বাঁ দিকে নন্দিনী পাল এবং ডান দিকে তাপস পাল।— ফাইল চিত্র
সত্যিটা সকলের জানা প্রয়োজন। তাপস চলে যাওয়ার পর এত রকমের ভুল কথা শুনেছি এবং এখনও শুনে চলেছি যে, কথাগুলো না বললেই নয়। নয়তো, সোহিনী এবং আমার বেঁচে থাকাটাই কষ্টকর হয়ে যাবে। সোহিনী, আমি শুধু শুনেই যাচ্ছি... আর পারছি না আমরা!
সোহিনী, মানে আমাদের মেয়ের এক মাসের জন্য আমেরিকা যাওয়ার কথা ছিল। সে কারণেই গত ২৮ জানুয়ারি তাপস এবং আমি মুম্বই এসেছিলাম। কে জানত, সেটাই আমাদের শেষ একসঙ্গে বেরনো! ও মেয়েকে দেখতে চেয়েছিল। আর মেয়ের যে দুটো বিড়ালছানা, তাপস যাদের নাতি-নাতনি বলত, তাদেরও ভীষণ ভালবাসত। সবাই মিলে একসঙ্গে কাটানো— একই সঙ্গে একটু চেঞ্জ। এ সব ভেবেই আমরা কলকাতা থেকে মুম্বই এসেছিলাম। তবে, তাপসের শারীরিক অবস্থা নিয়ে কলকাতার ডাক্তারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল।
মেয়ে আমেরিকা চলে গেল ১ ফেব্রুয়ারি। সে দিন রাতে তাপস হঠাৎই বমি করে। রাতের খাবারে সে দিন সিদ্ধ চিঁড়ে আর ডিম সেদ্ধ খেয়েছিল। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম, অ্যাসিডিটির কারণে বমি হয়েছে। তাই অ্যান্টাসিড খাওয়াই তাপসকে। কিন্তু, বমি কিছুতেই থামছিল না। আমার চিন্তা বাড়তে থাকে। রাতও বাড়ছিল। মনে হল, এ বার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত। মেয়ের বাড়িওয়ালা সেই সময় আমাকে খুব সাহায্য করেন। ওঁর চেষ্টাতেই আমি বান্দ্রার এক হাসপাতালে তাপসকে নিয়ে যাই। মনে মনে ভাবছিলাম, কী আর এমন হবে, হয়তো স্যালাইন দিতে হবে ওকে!
হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর ডাক্তার দেখলেন ওকে। বললেন, তাপসের ‘হাইপোগ্লাইসিমিয়া’ হয়েছে, মানে হঠাৎ করে সুগার কমে গিয়েছে। আমাকে বলা হল, ‘‘আমরা অক্সিজেন দিচ্ছি। আপনি এই ফর্মটা ফিলআপ করে দিন।’’ আমি যখন ওই ফর্মটা ভর্তি করে হাসপাতালকে দিলাম, ওঁরা জানালেন, এখুনি ৫০ হাজার টাকা দিতে হবে। আমি ওঁদের বললাম, চিকিৎসাটা শুরু হোক। সুস্থ হোক তো মানুষটা। বাড়ি গিয়ে ৫০ হাজার কেন, যা লাগবে তাই দিয়ে দেব। এখন সঙ্গে ৫০ হাজার নেই। আমি তো ওকে নিয়ে জাস্ট বেরিয়ে পড়েছিলাম। অত টাকা নিয়ে বেরোইনি।
কিন্তু, আমার কথায় ওঁরা কান দিতে চাইলেন না। বললেন, ৫০ হাজার টাকা এখুনি দিতে হবে। না হলে...
পরিবারের সঙ্গে তাপস পাল
শেষমেশ টাকার ব্যবস্থা হল। ওকে তত ক্ষণে আইসিইউতে দিয়েছে। পুনম নামের এক চিকিৎসক এলেন। উনি সরাসরিই জানিয়ে দিলেন, তাপসের কোনও ‘পাস্ট হিস্ট্রি’ জানতে মোটেই আগ্রহী নন। এখন কী হয়েছে সে বিষয়ে আমাকে বলতে বলা হল। তাপস তখন আমার দিকে তাকিয়ে। জানতে চাইল, ক’টা বাজে? আমি ওকে সময়টা জানিয়ে বললাম, বাইরেই আছি। তুমি ভাল হয়ে যাবে। তোমায় ছেড়ে কোথাও যাব না আমি। আমাকে এর পর জানানো হল, তাপসকে ভেন্টিলেশনে দেওয়া হবে। আমি তো অবাক! কলকাতায় ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলি। উনি আশ্বস্ত করলেন। বললেন, ‘‘চিকিৎসার জন্য অনেক সময় ভেন্টিলেশনে দিতে হয়।’’ রাজি হলাম।
সোহিনী তখনও আকাশে। ও এ সবের কিছুই জানে না। আমেরিকায় নামার পরে ওর বন্ধুরা জানায়। ও পরের ফ্লাইট ধরেই ফিরে আসে। যাই হোক, পরের দিন ডাক্তারের সঙ্গে আমার দেখা হল। লিপিকা পারুলেকার। উনি বাঙালি। বিয়ে করেছেন অবাঙালিকে। বাংলায় কথা বললেন। ভাবলাম, ভগবান সহায় হয়েছেন। আশ্বস্ত হলাম। অন্তত বাঙালি এক জন কাউকে পেলাম। কথাটুকু তো বলতে পারব। তাপসকে নিয়েও উনি বেশ উৎসাহ দেখালেন। আমি তখন তো শুধু মানুষটাকে বাঁচাতে চাই। বাড়ি ফেরাতে চাই। আর কিছু ভাল লাগছে না আমার। আমারই অনুরোধে তাপসের কলকাতার ডাক্তারের সঙ্গেও লিপিকা কথাও বললেন।
এর পর ৭ ফেব্রুয়ারি ভেন্টিলেশন থেকে বেরিয়ে এল তাপস। স্পষ্ট মনে আছে, হাসল আমায় দেখে। বলল, বাব্বা এটা তুমি কী করলে? আচ্ছা এই নল কবে খুলবে?
দু’বছর ধরে ওর কিডনির সমস্যা ছিল। কিন্তু, ডায়ালিসিসের প্রয়োজন হত না। এই হাসপাতালে ওর ডায়ালিসিস চালু হয়। আমি সম্মতিও দিয়েছিলাম। প্রচুর অ্যান্টিবায়োটিকও চলছিল সঙ্গে। কয়েক দিনের মধ্যে দেখলাম ওর প্রস্রাব আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হচ্ছে। আমি নিয়মিত কলকাতার ডাক্তারকে সব জানাচ্ছিলাম। ওঁর কথা মতো হাসপাতালকে বললাম, এখন যদি তাপসের ক্যাথিটার খুলে দেওয়া যায়। কারণ, ক্যাথিটার থেকেও অনেক সময় সংক্রমণ হয়। কিন্তু, ওরা বিষয়টাকে আমলই দিলেন না। অন্য দিকে, তাপসও স্বাভাবিক হচ্ছে। খুব খিদে পাচ্ছে ওর। সেটা তো ভালই। হলে হবে কী? ওদের কাছে না কোনও বিস্কুট আছে, না আছে স্যুপ। যত খিদেই পাক, খাবার সেই সাড়ে আটটায় দিচ্ছে। এ সব হাসপাতালকে বলায়, এক নার্স তো আমার মেয়েকে বললেন, ক্যাফেটেরিয়া থেকে খাবার এনে খাওয়াতে! রোগীকে ক্যাফেটেরিয়ার খাবার? মেয়ের সঙ্গে তো ঝামেলাই হয়ে গেল ওই নার্সের।
এ ভাবেই চলছিল। এক দিন গিয়ে দেখি তাপসকে বেঁধে রেখেছে। ঘাবড়ে গিয়েছি ও রকম দেখে! আমায় তাপস বলল, ‘‘এক ভাবে শুয়ে আছি। একটু উঠে হাঁটতে চেয়েছি। তাই দেখো, ওরা আমাকে বেঁধে রেখেছে।’’ খুব কষ্ট হচ্ছিল এ ভাবে ওকে দেখে। এক জন রোগীর সঙ্গে এ কেমন ব্যবহার! আমি প্রশ্ন করায় আমাকে হাসপাতাল থেকে বলা হল, ‘‘আমাদের শিফ্টিং চলছে। এখন কোনও এক জন সিস্টার ওকে নজরে রাখতে পারবে না। তাই বেঁধে রাখা হয়েছে।’’ আমি তাপসের হাত-পায়ের বাঁধন খুলে বেড-টা তুলে ওকে বসাই। আচ্ছা, এটুকু ওরা করতে পারতেন না?
মেয়েকে কোলে নিয়ে তাপস পাল, সঙ্গে স্ত্রী সোহিনী
আমাদের কলকাতার ডাক্তার সমানে লিপিকাকে বলতে থাকেন, অ্যান্টিবায়োটিক বদলানোর জন্য। তাপসের ব্লাড কাউন্ট ভাল হচ্ছে। ১৭ দিন ধরে এক অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া ঠিক নয়। কিন্তু, লিপিকা গুরুত্ব দেননি। আমি শুধু হাতে-পায়ে ধরতে বাকি রেখেছিলাম, তাপসকে ওয়ার্ডে দেওয়ার জন্য। তা হলে আমি নিজে ওর দেখাশোনা করতাম। কিন্তু, সেটাও করা হয়নি।
তাপসের ডান দিকের ঘাড়ে সেন্ট্রাল ভেনাস ক্যাথিটার লাগানো হয়েছিল। ওটার মাধ্যমেই ডায়ালিসিস, খাওয়াদাওয়া— সবই চলছিল। এই হাসপাতাল সেটাকে এক বারও বদল করেনি। এক দিন দেখি ডান দিক শুধু নয়, বাঁ দিকেও একটা সেন্ট্রাল ভেনাস ক্যাথিটার লাগিয়েছে। আর সেটা করতে গিয়ে ওর চোখেও ব্যথা দিয়েছিল। তাপসই আমায় সেটা জানায়। বাঁ দিকে লাগানোর পর আমি বলেছিলাম, ডান দিকেরটা খুলে দিতে। ডাক্তার বললেন, ওটা নাকি সিস্টার খুলবেন। ও রকম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সিস্টার খুলবেন!
এক দিন ভিজিটিং আওয়ার্সে এসে দেখি, তাপসকে ওঁরা বসানোর চেষ্টা করছেন। বসাতে গিয়ে পাঁচ মিনিটের জন্য ও অজ্ঞান হয়ে যায়। আমি জানতে চাইলে হাসপাতালের তরফে বলা হয়, ‘‘হি ইজ ক্লিনিক্যালি ফাইন।’’ আমি জানতে চাইলাম, ‘‘ইজ হি থিওরিটিক্যালি ওকে?’’ উত্তর নেই। আমাকে কাগজপত্রও দেখাচ্ছে না। কিন্তু, অজ্ঞান হল কেন? তার জবাবে বলা হল, ‘‘প্রেশার ফল করেছে।’’ যদি প্রেশার ফল করে, তা হলে ডায়ালিসিস করাচ্ছেন কেন? প্রশ্ন করি আমি। কারণ তাপসের ক্রিয়েটিনিন কাউন্ট ভালই ছিল। সে দিন অন্তত ডায়ালিসিস না করলেও চলত। উত্তর পাওয়ার আগেই ওরা ডায়ালিসিস করল!
১৭ ফেব্রুয়ারি। মেয়েকে বাবা বলল, ‘‘তুমি আমায় কেন বাড়ি নিয়ে যাচ্ছ না?’’মেয়ে কথা দিল বাবাকে, এ বার বাড়ি নিয়ে যাবে। বাবা-মেয়ের আদর হল। আমরা সে দিন মনে মনে ঠিক করেছি, তাপসকে ওখান থেকে বার করে আনব। পরের দিনই যদি ওকে কলকাতা নিয়ে আসা যায়, এ রকমই ভেবেছি। সেই মতো ব্যবস্থাও করেছি।
গত ১৬ জানুয়ারি বিবাহবার্ষিকীর দিন অভিনেতা। নিজস্ব চিত্র
হঠাৎ সে দিন রাতেই মেয়ের কাছে ফোন, ‘‘হি ইজ নট রেসপন্ডিং।’’
মেয়ে তো শুনেই দেড় ঘন্টার রাস্তা ৪০ মিনিটে আমাকে উড়িয়ে নিয়ে পৌঁছল। তাপসের কাছে গিয়ে ও আমাকে বলল, ‘‘মা দেখো, বাবা পুরো ঠান্ডা!’’
আমাদের বলা হল ‘ইন্টারনাল ব্লিডিং’ হচ্ছে। হিমোগ্লোবিন ৩.৯ হয়ে গিয়েছে। সকালেই দেখে গিয়েছি হিমোগ্লোবিন ৯-এর এর উপরে ছিল। তার রিপোর্ট আজও পাইনি। মেয়ে তখন ওদের বলছে, ‘‘বাবাকে ব্লাড দিন আগে। আমার কনসেন্টের জন্য কেন অপেক্ষা করছেন আপনারা?’’ এক জন ট্রেনি আর অন্য জন যিনি ছিলেন, এক মাস আগে তাঁকে দেখেছিলাম। লিপিকার খোঁজ করলাম। কিন্তু তাঁর দেখা পেলাম না সেই সময়ে।
আমি বুঝতে পারছিলাম, হিমোগ্লোবিন যাঁর ৩.৯, যাঁকে রক্তও দেওয়া হয়নি, তাঁর কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হবেই। হলও তাই। আবার ভেন্টিলেশন। আবার অ্যাটাক। তার পর সব শেষ!
শেষ যাত্রায় তাপস পাল
তাপসের দেহ এল। আমাদের ডাক্তারও তত ক্ষণে পৌঁছে গিয়েছেন। উনি দেহ দেখেই আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘‘ওই যে ডান দিকের সেন্ট্রাল ভেনাস ক্যাথিটার, ওটা সিস্টার টেনে খুলেছেন। ওখানে হেমাটোমা হয়ে আছে। ওখান থেকেই ইন্টারনাল ব্লিডিং হয়েছে। কেউ দেখেনি!’’
মনে পড়ছে, ১৯৯৫ সালে তাপসের অত বড় ব্রেন অপারেশন হল। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এল। ২১ দিন কোমায় ছিল। তার পর অনেক কাজ করেছে। গত কয়েক বছর ধরে তাপসকে যে ভাবে জনমানসে তুলে ধরা হয়েছে, সেটা আমাদের সবাইকে খুব ব্যথিত করেছে। কেউ কিছু না জিজ্ঞেস করেই নানা রকম মন্তব্য ওর সম্পর্কে করে আসছিল। শুনে শুনে মেয়ে আর আমি ক্লান্ত। এ বার এগুলো বন্ধ করতে চাই।
তাপসের কোনও রিপোর্ট সরাসরি আমাদের দেননি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। যা রিপোর্ট দিয়েছেন, সে সবও অসম্পূর্ণ। আর ওই লিপিকাকেও আজ পর্যন্ত দেখিনি। কেবলই মনে হচ্ছে, আমার স্বামীকে ওরা মেরে ফেলল!
তাপসের মধ্যে অনেক জ্বালা ছিল! কোনও প্যাঁচপয়জার জানত না মানুষটা। অনেক প্রশ্নের জবাব দিয়ে যেতে পারেনি ও।
কিন্তু, আমাকে জবাব পেতেই হবে। আমি মুম্বইতে এসেছি। ওই হাসপাতালের কাছে জবাব চাইতে। এটা তো আমার অধিকার। আমি জবাব না নিয়ে ফিরব না! তাতে যত দূর যেতে হয়, যাব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy