার জন্যও মুখিয়ে রয়েছে দর্শক। প্রসেনজিৎ জানালেন, কিছু চরিত্র তাঁকে এতটাই নিংড়ে নিয়েছে যে, চাইলেও দ্বিতীয় বার সেগুলি করা সম্ভব নয়। যেমন কুশল বা বাল্মীকি। কিন্তু কিছু চরিত্র এতটাই তিনি আত্মস্থ করে ফেলেছেন যে, কোনও হোমওয়ার্ক ছাড়াই ফের সেগুলি করে ফেলবেন। যেমন প্রবীর রায়চৌধুরী দ্বিতীয় বার করার সময়ে তাঁকে নতুন করে ‘২২শে শ্রাবণ’ দেখতে হয়নি। ছবিতে প্রবীর কখন কোন ভঙ্গি করেছিল, সব মনে আছে প্রসেনজিতের।
২০২৩-এর পুজো নিয়ে আশাবাদী প্রসেনজিৎ। তিনি মনে করেন, গত দু-তিন বছরে সিনেমা হলের যে ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছিল, তা এ বছর ‘জওয়ান’, ‘পাঠান’, ‘গদর ২’ অনেকটা মিটিয়ে দিয়েছে। দক্ষিণী ছবি তো রয়েছেই। তবে এই পুজোয় চারটি বাংলা ছবি নজির গড়ার মতো ব্যবসা করবে বলেই তাঁর ধারণা। তিনি বললেন, ‘‘চারটে ছবিই নিজ গুণে দর্শক টানবে হলে। সব মিলিয়ে বিপুল ব্যবসা করবে। এবং আমাদেরও বলার মতো একটা জায়গা তৈরি হবে। পুজোয় বক্স অফিস সারা দেশে ছাপ ফেলবে। তখন আর আমাদের বাংলা ছবির পাশে দাঁড়ানোর কথা বলতে হবে না।’’