ইগো-অভিমান-স্বার্থ— সব ভুল দুই ভাইকে ফিরতেই হল পর্দায়। ছবি: সংগৃহীত।
১৯৯৫ সাল। পর্দায় রাখি গুলজ়ারের বিখ্যাত সংলাপ, ‘মেরে করণ অর্জুন আয়েঙ্গে’। ছবিতে মায়ের সেই আর্জি ফেলতে পারেনি ভগবানও। দুর্গার দুই ছেলে কুড়ি বছর পর ফিরেছিল গল্পে। এবং একসঙ্গে দুষ্টের দমন করেছিল।
কাট টু ২০২৩। পাঠান যখন রুশ গুন্ডাদের সঙ্গে লড়াই করে ক্লান্ত হয়ে পর্দায় ‘টাইম আউট’ চাইছে, তাকে বাঁচাকে হাজির ‘টাইগার’! ভাইয়ে-ভাইয়ে কাঁধ মিলিয়ে লড়ে দুষ্টের দমন হল। এ যেন সেই করণ-অর্জুনেরই পুনর্জন্ম!
‘করণ অর্জুন’ ১৯৯৫ সালে ‘দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে জায়েঙ্গে’র পর সবচেয়ে বেশি ব্যবসা করেছিল। ‘পাঠান’ মুক্তি পেয়েছে বছরের শুরুতেই। ‘পিকচার অভি বাকি হ্যায়’। এ ছবি শেষমেশ কতটা ব্যবসা করে, সেটা সারা বছরের নিরিখে কতটা বেশি বা কম, সে সব দেখার এখন অনেক দেরি। কিন্তু ক্যামিয়ো হলেও এ বার করণ-অর্জুন মানে শাহরুখ খান এবং সলমন খান পর্দায় কী খেল দেখান, সেটা দেখার। তাঁদের যে পর্দায় ফের একসঙ্গে দেখা যাবে, এক সময় বলিউ়ড ভাবতেও পারত না। ভাই-ভাইয়ের তেমন বনিবনা ছিল না যে বহু বছর। মুখ দেখাদেখি বন্ধ একেবারে। তবে সে সব বিবাদ বেশ কিছু বছর আগেই একটি দিওয়ালি-পার্টিতে ঘুচে গিয়েছিল। তবে সিনেমায় যে ফের একসঙ্গে তাঁদের দেখা যাবে কেউ ভাবেননি। বলিউডের দুর্দিন অবশেষে তা-ও করে দেখাল। ইগো-অভিমান-স্বার্থ— সব ভুল দুই ভাইকে ফিরতেই হল পর্দায়।
এর জন্য অনেকগুলি কারণ দায়ী। বেশ কিছু বছর ধরেই দক্ষিণী ছবি রমরমিয়ে ব্যবসা করে চলেছে। ‘পুষ্পা’, ‘কেজিএফ চ্যাপ্টার টু’, ‘আরআরআর’, ‘কান্তারা’— একের পর এক ছবি হিট। নিমেষে ১০০ কোটি পেরোচ্ছে প্রত্যেকটা ছবি। এ দিকে বলিউডের ঝুলি ফাঁকা। কোনও ছবিই সে ভাবে চলছে না। অতিমারির পর বক্স অফিস লাভের মুখ দেখতে হিমশিম খাচ্ছে। কোন গল্প চলবে, কোনটা চলবে না, বোঝা দায়। আমির খানের স্বপ্নের প্রজেক্ট ‘ফরেস্ট গাম্প’-এর রিমেক ‘লাল সিংহ চড্ডা’ও মুখ থুবড়ে পড়ল। কোনও রকমে হিট হল ‘কাশ্মীর ফাইল্স’, ‘ভুলভালাইয়া টু’, ‘দৃশ্যম টু’ (যা আবার দক্ষিণী ছবিরই রিমেক)। ব্লকবাস্টার কাকে বলে, প্রায় ভুলতে বসেছিল বলিউড। শেষরক্ষা হয়েছিল রণবীর কপূর-আলিয়া ভট্টের ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ দিয়ে। প্রশ্ন উঠছিল বলিউডের ভবিষ্যৎ নিয়ে। স্টারেরা কই, সেই বলিউড ম্যাজিক কই, সেই উন্মাদনা কই? ঠিক তখনই হাল ধরলেন বলিউডের বাদশা। কামব্যাক ফিল্ম ‘পাঠান’ প্রথম দিনেই বক্স অফিস কাঁপিয়ে দিয়েছে। অগ্রিম বুকিংয়ের নিরিখেও টেক্কা দিতে পেরেছিল ‘কেজিএফ টু’-কে। কী করে? কোন ফর্মুলা মেনে?
ফর্মুলা খুবই সহজ এবং বহু দিনের জানাও। স্পাই ফিল্ম, মারপিট, টানটান অ্যাকশন সিকোয়েন্স, প্রেম, ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব, মারাকাটারি সুপারভিলেন, ভরপুর বিনোদন— মানে ব্লকবাস্টারের জন্য যা যা প্রয়োজন, সবই রয়েছে। বাড়তি বিনোদনের জন্য একটি কনসেপ্ট আমদানি করা হয়েছে হলিউড থেকে। ‘শেয়ার্ড ইউনিভার্স’। মানে সিনেমার জগতে এমন একটি জায়গা যেখানে বিভিন্ন ছবির চরিত্ররা অবলীলায় ঘোরেফেরা করতে পারে। যেমন মার্ভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্স বা এমসিইউ-তে হয়। সব সুপারহিরোদের আলাদা আলাদা ছবি হলেও তাঁরা একে অন্যের ছবিতে ঢুঁ মারে। একসঙ্গে লড়াই করে। অ্যাভেঞ্জার্সের ফুল টিম নিয়ে ছবি তৈরি হয়। একটা ছবির টাইমলাইন যেখানে শেষ হয়, অন্য হিরোর ছবি শুরু হয় সেই শেষ থেকেই। মানে প্রত্যেক ছবির চিত্রনাট্যে এক সুতোয় বাঁধা থাকে। তেমনই একটি কনসেপ্ট এ বার দেখা গেল বলিউডে। ‘যশরাজ ফিল্মস’ তৈরি করছে ‘ওয়াইআরএফ স্পাই ইউনিভার্স’। এই ব্রহ্মাণ্ডের প্রথম ছবি ছিল ‘এক থা টাইগার’ যেখানে গুপ্তচর টাইগার (সলমন খান)। দ্বিতীয় ছবি ‘ওয়ার’ যেখানে গুপ্তচর ছিল কবীর (হৃত্বিক রোশন) এবং তৃতীয় ছবি ‘পাঠান’। এই ছবি দিয়েই এক গল্পের হিরো চলে এল অন্য গল্পের হিরোকে বাঁচাতে। পাঠান আর টাইগার একসঙ্গে লড়াই করল। টাইগার যাওয়ার আগে বলেও গেল, সে একটি গুরুত্বপূর্ণ মিশনে যাচ্ছে। সেখানে পাঠানের প্রয়োজন হতে পারে। পাঠানও তাঁর (না কি শাহরুখের?) সিগনেচার স্টাইলে বলল, ‘ম্যায় হুঁ না’। বোঝাই যাচ্ছে, পরের ছবিতে টাইগারের সঙ্গে দেখা যাবে পাঠানকেও। এবং প্রযোজনা সংস্থার তরফে এমন কথাও ঘোষণা করা হয়েছে যে এমন একটি ছবির পরিকল্পনা চলছে যেখানে দেখা যাবে পাঠান, টাইগার এবং কবীরকে। এক নায়কে যে আর ছবি চলছে না, তা বুঝতে পেরেছে বলিউড।
তবে বুঝতে একটু বেশি দেরি হয়ে গেল না তো? ‘এমসিইউ’ শুরু হয়েছে ২০০৮ সালে। সে বছরই আমেরিকায় আর্থিক মন্দা শুরু হয়। হলিউডেও তার প্রভাব পড়েছিল। যদি গত এক দশকের বক্স অফিসের হিসাব নেওয়া হয়, তা হলে বোঝা যাবে হলিউড এখন সবচেয়ে বেশি ব্যবসা করে বড় ফ্র্যাঞ্জাইজ়ি থেকেই। এবং সেগুলো সবই ফ্যান্টাসি জ়রের ছবি। ‘টাইটানিক’-এর মতো বিশ্বজোড়া সাফল্য আর কোনও রোম্যান্টিক বা ড্রামা ছবি পায়নি। সবচেয়ে বেশি বিশ্ববাজারে ব্যবসা করা ছবিগুলি সবই ‘অ্যাভেঞ্জার্স’, ‘হ্যারি পটার’, ‘লর্ড অফ দ্য রিংস’-এর মতো ছবি। এবং লাভের মুখ দেখেছে শুধু ‘ওয়ার্নার ব্রাদার্স’, ‘ডিজ়নি’ কিংবা ‘মার্ভেল স্টুডিয়ো’র মতো বড় প্রযোজনা সংস্থাগুলি। বিশ্বমানের ফ্যান্টাসি ছবি বানানোর জন্য যে মাপের সিজিআই বা স্পেশ্যাল এফেক্টসের প্রয়োজন পড়ে, বলিউড এখনও সেটায় পৌঁছতে পারেনি। ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ সবে সেই চেষ্টাটা শুরু করেছে। তাই সে সবে না গিয়ে স্পাই সিরিজ়েরই ব্রহ্মাণ্ড বানানোর পথে হেঁটেছে ‘যশরাজ’। হয়তো তাদের দেখে এগিয়ে আসবে বাকি প্রযোজনা সংস্থাগুলিও। বক্স অফিসের সাফল্য কে না চায়? যদি এই ফর্মুলা হলিউডে কাজ করে, তা হলে বলিউডেও করবে বলে ধরে নেওয়া যায়।
প্রথম দিনেই বক্স অফিসের সংখ্যা বলছে প্রায় ৫৫ কোটি টাকার ব্যবসা করেছে ‘পাঠান’। এই নতুন ব্রহ্মাণ্ড বলিউডের হাল ফেরাবে বলেই আশা করছেন সকলে। এক দিকে, দক্ষিণী ছবি নিজের মতো বাজার মাতাচ্ছে। ‘কেজিএফ টু’-এর পর আসছে ‘পুষ্পা টু’, ‘পোন্নিয়িন সেলভান টু’-র মতো একাধিক ছবি। সকলেই ফ্র্যাঞ্জাইজ়ির দিকে ঝুঁকছে ব্যবসা বাড়ানোর জন্য। অন্য দিকে, হলিউডের দেখানো পথে হাঁটছে বলিউডও। সেখানে আমাদের বাংলা সিনেমা কী ভাবছে? ২০১৭ সালের দেবের ‘ককপিট’-এ দেখা গিয়েছিল প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে। কিন্তু তাতেই বিস্তর গোলমাল বেধেছিল। সে আবার মিটেও গিয়েছে অবশ্য। সকলেই এখন বাংলা সিনেমার পাশে দাঁড়ানোর জন্য গলা ফাটান। কিন্তু বাংলা সিনেমার বাজার বিস্তার করার কোনও রকম ভাবনা কি রয়েছে ইন্ডাস্ট্রির? না কি যা হচ্ছে, তাতেই সন্তুষ্ট টলিউড?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy