মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সত্যজিৎ রায় ও শ্যামল মিত্র।
“…কে আছে এমন, যিনি বিশ্বময় বাঙ্গালিকে এমনতর সম্মানে – উঁচু আসনে নিয়ে যেতে পেরেছেন; রবীন্দ্রনাথ ছাড়া। বিশ্ব চলচ্চিত্রের রাজপুত্র সত্যজিৎ বাঙ্গালির দর্পণ হয়েই ছড়িয়েছেন মানবতার আলো সারা পৃথিবীময়। ক্ষণজন্মা এই মহান পুরুষের সৃষ্টি ও জীবন নিয়ে কৌতুহলের অন্ত নেই।’’ (অবারিত বিস্ময়ের অবলোকনঃ সত্যজিৎ চর্চা, চট্টগ্রাম, ১ম বর্ষ, ১ম সংখ্যা, জানুয়ারি ২০০১, পৃষ্ঠা– ৩)
বাংলাদেশের হৃদয় জুড়ে সত্যজিৎ কতখানি ছিলেন, আছেন ও থাকবেন সেটি অনুভব করাতে ওখানকার লেখক নাজিমুদ্দিন শ্যামলের একটি লেখার এই উক্তি দিয়ে লেখাটা শুরু করলাম। মনে রাখতে হবে জন্মলগ্ন থেকে ওই ভূখণ্ড ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের অপশাসনের অধীন। দেশভাগের যন্ত্রণাক্লিষ্ট অভিজ্ঞতার বছর আটেক পরে ‘পথের পাঁচালী’ মুক্তি পেলেও ওই সময় সিনেমা হাউস ছাড়া ছবি দেখার কোনও উপায়ই ছিল না, তাই পাশপোর্ট/ভিসার ধকল সহ্য করে ওখানকার খুব কম মানুষই কলকাতায় এসে ছবিটা দেখতে পেরেছিলেন। তবু দেখতে না পেলেও ইতিহাসের গতিধারাকে তো থামানো যায় না কোনও মতেই। তাই ‘পথের পাঁচালী’র জয়যাত্রার কথা সবার সঙ্গে যথাসময়ে জ্ঞাত হয়েছেন ওখানকার মানুষজন।
পুব বাংলায় সত্যজিতের প্রথম যে ছবিটা যায় তার নাম ‘অপুর সংসার’। ওখানকার শিল্পবোদ্ধা মানুষেরা সবিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করলেন বিশ্বমানের এক চলচ্চিত্র। দুঃখের কথা, ওই দেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ভারত থেকে ছবি আমদানি না করার সিদ্ধান্ত নেয় তখনকার পাকিস্তান সরকার। ফলে সত্যজিতের একটার পর একটা অসামান্য নির্মাণ দেখার জন্যে ওখানকার দর্শকদের দীর্ঘ দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। দেখতে হয়েছে ঘুরপথে।
আরও পড়ুন: এই কঠিন সময়েও মানিকদা আশা হারাতেন বলে মনে হয় না
প্রসঙ্গত ’৬৪-তে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করতেই হবে। ওই সময় ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য প্রথম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ভারত থেকে পাঠানো হয়েছিল সত্যজিতের ‘মহানগর’ ছবিটা। উৎসব কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতি দিন একটি করে ছবি দেখানো হবে। কিন্তু দর্শকদের বিপুল চাহিদার কথা মনে রেখে একদিনে, অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টায় দিনরাত মিলিয়ে ১০/১১টি ছবি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল নিয়মরক্ষার তাগিদে। টিকিট কাটার জন্যে লম্বা লাইন পড়েছিল ঢাকা স্টেডিয়ামে। ওঁর ছবির প্রতি সাধারণ মানুষের কী আকর্ষণ ছিল, এই একটি ঘটনাতেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। তাঁর ছবির এই বিপুল জনপ্রিয়তার কথা জেনে অত্যন্ত খুশি হন স্বয়ং এর স্রষ্টা। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের পর পরই ওখানকার সরকারি আমন্ত্রণে গিয়ে ’৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে সত্যজিৎ রায় অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে বলেছিলেন ওই ছবি দেখা নিয়ে ঢাকার জনগণের আবেগের কথা। বলেছিলেন এই উন্মাদনায় নিজের বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাবার কথা। সে দিন ওখানে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতি তাঁকে অবাক করেছিল। অত্যন্ত আবেগাপ্লুত কণ্ঠে সে দিন তিনি বলেছিলেন, “গত বিশ বছরে অনেক জায়গায় অনেক দেশে অনেক বার নানানভাবে সম্মানিত হবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কিন্তু আমি জোর গলায় আজকে এখানে দাঁড়িয়ে, এই শহিদ দিবসের পুণ্য তিথিতে আমি বলতে পারি যে, আজকের যে সম্মান সে সম্মানের কাছে আগের সমস্ত সম্মান হার মেনে যায়। এর চেয়ে বড় সম্মান আমি কখনো পাই নি আর আমার মনে হয় না, আমি আর কখনো পাব। জয় বাংলা।’’ তাঁর এই ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণের সঙ্গে সমস্ত মাঠ উল্লাসে ফেটে পড়েছিল।
এই হল বাংলাদেশের মানুষ, রক্তরাঙা মানুষের হৃদয় ! যার পরতে পরতে পরম শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় মিশে আছে সত্যজিৎ রায়ের সমস্ত কাজ। বাঙালি হিসেবে গর্ব করার মতো শিল্পের মহা নান্দনিক অনুভব যে দেশকালের বেড়া মানে না, তার প্রমাণ স্বয়ং এই মানুষটা। তাঁর সৃষ্টি নিয়ে বাংলাদেশের অগ্রগণ্য চলচ্চিত্রকার তানভীর মোকাম্মেল লিখেছেন, “সেরা বাঙ্গালি তাঁরাই হতে পেরেছেন যাঁরা পূর্ব ও পশ্চিমের সেরা দিকগুলি আত্মস্থ করেছেন – রামমোহন, মাইকেল, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ এবং সত্যজিৎ। যথার্থ রেণেসাঁম্যান এঁরা। সত্যজিৎই হয়তো বেঙ্গল রেণেসাঁর শেষ প্রতিভু।’’ (সিনেমার শিল্পরূপ – পৃষ্ঠা ২৩) । এমন শ্রদ্ধামিশ্রিত মূল্যায়ন ওখানকার অনেকেই করেছেন।
সম্প্রতি প্রয়াত বাংলাদেশের বরেণ্য ক্যামেরাম্যান আনোয়ার হোসেন লিখেছিলেন তাঁর নিজস্ব অনুভূতির কথা এই ভাবে,
“...আপনারা হৃদয় থেকে অনুধাবন করবেন সত্যজিতের চলচ্চিত্র দেখাই আসল কথা নয়। অনুভূতি যে কোন পরিচালকই তুলে ধরেন তাঁর সেলুলয়েডের মাধ্যমে যা কিছু বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি জটিলতার মধ্য দিয়ে মনকে নাড়া দেয়। তাতেই শিল্প সৃষ্টি হয়, তাতে চলচ্চিত্রের রূপরেখা গঠিত হয়। কিন্তু রায়ের মতো মহৎ চলচ্চিত্রকারেরা এ সব অনুভূতির এক বাস্তবসম্মত উপস্থাপনা করেন যে তা দর্শকদের ভীষণ ভাবে নাড়া দেয়, তাদেরকে ভাবতে উদবুদ্ধ করে এবং শিক্ষিত করে তোলে।’’ (সত্যজিৎ রায় স্মারক গ্রন্থ, ঋত্বিক চলচ্চিত্র সংসদ, ঢাকা, জানুয়ারি ১৯৯৩ )
চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত ‘সত্যজিৎ চর্চা’র সম্পাদক আনোয়ার হোসেন পিন্টু ২০১৭ সালে প্রকাশিত সংখ্যার সম্পাদকীয় লিখতে গিয়ে অকপটে জানান, “…সুস্থ ও নির্মল জীবনযাপনে এই মহাপৃথিবীর ব্যক্তিমানুষের মনের কন্দর থেকে যদি না তাড়ানো যায় ‘অন্ধকার’, তবে পৃথিবীর সবকিছুই মিছে বা অসার। জীবনযাপনের এমন সংকট ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ক্রান্তিলগ্নে সত্যজিতের ভাবনার কলম ও ক্যামেরা খুব সহজে সঠিক দিক নির্ণয়ের বাতিঘর হয়ে ওঠে বারবার।’’
যে মানুষটা সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষের এই অপার শ্রদ্ধাবোধ সেই সত্যজিৎ রায় স্বয়ং স্বাধীন বাংলাদেশ সম্পর্কে অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তাই তো ’৭২-এ প্রথম সুযোগেই অনেক কাজ ফেলে ওখানে গিয়েছিলেন, অকপটে বলেছিলেন, “…আজ শহিদ দিবসে এসে, আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে ঢাকা শহরে এসে আমার স্বপ্ন অন্তত কিছুটা সফল হল। এবার আমি অনেক জরুরি কাজ ফেলে রেখে চলে এসেছি, আমার আশা আছে যে অদূর ভবিষ্যতে আমি আবার এদেশে আসব। এদেশটাকে ভাল করে দেখব। এদেশের মানুষের সঙ্গে এমনভাবে জনসভায় নয়, সামনাসামনি, মুখোমুখি বসে কথা বলে তাদের সঙ্গে পরিচয় করব।’’ (পল্টন ময়দানের ভাষণ, টেপ রেকর্ডার থেকে বাণীবদ্ধকরণ তরিকুল ইসলাম বাবু)
আরও পড়ুন: গভীর দর্শনও কত সহজ ভাবে বলা যায়, মানিকদা দেখিয়েছেন
বাংলাদেশে পুনর্বার যাবার ইচ্ছাপূরণ হয়নি ঠিকই, কিন্তু তিনি ‘অশনি সংকেত’ ছবিতে ববিতাকে নির্বাচন করে সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন। এই হলেন সত্যজিৎ রায়। ওই ছবিতে ববিতার অভিনয়ের কথা এখনও সকলের চিত্তপটে অমলিন।
নিজে না গেলেও বাংলাদেশের মানুষদের জন্য তাঁর দরজা ছিল অবারিত। কত মানুষ কত সময়ে তাঁর কাছে এসেছেন ! অনেক ব্যস্ততার মধ্যে তাঁদের সময় দিয়েছেন তিনি। এক বার ওখানকার চলচ্চিত্রকার সুভাষ দত্ত টেলিফোনে অনেক কষ্টে যোগাযোগ করে পাঁচ মিনিটের জন্য সাক্ষাতের অনুমতি আদায় করেছিলেন। যথাসময়ে যথাস্থানে হাজির হন তিনি। অনর্গল কথা বলেন তাঁর সঙ্গে। তিনিও সমস্ত কিছু ভুলে তাঁর সমস্ত প্রশ্নের জবাব দেন। দেশ ফিরে চিত্রালী নামের একটি পত্রিকার বার্ষিক সংখ্যায় তিনি সাক্ষাৎকারের এই অভিজ্ঞতার কথা লেখেন। শিরোনাম দেন ‘পাঁচ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা’।
পরিশেষে বাংলাদেশের প্রথম মহিলা আলোকচিত্রকর বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী আব্দুল আহাদের বোন সাঈদা খানমের একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা জানাব। ১৯৬২ সালে তিনি সত্যজিৎ রায়ের সাক্ষাৎকার নিতে কলকাতায় আসেন। এই কাজের সূত্র ধরে এসে তিনি রায় পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িয়ে পড়েন। ছবি তোলা ছাড়া অনেক ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের স্মৃতি জড়ানো শ্রীমতী খানম তাঁর এক সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে রায় পরিবারের সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গতার কথা জানান। দীর্ঘ সেই অভিজ্ঞতার কথা এখানে জানানোর অবকাশ নেই। কেবল সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তাঁর শেষ দেখার অভিজ্ঞতাটুকু জানাব।
“...কান্নাভরা মন নিয়ে মানিকদার শয্যার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। মংকুদি বললেন ‘দেখো বাদল এসেছে।’ আশ্চর্য ! মানিকদা আমাকে চিনতে পারলেন। অন্য সময় ঘরে ঢুকলেই যেমন হেসে বলতেন, ভাল আছ ত? আজও তাই জিজ্ঞাসা করলেন। কিন্তু সেই উজ্জল মধুর হাসি বড় ম্লান বড় করুণ। কণ্ঠস্বর অতি ক্ষীণ। ‘আপনি আবার ভাল হয়ে উঠবেন।’ বলেই মানিকদার হিমশীতল হাত স্পর্শ করতেই মনে হল জীবনকে বড় ভালবাসতেন মানিকদা, সেই জীবনের সূর্য ধীরে ধীরে অস্ত যাচ্ছে। সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে মানিকদা সূর্যাস্ত দেখতে ভালবাসতেন। আমি দেখলাম মহাকালের অনন্ত স্রোতে সমগ্র পৃথিবীর আশীর্বাদ নিয়ে মহান সূর্য ডুবে যাচ্ছে। তার সঙ্গে আমার অশ্রুভেজা শ্রদ্ধা ও ভালবাসা মিশে গেল।’’ (নিশাত জাহান রানা সম্পাদিত ‘কথার ঘরবাড়ি’। পৃষ্ঠা– ১৩৭-১৩৮)।
(ছবি আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy