ভারতীয় সিনেমায় ধর্ষণের চিত্রায়ণ এক জটিল পথ পরিক্রমা করেছে। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
শহরতলির প্রেক্ষাগৃহটির সামনে লম্বা লাইন। ম্যাটিনি শো শুরু হতে আর হয়তো বড়জোর আধ ঘণ্টা রয়েছে। একটু দূরের গাছতলায় চেক লুঙ্গি আর লাল গেঞ্জি পরিহিত এক যুবক রিয়ার স্টলের টিকিট দ্বিগুণ দামে ‘ব্ল্যাক’ করছেন। দুই কিশোর সে দিন স্কুল পালিয়েছে। স্কুলশার্ট ব্যাগে ঢুকিয়ে সেখান থেকে রঙিন টিশার্ট বার করে গায়ে চড়িয়ে সেই ব্ল্যাকারের কাছ থেকেই টিকিট কিনে হলে প্রবেশ। এই ‘বই’ না দেখলেই নয়! চায়ের দোকান থেকে মোড়ের জটলা একে নিয়ে। “হুঁ হুঁ বাওয়া, দু-দু’খানা জবরদস্ত রেপ!” এ কথা শোনার পর বয়ঃসন্ধির উজানগঙ্গায় ঢেউ ফুঁসে ওঠে ষাঁড়াষাঁড়ির বানের মতো। অতএব, পালাও স্কুল…
‘ইনসাফ কা তরাজ়ু’। বিআর চোপড়া পরিচালিত, জ়িনাত আমন, রাজ বব্বর, পদ্মিনী কোলহাপুরে, দীপক পরাশর অভিনীত সেই ছবি নিয়ে তখন শহর-শহরতলি-মফস্সল উত্তাল। নিতান্ত প্রতিশোধ ঘরানার সেই ছবি আর পাঁচটা মূলধারার হিন্দি ছবির চাইতে আলাদা কিছু নয়। তবু, তার ইউএসপি ছিল অন্য জায়গায় নিহিত। দু’খানি ধর্ষণ-দৃশ্য। বিশেষ করে পঞ্চদশী পদ্মিনীকে ভয় দেখিয়ে খলনায়ক রাজ বব্বরের ধীরে ধীরে অনাবৃত করার দৃশ্য নিয়ে তখন শোরগোল চারিদিকে। এক দিকে সমালোচনা— কী ভাবে এক জন অপ্রাপ্তবয়স্কাকে এমন দৃশ্যে অভিনয় করানো যায়! অন্য দিকে, পুং-বৃত্তে গুঞ্জন সেই বিশেষ দৃশ্যের ভিন্নতর ‘নন্দন’ নিয়ে। ১৯৮০-তে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ইনসাফ কা তরাজ়ু’-তে ধর্ষণ বিষয়টিকে যতটা না সামাজিক ক্ষত হিসাবে দেখানো হয়, তার থেকে অনেক বেশি প্রদর্শিত হয় এক বিশেষ ‘নন্দন’-এর আঙ্গিকে। চলচ্চিত্র আলোচক সোমা চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘বলিউড সিনেমা ক্যালাইডোস্কোপ’ গ্রন্থভুক্ত ‘হিন্দি সিনেমা: রিপ্রেজ়েন্টেশন অফ ল অ্যান্ড জুডিশিয়ারি’ শীর্ষক প্রবন্ধে বিষয়টি আলোচনা করেছেন আইন ও বিচার ব্যবস্থাগত দৃষ্টিকোণ থেকে। তাঁর মতে, বিআর চোপড়ার এই ছবি বলিউডে এক নতুন ‘ট্রেন্ড’ বা ধারার সূত্রপাত করে, যেখানে ধর্ষণকে অপরাধ’ ও ‘সামাজিক ক্ষত’ হিসাবে প্রদর্শনের একটা ভান বজায় থাকলেও আসল উদ্দেশ্য থাকে অন্য। চলচ্চিত্র আলোচক শান্তনু চক্রবর্তীকে এ প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করায় তিনি জানালেন, ‘ইনসাফ কা তরাজ়ু’ জাতীয় ছবিতে ধর্ষণ এসেছে দর্শকদের মনান্তরালে থাকা ধর্ষকামী তথা দর্শকামী প্রবৃত্তিকে চরিতার্থ করাতে। এমন ক্ষেত্রে ধর্ষণও হয়ে ওঠে এক ‘নান্দনিক’ বিষয়।
বলিউডি মূলধারার ছবিতে ধর্ষণ যখন এমন চেহারায় অবতীর্ণ, তখন বাংলা ছবিতে বিষয়টি ভিন্ন কিসিমে উপস্থাপিত। ‘ইনসাফ কা তরাজ়ু’র দু’বছর পরে তপন সিংহ তৈরি করেন ‘আদালত ও একটি মেয়ে’। ১৯৮২-র সে ছবিতে অভিনয় করেছিলেন তনুজা, মনোজ মিত্র, নির্মলকুমার প্রমুখ। উল্লেখ্য, সেখানে ধর্ষণদৃশ্যটিকে এমন ভাবে দেখানো হয়, যা পূর্বোল্লেখিত উদ্দেশ্যের একেবারে বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে। ধর্ষণ কখনওই সেখানে দর্শকের মনান্ধকারের ‘খেলনা’ হিসাবে প্রদর্শিত নয়। বা বলা ভাল, ধর্ষণের অছিলায় নারীশরীর দেখানোর কোনও চেষ্টা তপনবাবু করেননি। এমনকি, আদালতে যখন মামলাটি ওঠে তখন তার সুরতহাল তদন্তের বিষয়টি বিশদ উঠে এলেও তা এক লহমার জন্যও ‘ইরোটিক’ উস্কানির দিকে ঢলে পড়েনি।
‘ইনসাফ কা তরাজ়ু’ বা ওই জাতীয় ছবির সঙ্গে ‘আদালত ও একটি মেয়ে’র চরিত্রগত পার্থক্য লক্ষণীয় ছিল। প্রথমোক্ত ছবিটি বলিউডে ‘প্রতিশোধপরায়ণা নারী’ আর্কিটাইপের সূত্রপাত ঘটায়, যা আজও বিভিন্ন ছবিতে ব্যবহৃত হয়ে চলেছে। কিন্তু, ‘আদালত ও একটি মেয়ে’র উপজীব্য ছিল ধর্ষণ-পরবর্তী সময়ে নির্যাতিতার প্রতি সমাজ ও আইনের সংবেদ। বিচার প্রক্রিয়ার জটিলতা এবং সমান্তরালে সামাজিক উৎকণ্ঠা ও টানাপড়েনকেই তপনবাবু তুলে ধরেছিলেন। অবশ্য এখানে কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন, বিআর চোপড়ার মতো এক সম্পূর্ণ ‘বাণিজ্য’-মুখী পরিচালকের সঙ্গে তপন সিংহের মতো তথাকথিত সমান্তরাল ধারার পরিচালকের তুলনা করা কি ঠিক? এই জায়গায় উত্থাপন করা যেতে পারে কাছাকাছি সময়ে তোলা হিন্দি সমান্তরাল ছবির প্রসঙ্গ। ১৯৮০ সালেই মুক্তি পায় গোবিন্দ নিহালনি পরিচালিত ছবি ‘আক্রোশ’। যেখানে জনৈক শ্রমিকের স্ত্রীকে লালসার শিকার হতে হয় কিছু উচ্চবর্গীয় ক্ষমতাবানের। স্ত্রী লোকলজ্জার ভয়ে আত্মহত্যা করে এবং শ্রমিককে এক মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়। শ্রমিকের বাবার মৃত্যু হলে শেষকৃত্যের জন্য তাকে পুলিশ প্রহরায় নিয়ে আসা হয় শ্মশানে। পিতার জ্বলন্ত চিতার সামনে দাঁড়িয়ে সে দেখতে পায়, তার যুবতী বোনের দিকে ধাবিত হচ্ছে সেই ক্ষমতাবানের লালসাপূর্ণ দৃষ্টি। সে তখনই একটি কুড়ুল দিয়ে নিজের বোনকে হত্যা করে। এখানে নিহালনির নজর ছিল ভারতীয় গ্রামসমাজে নিম্নবর্গের অবস্থানকে একান্ত ভাবে তুলে ধরার দিকে। গ্রামসমাজে ক্ষমতাবানের সামনে যে কোনও আক্রোশই যে নিষ্ফল, তা নির্মম ভাবে দেখনোর। শ্রমিকের ভূমিকায় ওম পুরির মুখে প্রায় সংলাপহীনতা এই ছবিকে অন্য মার্গে নিয়ে গিয়েছিল। স্ত্রীকে যখন তার চোখের সামনেই ধর্ষণ করা হয় তখন, এবং ছবির শেষ ভাগে বোনকে হত্যা করার পর সে প্রবল আক্রোশে শুধু অর্থহীন চিৎকার করে ওঠে। ধর্ষণের বিশদ দৃশ্যায়ন সেখানে ছিল না। ছিল সেই সময়ে শ্রমিকটির অসহায় অবস্থার চিত্রণ। সুতরাং, ধর্ষণদৃশ্য দেখানোর জন্য নারীশরীর প্রদর্শনের যে প্রয়োজন পড়ে না, তা নিহালনি দেখিয়েছিলেন।
এর আগে ১৯৭৪-এ ‘নিশান্ত’ ছবিতে শ্যাম বেনেগাল গ্রামীণ স্কুলশিক্ষকের স্ত্রীকে ক্ষমতাবান ভূস্বামীদের দ্বারা ধর্ষিতা হওয়ার ঘটনাকে তুলে ধরেছিলেন। সেখানেও কিন্তু শরীর প্রদর্শনের বিষয়টি প্রকাশ্যে আনা হয়নি। তার প্রয়োজনও পড়েনি। কিন্তু, ‘ইনসাফ কা তরাজ়ু’ থেকে বলিউডি মূলধারার ছবিতে ধর্ষণদৃশ্যের অবতারণায় কেন বার বার শরীর প্রদর্শনের দরকার পড়ল, তা অনুমান করা খুব কঠিন কিছু নয়। ‘নিশান্ত’ বা ‘আক্রোশ’-এর মতো ছবিতে ধর্ষণ ছিল ক্ষমতাবান পুরুষের শক্তি প্রদর্শনের পরিসর। সেখানে নারীর অসহায়ত্বের সমান্তরালে জাতপাত এবং দারিদ্রে নুয়ে পড়া পুরুষের অসহায়তাকেও দেখানো হয়েছিল। অন্য দিকে ‘ইনসাফ কা তরাজ়ু’ দেখাতে চেয়েছিল এমন এক ইচ্ছাপুরণের জগৎকে, যেখানে নির্যাতিতা নারী নিজের হাতে শাস্তি দিচ্ছে এক সময়ের নির্যাতনকর্তাকে। ফলে, ধর্ষণদৃশ্যকে বিশদ করে যখন দর্শকের মধ্যে এক রকমের রিরংসার সৃষ্টি করা সম্ভব হয়ে উঠছে, তখন একই সঙ্গে তার পরিণতিতে আইনকে টপকে নারীর নিজহাতে ধর্ষণকারীকে শাস্তি দেওয়ার সানুপুঙ্খ দৃশ্যায়নও দর্শকের কাছে উপভোগ্য হয়ে উঠছে।
১৯৮৮ সালে অবতার ভোগল পরিচালিত ‘জ়খমি আওরত’ দর্শক মহলে বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। তার অন্যতম কারণ, এখান ধর্ষিতা নিজেই আইনরক্ষক। পুলিশ আধিকারিক কিরণ দত্ত এমনিতে দাপুটে মহিলা হলেও তাকে ধর্ষিত হতে হয় ছ’জন দুষ্কৃতীর হাতে। আইনের কাছে সাহায্য চেয়ে না পেয়ে কিরণ আইন নিজের হাতেই তুলে নেয় এবং তার ধর্ষকদের একে একে পুরুষাঙ্গ ছেদন করে শাস্তি দেয়। এখানে ধর্ষণদৃশ্যটি ছিল একই সঙ্গে প্রতীকী ও বিস্তারিত। কিরণের নিম্নাঙ্গ থেকে তার জিন্স এবং অন্তর্বাস খুলে নিয়ে তা চলন্ত ফ্যানের ব্লেডে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়, তার পর তার পা দু’খানি বেঁধে তাকে ধর্ষণ করে দুর্বৃত্তেরা। এই দৃশ্যে পাখার ঘূর্ণন আর নির্যাতিতা নারীর আর্তি একীভূত হয়ে একই সঙ্গে উদ্বেগ ও যৌন প্রণোদন তৈরি করে, যা আসলে দর্শকের কাছে অনুভূতির ‘ব্যাঙ্কিং’ ছিল। এই সঞ্চয় থেকেই দর্শক পুরুষাঙ্গ কর্তনের মতো কাজেও তৃপ্তিলাভ করে। একই ভাবে অগণিত ছবি তৈরি হয়েছে ‘রিভেঞ্জিং উওম্যান’ কল্পকে ভিত্তি করে। তার একটা বড় অংশ অবশ্যই ‘বি মুভি’।
১৯৮০-র দশকটি ছিল ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক বিশেষ দশক, যখন শহরের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে গ্রাম এবং মফস্সলেও সিনেমাহলের প্রসারণ ঘটে। সিনেমাহল বিষয়টিই ছিল একান্ত ভাবে পুরুষতান্ত্রিক। বেশির ভাগ প্রেক্ষাগৃহে আলাদা করে ‘লেডিজ়’ তকমা লাগানো একটা দেওয়াল দিয়ে পৃথক করা পরিসর থাকত মহিলাদের জন্য। বাকি পুরো হলেই পুরুষদের রাজত্ব। টিকিট বিক্রেতা থেকে ‘আশার’ (যিনি লাইটম্যান হিসাবেই সমাধিক পরিচিত ছিলেন), ৭৫ পয়সার ফ্রন্ট স্টলের দামাল দর্শকদের লাইন ম্যানেজ করার জন্য হলমালিকের পোষা লাঠিধারী পাইকবাহিনী থেকে হাতছিপ্পু করে “দশ কা বিশ— বিশ কা তিশ” আউড়ে চলা ব্ল্যাকার পর্যন্ত সবাই পুরুষ। মহিলারা যে সেই পরিসরে প্রবেশ করতেন না, তা নয়। তাঁরা অবশ্যই যেতেন, কিন্তু পুরুষ সঙ্গী নিয়ে। ম্যাটিনি শোয়ে অবশ্য বাংলা ছবির জন্য ‘লেডিজ়’-এ ননদ-ভাজ, জা বা পাড়াতুতো কাকিমার সঙ্গ ধরে কিশোরীরা উদিতা হতেন। বাকি সময়টা পুরুষদেরই রাজত্ব। এমত পরিসরে আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয় ‘নুন শো’র বন্দোবস্ত। প্রথম দিকে কিছু হলে ইংরেজি ছবি (মূলত পুরনো) চালানো হলেও কিছু দিনের মধ্যে তার জায়গা দখল করে মালয়ালাম বি-গ্রেড ছবি। মজার ব্যাপার, আইভি শশীর মতো খ্যাতনামা পরিচালকের ছবিও নুন শো-য় জায়গা করে নেয়। মালয়ালাম ভাষায় ছবির নাম যা-ই হোক না কেন, তার একটা ইংরেজি নাম দেওয়া থাকত ছবির পোস্টারে। এ ধরনের ছবির ইংরেজি নামকরণে প্রায়শই স্থান পেত ‘রেপ’ শব্দটি। পরবর্তী কালে যে জনসমাজকে সমাজবিদেরা ‘প্রান্তিক’ হিসাবে চিহ্নিত করেন, তেমন আর্থ-সামাজিক পরিমণ্ডলের পুরুষদের পাশাপাশি নুন শোয়ের অন্যতম দর্শক ছিল স্কুলপড়ুয়া কিশোরের দল। আর কিছু না থাক, পোস্টারে ‘রেপ’ শব্দটিই জানিয়ে দিত সে সব ছবিতে ‘কিছু একটা আছে’। এই ‘আছে’র ছলনে ভুলে একটা-আধটা ধর্ষণদৃশ্যের প্রসাদকণিকা লাভের জন্য যে আকুতি সে সময় দেখা গিয়েছিল, তা ধুয়ে সাফ হয়ে যায় ভিডিয়ো ক্যাসেটের যুগ শুরু হলে। মোটামুটি ভাবে আশির দশকের উপান্ত থেকেই ভিডিয়ো ক্যাসেটের রমরমা শুরু হয়। বিদেশি থ্রি এক্স পর্যন্ত যাদের হাত পৌঁছত না, সেই সব দুরু দুরু বক্ষের কিশোরের কাছে একখানি ফাঁকা বাড়ি আর ‘ইনসাফ কা তরাজ়ু’ বা ‘জ়খমি আউরত’-এর মতো ছবির ক্যাসেট ছিল হুলালালা অ্যাডভেঞ্চার। লক্ষণীয়, ধর্ষণ তখন আর ঘৃণ্য অপরাধ নয়, তা যেন একটা উদ্যাপনের অঙ্গ। নারীপৃথিবীর সঙ্গে এ দুনিয়ার বিশেষ লেনাদেনা ছিল না।
একান্ত পুরুষ সমাজের জন্য এ হেন ছবি নির্মাণের সমান্তরালে কিন্তু মূলধারার কিছু ছবিতে ধর্ষণ এসেছে অন্য চেহারায়। ১৯৮১-র সুপারহিট ছবি ‘এক দুজে কে লিয়ে’-র অন্তিম দৃশ্যে নায়িকার ধর্ষণ ও নায়ক-নায়িকার মৃত্যু কোনও রকম ইরোটিক অনুষঙ্গকে বহন করেনি। কমল হাসন আর রতি অগ্নিহোত্রী তখন বৈগ্রহিক পর্যায়ে উন্নীত। ধর্ষণের এই উল্টো চেহারাটিও কিন্তু মাঝেমাঝে মূলধারার ছবিতে উঁকি দিয়েছে। তবে তার সংখ্যা হাতেগোনা।
এখানে একটা প্রশ্ন উঠতেই পারে, সামগ্রিক ভাবে ধর্ষণ সম্পর্কে সামাজিক সংবেদ ঠিক কেমন ছিল? ধর্ষিতাকে সমাজ কী চোখে দেখত, তার এক বিস্তারিত ন্যারেটিভ তপন সিংহ ‘আদালত ও একটি মেয়ে’ ছবিতে রেখেছিলেন। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের উপন্যাস ‘কৃষ্ণা বাড়ি ফেরেনি’ অবলম্বনে শঙ্কর ভট্টাচার্যের পরিচালনায় ‘অন্বেষণ’ ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৮৫-তে। মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি অবিবাহিতা মেয়ের ধর্ষণ ও হত্যা ছবির ভরকেন্দ্র। প্রদীপ মুখোপাধ্যায়, সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়, বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়, সোমা চট্টোপাধ্যায় অভিনীত এই ছবিতে ছোট বোনের ধর্ষণ ও মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আলোড়িত হয় বড় ভাইয়ের প্রণয় সম্পর্ক। আলোড়িত হয় ছোট শহরের পরিমণ্ডলও। কেন্দ্রে ধর্ষণ থাকলেও সিরাজের কাহিনি কিন্তু তাকে প্রেক্ষাপট হিসাবেই রেখে দেয়। ছবিতে পরিচালকও চেষ্টা করেছিলেন ঔপন্যাসিকের সেই অভিপ্রায়টিকে বজায় রাখতে।
এখানে আরও একটি কথা বলা প্রয়োজন। ‘অন্বেষণ’-এর মতো ছবির দর্শক ছিলেন মূলত বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যেরা। সেখানে ‘মূল্যবোধ’ বিষয়টি বড় ভূমিকা নিত। ফলে ধর্ষণকে বা ধর্ষণদৃশ্যকে প্রলম্বিত করার প্রয়োজন পরিচালকেরা বোধ করতেন না। দিলীপ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত ‘ফাদার’ ছবির টাইটেল কার্ড প্রদর্শনের ফাঁকেই ধর্ষণদৃশ্য দেখানো হলেও, তার মধ্যে বলিউডি মশলার অবতারণা করার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করা হয়নি। একটু তলিয়ে ভাবতে বসলে বোঝা যায়, বাংলা ছবি ধর্ষণকে সে সময় ‘মূল্যবোধের সার্বিক অবক্ষয়’-এর অভিজ্ঞানচিহ্নের চৌহদ্দি টপকে দেখাতে চায়নি। তপন সিংহ পরিচালিত ‘রাজা’ (১৯৭৫) ছবিতে মফস্সলের নিম্ন মধ্যবিত্ত বাড়ির অবিবাহিতা মেয়ের শহরে গিয়ে দেহোপজীবিনীর বৃত্তি অবলম্বনকে যেমন ‘সামাজিক অবক্ষয়’-এর চিহ্ন হিসাবে দেখানো হয়েছিল, আশির দশকের বাংলা ছবিতেও ধর্ষণ উপস্থাপিত হয় সেই একই আঙ্গিকে। সত্তরের বেপথু যুবসমাজের ‘সিগনিফায়ার’ হিসাবেই বেশির ভাগ বাংলা ছবিতে ধর্ষণ ব্যবহৃত হয়।
এরই সমান্তরালে যদি সমকালীন বাংলা সাহিত্যকে দেখা যায়, তা হলেও মধ্যবিত্তের ন্যায়-নীতি আর মূল্যবোধের নিক্তিতে ধর্ষণকে মাপার একটা প্রয়াস লক্ষণীয় ছিল, বলাই যায়। মতি নন্দীর উপন্যাস ‘সাদা খাম’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৯০-এ। তার আগে সেটি প্রকাশ পেয়েছিল একটি পত্রিকার পূজাসংখ্যায়। সেখানে আত্মপরিচয় গোপন করে আজীবন চাকরি করে যাওয়া এক ছাপোষা নিম্ন মধ্যবিত্ত পুরুষের জীবনকে সম্পূর্ণ ওলটপালট করে দেয় তার বন্ধুর এক ধর্ষিতা কন্যা। ধর্ষিতা মেয়েকে তার নিজের বাড়িতে জায়গা দিতে নারাজ, এমতাবস্থায় সে যখন গিয়ে আশ্রয় চায় সেই আত্মপরিচয় গোপনকারী ব্যক্তিটির কাছে, তখন সঙ্কট এমন এক আকার নেয়, যাকে দুইয়ে দুইয়ে চার করে সমাধানের রাস্তায় নিয়ে যাওয়া যায় না। বাংলা সিনেমা অবশ্য ‘সাদা খাম’-এর মতো কাহিনিকে তখন ধারণ করতে চায়নি সম্ভবত তার অন্তর্নিহিত জটিলতার কারণেই।
জটিলতা কিন্তু হিন্দি ছবি ক্রমে ধারণ করছিল। ১৯৮৬-এ এন চন্দ্রা পরিচালিত ‘অঙ্কুশ’ মুক্তি পায়। চার জন তথাকথিত বেপথু যুবককে জীবনের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনতে চায় এক চাকরিরতা তরুণী। কিন্তু, সে তার সংস্থার মালিকের নির্দেশেই গণধর্ষিতা হয় এবং পরে আত্মহত্যা করে। চার যুবক সেই মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে একে একে হত্যা করে ধর্ষকদের এবং বিচারে তাদের মৃত্যুদণ্ড হয়। আপাত সরল এই কাহিনি কিন্তু দর্শকের কাছে আইন আর ন্যায়বিচারের দ্বন্দ্বটিকে অন্য ভাবে উপস্থাপন করে। ‘প্রতিশোধপরায়ণা নারী’ আর্কিটাইপ থেকে প্রতিহিংসা চরিতার্থকরণের ভার গিয়ে পড়ে পুরুষের হাতে। এই পুরুষ আবার তারা, যাদের বিপথ থেকে সরিয়ে এনেছিল এক নারীই। ‘জেন্ডার ইকুয়েশন’-এর খেলা এখানে জটিল। উল্লেখ্য, ধর্ষণদৃশ্যকে এখানে প্রায় ঊহ্যই রাখা হয়েছিল।
নব্বইয়ের দশকে ভারতীয় পরিসরে ‘ধর্ষণ’ বিষয়ক যাবতীয় ধারণাকে ওলটপালট করে দেয় ১৯৯৪-এ মুক্তিপ্রাপ্ত শেখর কপূর পরিচালিত ছবি ‘ব্যান্ডিট কুইন’। চম্বলের নারী দস্যু ফুলন দেবীর সেই জীবনীচিত্রে গণধর্ষণ, নগ্নতা, প্রবল হিংসা একযোগে থাকলেও তার মধ্যে ‘জ়খমি আউরত’-সুলভ যৌন প্রণোদনা ছিল না। বদলে এমন কিছু ছিল, যা দেখে এই উপমহাদেশ-সহ সারা বিশ্বই শিউরে ওঠে। উল্লেখ্য, এর আগেও ফুলন দেবীর জীবনীচিত্র তোলা হয়েছে। সেখানে ‘বি মুভি’র ছকেই ধর্ষণকে দেখানো হয় এবং ফুলনের চরিত্রায়ণ আর এক জন ‘জ়খমি আউরত’-এর বাইরে কদম রাখতে পারেনি। শেখর তাঁর পরিচালনায় বহু কাল ধরে লালিত জড়তাকে উড়িয়ে দিলেন। এ প্রসঙ্গে শান্তনু চক্রবর্তীর মত, নারীশরীরকে সম্পূর্ণ অনাবৃত দেখানো হলেও তা পুরুষের যৌন ফ্যান্টাসির উপাদান হয়ে ওঠেনি এ ছবিতে। বরং তা ক্রমাগত অস্বস্তি উৎপাদন করে চলে, যার রেশ থেকে দর্শকদের বার হওয়া খুব সহজ ছিল না। সেই সঙ্গে শান্তনু আরও জানালেন, এখানে ‘ধর্ষণ’ রাজনীতি আর সমাজকে এমন ভাবে জড়িয়ে-পেঁচিয়ে থাকল, যা ‘ক্ষমতা’র ক্রুরতম দিকগুলিকে স্পষ্ট করে তোলে। সম্ভবত ‘ব্যান্ডিট কুইন’ সেই ছবি, যা ধর্ষণের পণ্যায়নকে অর্থহীন করে দেয়। সেই সঙ্গে ‘জ়খমি আউরত’ কল্পের কাঁচা ইমেজারির বারংবার উপস্থাপনেরও অন্ত ঘটে।
রাজকুমার সন্তোষী পরিচালি ‘দামিনী’ (১৯৯৩) ছবিতে ধর্ষণের উপস্থাপনা ভিন্নতর মাত্রা পেয়েছিল বলেই মত প্রকাশ করেছেন সোমা চট্টোপাধ্যায়। এই ছবিতে আর্থ-সামাজিক ভাবে দুর্বল এক গৃহপরিচারিকা ধর্ষিতা হয় তার নিয়োগকর্তার পরিবারের এক সন্তান ও তার সঙ্গীদের দ্বারা। পূর্বোল্লেখিত প্রবন্ধে সোমা দেখিয়েছেন, ধর্ষণ ছবির কেন্দ্রে থাকলেও তাকে কোনও ভাবেই পর্নোগ্রাফিক চেহারায় উপস্থাপনের চেষ্টা করেননি সন্তোষী। বরং তা ছিল উল্লিখিত পরিবারের এক গৃহবধূর তরফে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কাহিনি। অন্য দিকে সোমার মতে, ‘ইনসাফ কা তরাজ়ু’র মতো ছবিতে নায়িকার তরফে ধর্ষণের ‘প্রণোদন’ ছিল তার পোশাকআশাক। আর তার কিশোরী বোন ধর্ষিতা হয় দিদির ধর্ষককে আদালতে চিহ্নিতকরণের জন্য। এখানে ধর্ষণের পিছনে ‘মোটিফ’ রাখা হয়েছিল। কিন্তু ‘দামিনী’ ছিল অর্থনৈতিক বা সামাজিক দিক থেকে সবল অংশের দুর্বলের প্রতি অত্যাচারের ঘটনা। আবার, ধনী পরিবারের বধূ হওয়া সত্ত্বেও প্রতিবাদিনী দামিনীও পুরুষতন্ত্রের কাছে দুর্বল অস্তিত্ব। কিন্তু, সন্তোষীর এই ছবিটি ছিল নারী ক্ষমতায়নের এমন এক আখ্যান, যা এর আগে বলিউডি মূলধারার ছবিতে তেমন ভাবে দেখা যায়নি।
এর আগের দশকে ‘অন্ধা কানুন’ (১৯৮৩), ‘আখরি রাস্তা’ (১৯৮৬)-র মতো ছবিতে আইনের ‘অন্ধত্ব’ নিয়ে যে সমস্যাগুলি হাজির ছিল, তার মধ্যে একটি অনিবার্য উপাদান ছিল ধর্ষণ। আর সেই সব সমস্যার ক্রুর সমাধান ছিল ‘অ্যান্টিহিরোর’ তরফে আইনকে নিজের হাতে তুলে নিয়ে অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া। ‘জ়খমি আউরত’ কল্পে নারী যেখানে সমাজবিদ সুধীর কাকরের মতে ‘দুর্গা’ বা ‘কালী’র মতো অস্ত্রধারিণী হয়ে ‘প্রায়-পুরুষ’-এর চেহারায় পর্দায় উপস্থাপিত হত, সেখানে নব্বইয়ের দশকের পরে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেল থ্রিলারের আঙ্গিকে নারী প্রতিশোধ গ্রহণ করছে ‘সিরিয়াল কিলিং’য়ের মতো কর্মকাণ্ডের দ্বারা। সাম্প্রতিক অতীতে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘মাত্র’ (২০১৭) ছবিটি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আশতর সায়েদ পরিচালিত এবং রবিনা ট্যান্ডন অভিনীত এ ছবিতে মা ও মেয়ে একযোগে ধর্ষিতা হয়। মেয়ে সেই ঘটনার অভিঘাতে মারা গেলে মা নামে প্রতিশোধ নিতে। কার্যত ‘জ়খমি আউরত’-এর ধারার লক্ষণগুলি বহন করলেও ‘মাত্র’ উপস্থাপনার গুণে অনেকখানি আলাদা। যে ক্রুরতা ‘জ়খমি আউরত’-এ দেখানো হয়েছিল, এখানে যেন তার উপরেই পড়েছে পরিশীলনের প্রলেপ। তবে মূল জায়গাটি অবিচল থাকছে। নারী এখানেও কাকর-বর্ণিত ‘সংহারকর্ত্রী’ অবতারেই অবতীর্ণা। পুরুষতন্ত্রের কাছে সে সাহায্য চায় না বটে, কিন্তু অন্তিমে সে নিজেই হয়ে ওঠে পুরুষের বকলম।
এই মুহূর্তে ধর্ষণ এবং তার আইনি বিচার আর তাকে নিয়ে সামাজিক বিবেচনা সংবাদ শিরোনামে। কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে পারিবারিক পরিসরেও মেয়েরা কতখানি সুরক্ষিত, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে সাম্প্রতিক একাধিক ঘটনা। প্রতীকী প্রতিবাদ হিসাবে কলকাতা-সহ বহু জনপদেই ঘটে গিয়েছে ‘মেয়েদের রাত দখল’ করার মতো ঘটনা। কিন্তু, বাস্তবের মাটিতে ধর্ষণ অব্যাহত থেকেছে। রুপোলি পর্দা থেকেই ধার করে যৌনতার বিষয়ে নারীর সম্মতি স্লোগান হিসাবে উঠে এসেছে। ২০১৬-য় মুক্তিপ্রাপ্ত অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী পরিচালিত ছবি ‘পিঙ্ক’ এই সম্মতি-ঘটিত বিষয়কে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরে। কোনও মহিলা মদ্যপান করলে বা তথাকথিত খাটো পোশাক পরলেই যে তাঁকে পুরুষেরা নিজের বাসনা চরিতার্থের কাজে ব্যবহারের যোগ্য ভাবেন, তা হলে সেখানেই ভুল করছেন তাঁরা। নারীর ইচ্ছার বিষয়টিকে যে সর্বাগ্রে মান্যতা দেওয়া প্রয়োজন, তা আদলতকক্ষে দাঁড়িয়ে বর্ষীয়ান আইনজীবী দীপক সেহগাল উচ্চারণ করে। দীপকের ভূমিকায় অমিতাভ বচ্চনের জলদমন্দ্র কণ্ঠে শোনা যায় “নো, মিনস নো” (না, মানে না)। এই বাক্যবন্ধই সম্প্রতি স্লোগান হিসাবে ছড়িয়ে পড়ে সমাজমাধ্যমে, রাজপথে, নাগরিক সমাবেশে। ‘ধর্ষণ’-এর সংজ্ঞাই হল, নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে যৌন মিলনে বাধ্য করা। ‘পিঙ্ক’ ছবিতে এই সারবাক্যটি উচ্চারিত হয়। এত কাল ধরে বয়ে আসা কোনও বলিউডি ছবিই এই “নো, মিনস নো”কে সাদা আলোয় বলেনি। ‘ইনসাফ কা তরাজু’ থেকে ‘ব্যান্ডিট কুইন’ হয়ে ‘মাত্র’ প্রতিশোধের কথা বলেছে, সামাজিক সংবেদের প্রশ্নটিকে উত্থাপন করেছে, এমনকি ধর্ষণের সম্ভাব্য কারণ হিসাবে নারীর ‘চালচলন’কেও প্রকারান্তরে অঙ্গুলিনির্দেশ করেছে। কিন্তু, ‘পিঙ্ক’ সে দিকে যায়নি। আইনের রাস্তায়, জনাকীর্ণ আদালতকক্ষে তা উচ্চারিত হয়েছে। এবং সাম্প্রতিক আন্দোলনে তা স্লোগান হয়ে উঠেছে। এই স্পষ্টতা অবশ্যই কাঙ্ক্ষিত ছিল। কিন্তু, তার পরেও একটি প্রশ্ন থেকে যায়। কেন এই সরল বাক্যটি উচ্চারণ করতে হল এক জন পুরুষকে? কেন সেই পুরুষের ভূমিকায় বেছে নাওয়া হল অমিতাভের মতো ‘ব্যারিটোন’ কণ্ঠস্বর-ঋদ্ধ পুরুষকেই? তা হলে কি নারীর ইচ্ছা ও অনিচ্ছা প্রকাশের দায় ও ভার শেষ পর্যন্ত ‘বলবান’ পুরুষের হাতেই? ভারতীয় ছবিতে সদা বহমান ‘মেল গেজ’ বা ‘পুরুষ নজর’-এর বাইরে কি কদম রাখতে পারল না ‘মিলেনিয়াম’ পার হয়ে আসা সময়ও? আর সেই ‘মেল গেজ’-ই নারীরা ধারণ করলেন প্রতিবাদের অভিজ্ঞান হিসাবে?
রাত বাড়ে। দিনের আলোর মধ্যেও ঘোলাটে ধোঁয়াশায় শৈশবেই ঝরে পড়ে ধর্ষণ-বিধ্বস্ত নারীশরীর। প্রতিবাদও তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। ক্ষোভ আবার এসে আছড়ে পড়বে হয়তো আগামীর ছবিতে। কিন্তু, নারীর প্রকৃত কণ্ঠস্বর কি শোনা যাবে তাতে? ঘনঘোর রাত বাড়ে। উত্তর মেলে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy