পয়লা বৈশাখে ব্রাত্যর স্মৃতিচারণ
প্রকাশকেরা তখন আমার কাছে সম্বোধনে পিতৃব্য। অন্যান্য দিন সেই সব কাকারা বাড়িতে এসে আমার প্রতি নিস্পৃহ থাকলেও, অন্তত ওই পয়লা বৈশাখের দিনে ছিলেন অতীব সদয়। নির্বিচারে কলাপাতার প্লেটে মন্ডা-মিষ্টি ভূতের রাজার আশীর্বাদের মতোই আসতে থাকত। ফলে নতুন বছর এলেই কমবয়সের কলেজ স্ট্রিটের হালখাতার কথা মনে পড়ে। অথচ মনে পড়ার উপাদান যে শৈশবে কম ছিল, তা তো নয়। স্কুল, তার ছুটি, পঁচিশে বৈশাখের জন্য নাটকের প্রস্তুতি মহড়া, ফুটবল ম্যাচ, গৃহশিক্ষকের বাড়িতে পড়াতে না আসা, স্কাউটের শিক্ষণ— এই রকম সাত-সতেরো স্মৃতিতে আমার শৈশবের পয়লা বৈশাখ ভর্তি। কিন্তু ওই যে বিকেল-সন্ধ্যে হতে না হতেই দূরে, না জানি কোথায় সেই দিকশূন্যপুর কলেজ স্ট্রিটে বাবার হাত ধরে বাস থেকে নামা, তার স্মৃতি অন্য রকম। বিভিন্ন প্রকাশকের দোকানে নিমন্ত্রণে হাজিরা দেওয়া। তাঁদের আপ্যায়ন ও বাবার সঙ্গে গল্পগুজবের মাঝে মিষ্টি তো বটেই, সঙ্গে একটা গোটা চ্যাপ্টা বেঁটে নরম পানীয়ের বোতল পাওয়া। সে কথা ভাবলে এখনও আমার চক্ষু ও রসনা দুই-ই জলপূর্ণ হয়ে ওঠে। বাবার হাত ধরে ওই সব আশ্চর্য দোকানে আমি ছেলেবেলায় টানা তিন-চার বছর অন্তত তো গিয়েছিই।
ছেলেবেলার সেই দিনটির আরও দু’টি গল্প এখনও বেশ মনে পড়ে। এক বার আমারই বয়সের এক অচেনা বালকের পাশে বসে কলেজ স্ট্রিটের কোনও একটি পরিচিত দোকানে লুচি খাচ্ছিলাম। গোগ্রাসে। শেষ লুচিটি যখন মুখে তুলতে যাচ্ছি, পাশের উক্ত বালকটি আমার হাত থেকে সেটি অতর্কিতে ছিনিয়ে নেয়। হাত আমার মুখে ওঠে, কিন্তু সেখানে লুচিটি নেই। তৎক্ষণাৎ আমি তার হাতের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ি, কিন্তু সে হাতও তখন ফাঁকা। অর্থাৎ, সে লুচিটি ছিনিয়েই খেয়ে ফেলেছে। দোকান ছিল ঠাঁসা, ফলে আমার বাঁ হাতের মুষ্টি যে তার দিকে সজোর প্রধাবিত করব, সে উপায়ও নেই। আমি কটমট করে তার দিকে চাইলাম, কিন্তু তার চোখ তখন ভক্তিতে বা সুখে প্রায় নিমীলিত। আর একটি লুচি চাইতে যাব, কিন্তু আমার বাবার সেই প্রকাশকের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ তখন শেষ, ফলে বাবা প্রায় জোর করেই হয়তো বা কর্ণ আকর্ষণপূর্বক আমাকে দোকানের বাইরে নিয়ে এলেন। সারা জীবনে এর পরে লুচি অনেক খেয়েছি, কিন্তু ওই যে কলেজ স্ট্রিটের বাটার উল্টো দিকে ম্লান বাল্বের আলো, ছোট একটি দোকানের ভিতরে পাওয়া, ভিতরে ময়দার পুর দেওয়া দু’ভাগি লুচিটি আজীবনের জন্য ফস্কে গেল, তার স্মৃতি এখনও আমাকে করুণ করে তোলে।
পরের গল্পটি হয়তো মজার। ওই রকম আরও একটি দোকান থেকে বেরিয়ে অন্য দোকানের দিকে আমরা হাঁটছি। সঙ্গে ছিলেন বাবার আর এক লেখক বন্ধুও। তো তিনি তৃতীয় কোনও ব্যক্তি প্রসঙ্গে কথা বলতে বলতে সজোরে বরাহনন্দনের চলতি বাংলা শব্দটি প্রয়োগ করলেন। বাবাও চমকে উঠে আরও বড় অভিব্যক্তিতে তাঁকে বোঝালেন যে, সঙ্গে অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলে আছি। স্কুলের দৌলতে ও শব্দটি আমি আগেই শিখে নিয়েছিলাম, বলাই বাহুল্য। শব্দটি আমার কাছে মোটেও অচেনা ছিল না। এখন বাবার চমকানো ও তার জন্য সতর্কতামূলক অভিব্যক্তি আমার ভিতরে মৃদু হাসির জন্ম দিল। তবে সে কথা না শোনার ভান করে মোটের উপরে নির্বিকারই ছিলাম। কিন্তু বাবার মনোভঙ্গি লক্ষ্য করে বাবার সেই লেখক বন্ধু আমার কাছে এলেনও। বারবার জানতে চাইতে শুরু করলেন যে আমি কিছু শিখেছি কি না। ভাবলাম, এক বার জিজ্ঞাসা করি কী শিখব, কিন্তু তাতে শব্দটি পুনরুচ্চারিত হতে পারে এই বিবেচনায় তাকে আর কিছু শুধোইনি। পয়লা বৈশাখে কলেজ স্ট্রিটের এই দু’টি শৈশবিক গল্প এখনও আমার স্মৃতিতে টাটকা!
আর সকলের মতো আমার কাছেও পয়লা বৈশাখের মানে পাল্টে গেল বড় হওয়ার পরে। ওই দিনটায় ছুটি থাকে, ফলে সকাল থেকে থিয়েটারের মহড়া দেওয়া যেত। তখন যে দলে কাজ করছি, তাতে বেশির ভাগই চাকুরিজীবী। বেসরকারি সংস্থার করণিক থেকে অটোচালক, প্রাইভেট টিউশন করে দিন গুজরান করা মাস্টারমশাই থেকে কল শ্রমিক, সবাই অভিনেতা। ফলে বেশির ভাগ দিনেই প্রায় সবাই ব্যস্ত থাকত। একমাত্র ছুটির দিনে সবাইকে পাওয়া যায়। তবে ওই যখন কলেজ কি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি, সেই সময়ের একটি গল্প এই সূত্রে বলা যেতে পারে। তখন আমি, লাল (সুমন মুখোপাধ্যায়) আর সুপ্রিয়দা (বিশিষ্ট অভিনেতা সুপ্রিয় দত্ত) একসঙ্গে আড্ডা দিতাম। একবার বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম। ঠিক করলাম ওড়িশার সিমলিপাল জঙ্গলে যাব। তখন আমি খুবই জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াই। তো সিমলিপালের পরিকল্পনা মজলিসে পেশ করলাম। তবে আমি আর লাল স্থির করলাম, সুপ্রিয়কে এ তথ্য দেওয়া যাবে না। কারণ, তার কাছে বেড়ানোর জায়গা বলতে একমাত্র পুরী। আর ভ্রমণের ক্ষেত্রে সুপ্রিয়দা কোনও রকম নিরীক্ষায় নারাজ। স্থির হল পয়লা বৈশাখের দিন লালের বাড়িতে দুপুরে আমরা দেখা করে, রাতের কোনও একটি ট্রেন ধরে বারিপদা যাব। পরদিন ভোরে বারিপদায় নেমে সেখান থেকে প্রয়োজনীয় অনুমতি নিয়ে সিমলিপাল যাব। আর ক’দিন বাদেই যেহেতু জঙ্গল বন্ধ হয়ে যাবে, তাই ওই দিন কটিতেই যাওয়া ভাল, এমনটাই ভাবা হল। পরিকল্পনা মাফিক দুপুরে আমরা সবাই দেখা করলাম। কিন্তু সত্য বলার সময়ে যেহেতু ঘনিয়ে এসেছে, তাই সুপ্রিয় দত্তকে বলতেই হল যে, আমরা উৎকল প্রদেশের জগন্নাথ ধাম নয় বরং হস্তিধাম, চাহালা-বরাইপানি গুড়গুড়িয়া যাচ্ছি। সিদ্ধান্তটি টেবিলে প়ড়া মাত্র সুপ্রিয়দা আঁতকে উঠল। সে নাচার এবং নাছোড়। কিছুতে সে সিমলিপাল যাবে না। অনেকক্ষণ ধরে টানাপড়েনের পরে সে যে গল্পটি বলল, তা ধ্বংসাত্মক। এবং সেই গল্পটি তারই অনুকরণীয় ভাষায় নীচে তুলে দিলাম—
সুপ্রিয়: ‘‘শোনো ভাই, আমার অফিসের এক সহকর্মী গত বছর সিমলিপাল গিয়েছিল। ফিরে আসার পরে তার ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া হল।’’
আমরা: ‘‘আহা। জানি তো ওখানে হয়। আমরা তো তার পর্যাপ্ত প্রতিষেধক হিসেবে মশার তেল, ওডোমস ইত্যাদি নিয়েছি।’’
সুপ্রিয়: ‘‘আহা। আমাকে শেষ করতে দাও। তো আমার সেই সহকর্মী গত বার সিমলিপাল থেকে ফিরে আসার পরে প্রায় এক মাস হাসপাতালে ভর্তি ছিল। তার পর সে যখন অফিসে ফিরল, প্রথমেই আমার কাছে এল। এসে বলল, ‘সুপ্রিয়বাবু, আমি সিমলিপাল গিয়েছিলাম। আমার ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া হয়েছিল।’ বলে সে চলে গেল। পরদিন সে আবার আমার কাছেই এল। বলল, ‘সুপ্রিয়বাবু, আমি সিমলিপাল গিয়েছিলাম। আমার ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া হয়েছিল।’ তার পরদিন আবার এল। একই কথা বলল। তার পরদিনও। তার পরদিনও। তার পর...’’
আমরা: বুঝলাম না ব্যাপারটা কী?
সুপ্রিয়: ‘‘বুঝলে না তো? ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া হওয়ার পরে ওর মাথাটা পুরো খারাপ হয়ে যায়। ও এখন পাগল।’’
বলাই বাহুল্য, এই মোক্ষম গল্পের পরে আমাদের আর সিমলিপাল যাওয়া হয়নি। সেই পয়লা বৈশাখের সন্ধ্যাটি আমাদের কেটেছিল শহরেরই কোনও এক রেস্তঁরায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy