বাংলায় সাহানা-স্যমন্তকের মতো জুটি বিরল, কোন জাদুতে এতটা পথ একসঙ্গে পাড়ি তাঁদের? ছবি: ফেসবুক।
নববর্ষে শহরের বুকে আবার একসঙ্গে অনুষ্ঠান করছেন জনপ্রিয় জুটি সাহানা-স্যমন্তক। দীর্ঘ ১০ বছরের সঙ্গীতযাত্রায় ভৌগোলিক দূরত্ব বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। লন্ডনে অধ্যাপনার পাশাপাশি ফোনেই স্যমন্তকের সঙ্গে সংযোগ রেখে চলেন সাহানা। যখন আসেন শান্তিনিকেতনের বাড়িতে, স্যমন্তকও সঙ্গী হন। একসঙ্গে শুরু হয় ‘জ্যামিং’। লোকগান, রবীন্দ্রসঙ্গীত বা বব ডিলান— হৃদয় তাঁদের এক তারে বাঁধা। আবার একসঙ্গে শো করেন গোটা বিশ্বে। একসঙ্গে একাধিক গানের অ্যালবাম— মৌলিক কিংবা রবীন্দ্রসঙ্গীতে। বাংলায় এমন জুটি বিরল, কোন জাদুতে এতটা পথ একসঙ্গে পাড়ি তাঁদের? খোঁজ নিল আনন্দবাজার অনলাইন।
প্রশ্ন: বাঙালিয়ানা বলতে আপনারা কী বোঝেন?
স্যমন্তক: আমার মনে হয় পার্কস্ট্রিটে গিয়ে মোকাম্বোতে স্টেক খাওয়া আর বাড়ি বসে তৃপ্তি করে বিউলির ডাল, পোস্তর বড়া কিংবা আলুপোস্ত— দুটোই বাঙালিয়ানা। অন্যান্য ভাষার গান শোনা এবং তার সঙ্গে বাংলা গান ভালবাসা। ভীষণ ভাল ইংরেজি বলা, কিন্তু সঙ্গে বাংলা ভাষাটাও স্পষ্ট করে সম্মানের সঙ্গে বলতে পারা জরুরি।
সাহানা: আমার কাছে বাঙালিয়ানা মানে বাংলা ভাষায় কথা বলা, বাংলা গান শোনা, বাংলার সব উৎসব উদ্যাপন করা। সারা পৃথিবীর সামনে জোর গলায় বলতে পারা যে, আমি বাঙালি। সেই সঙ্গে বাঙালি খাবার, যেটা আমি খেতে খুব ভালবাসি।
প্রশ্ন: লন্ডন থেকে থেকে এসে শান্তিনিকেতনের গরমে কষ্ট হচ্ছে না?
সাহানা: আমি তো বীরভূমের মেয়ে, ছোট থেকে গরম সহ্য করার অভ্যাস রয়েছে। তবে এতটা দেখিনি। শান্তিনিকেতনে যেমন গরম বেড়েছে, লন্ডনেও বেড়েছে। তবে রোহিণীর এখানে এসে একটু অসুবিধা হচ্ছে।
প্রশ্ন: রোহিণী কি মায়ের মতো গানে আগ্রহী?
স্যমন্তক: আমার কাছে গিটার শেখে মাঝেমাঝে, কিন্তু গানের চেয়ে ওর নাচে বেশি আগ্রহ।
প্রশ্ন: সাহানা, আপনি আর স্যমন্তক কবে বুঝলেন যে জুটি বাঁধা যায়?
সম্যন্তক: জ্যামিং সেশনের মধ্যে দিয়ে। এ ভাবেই তো একটা আদানপ্রদান হতে থাকে। আমি আগে থেকেই সাহানাকে চিনতাম। ইন্দোনেশিয়াতে একটা অনুষ্ঠানে সুযোগ পেয়েছিলাম একসঙ্গে গাইবার। সেই শুরু। আড্ডা দিতে দিতেই হয়েছিল। সেখানে বব ডিলনের গানও ছিল, ফোকও ছিল, আবার রবীন্দ্রসঙ্গীতও ছিল। এই ভাবেই ব্যাপারটা দাঁড়িয়ে যায়।
সাহানা: ২০১৩ সাল থেকে আমরা একসঙ্গে অনুষ্ঠান করছি। এটা শুরু হয়েছিল ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায়। শুধু গিটার আর দুটো গলা। এর পর ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া— বহু জায়গায় শো করেছি। লন্ডনে স্যমন্তক একটা মিউজ়িক প্রোডাকশন কোর্স করতে এসেছিল। ওখানে গাইলাম। মানুষজন এর পর আমাদের কথা জানতে পারেন, তাঁরা বার বার ডাকেন। সিনেমা, সিরিজ়েও আমাদের গান জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ২০২২ সালে সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘এক্স=প্রেম’ ছবিতে আমার আর স্যমন্তকের গাওয়া ‘বায়নাবিলাসী’ গানটা জনপ্রিয় হয়েছিল।
প্রশ্ন: গান তো ছেড়েই দিয়েছিলেন প্রায়, স্যমন্তক কি আপনার মধ্যে আবার নতুন করে গাওয়ার উন্মাদনা তৈরি করেন?
সাহানা: ঠিক তাই। অধ্যাপনা, গবেষণার চাপে অনেকটা সময় গান ছেড়ে ছিলাম। ইচ্ছাও করত না গাইতে।তা ছাড়া, সমমনস্ক শিল্পীও তেমন পাইনি। স্যমন্তকের জন্যই আবার গান গাওয়া শুরু। ওর সঙ্গে আমার গানবাজনার ভাবনা, পরিধিও অনেকটা মেলে। ২০১৪ সালে মৌলিক গানের অ্যালবাম ‘শিকড়’ বেরোল। স্যমন্তকের মিউজ়িক ছিল। পরের কাজগুলোরও তাই। এই ভাবেই চলতে থাকল।
প্রশ্ন: সাহানার সাজপোশাক থেকে শুরু করে সবই বেশ সাবেকি। স্যমন্তক যাকে বলে ‘বং’, বৈপরীত্যই কি জুটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য?
স্যমন্তক: (একচোট হেসে) আসলে, সাহানা শাড়ি পরতে ভালবাসে। ওর প্রচুর শাড়ি আছে। আমি আবার একটু মুডি। যখন যেটা মনে হয়, পরে নিই। সচেতন ভাবে কিছু করি না। কোনও কিছুর জন্যই নিজের চরিত্র বা সাজপোশাক বদলে ফেলার মতো মানুষ আমি নই। টপ্পাঙ্গের গানও আমি মঞ্চে জিন্স-টি-শার্ট পরে গেয়েছি, আবার পাঞ্জাবি পরেও গেয়েছি। আসলে ভিতরের মানুষটা তার শিল্পমাধ্যমকে কতটা সম্মান করছে, সেটাই আসল কথা।
প্রশ্ন: দু’জনের গাওয়ার ধরনেও এই তফাতটা হয় নাকি?
স্যমন্তক: এটাও এক ধরনের মাইন্ডসেট বলে মনে হয়। আমার গলার টেক্সচারটা অন্য রকম, হয়তো ব্যান্ড মিউজ়িক করেছি বলে। আমিও কিন্তু স্বরলিপি মেনেই গাইছি। কিন্তু শুনতে অন্য রকম লাগছে। রবীন্দ্রনাথের গানের ম্যানারিজ়মগুলো আমি নিচ্ছি না গায়কিতে। খুব কিছু আলাদা গাইছি না আমি আর সাহানা। তবে, যে হেতু ওর প্রথম অ্যালবামটাই ছিল রবীন্দ্রসঙ্গীতের, ও রবীন্দ্রনাথের গান গেয়েছেও বেশি। ফলে এটা হয়তো মনে হয়েছে অনেকের, যে ওর গাওয়াটা অনেক বেশি শুদ্ধ। আমার গলাটা প্লেব্যাক বা ব্যান্ড মিউজ়িকের সঙ্গে বেশি যায়।
প্রশ্ন: অনেকেরই ধারণা, স্যমন্তক-সাহানা হচ্ছেন নতুন অর্ণব এবং সাহানা জুটি। দর্শক- শ্রোতাদের সেই অনুযায়ী কৌতূহল এবং প্রত্যাশাও তৈরি হচ্ছে।
সাহানা: (আশ্চর্য হয়ে) তাই নাকি! এটা হঠাৎ করে কেন হচ্ছে, জানি না। আমরা তো ১০ বছর ধরে একসঙ্গে গানবাজনা করছি। ভাবতেই পারছি না, আমাদের নিয়ে এ সব চর্চা হয়! সেই সময়টা পেরিয়ে এসেছি। আমি এখন অন্য মানুষ।
স্যমন্তক: অর্ণব এক জন অসাধারণ শিল্পী। তাঁর সঙ্গে কেউ আমার তুলনা করলে সে আমার সৌভাগ্য। তবে, যে কারণে এই তুলনাটা আসছে, সেটা ঠিক নয়। প্রেম নেই আমাদের। ওটা ছাড়া আর সবটাই আছে। আমাদের জার্নিটা খুবই মিউজ়িক্যাল। যোগাযোগটাও পারিবারিক। সাহানার মা-ও আমাদের পরিবারের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। কাকিমা কলকাতায় এলে আমাদের সঙ্গেই থাকতেন। বহু বছরের ঘনিষ্ঠতা। আমরা তো ছোট থেকে কুমার শানু-অলকা যাজ্ঞিক বা উদিত নারায়ণ-অলকা যাজ্ঞিকের গান শুনেছি। তাঁদের মধ্যে তো প্রেম ছিল না। গানের জুটিই তো হিট।
প্রশ্ন: আসলে অর্ণব-সাহানা পর্বের গান এবং সাহানার মৌলিক গান অনেকেই ভালবাসতেন, এখনও বাসেন।
সাহানা: আমি নিজেকে কখনও গান-লিখিয়ে হিসাবে ভাবিনি। ছোটবেলায় পনেরো-ষোলো বছর বয়সের সেই সব লেখা মানুষ যে এত ভালবেসে শুনবেন, তা-ও বুঝিনি। ওগুলো ছড়ার মতো। এমনটা অনেকেই করে। সবটাই হয়েছিল সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। তখন সুমনদার গান বেরোচ্ছে, মৌসুমী ভৌমিকের গান বেরোচ্ছে। আমরা ভেবেছি, আমরাও কিছু করি। ‘ইনডিপেনডেন্ট মিউজ়িক’-এর সময় ছিল তখন। সেই সময়টা চলে গিয়েছে। পরে অবশ্য কয়েকটা গান লিখেছি। স্যমন্তক মৌলিক গান হিসাবে সেগুলো গেয়েছে।
প্রশ্ন: যে কোনও জুটির ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয়টা?
সাহানা: সঙ্গীতের রুচি এক রকম হওয়া। কাদের জন্যে গাইছি, সেটা স্পষ্ট করে নেওয়া। অর্থাৎ, শ্রোতা নির্বাচন। যেমন, আমি বা স্যমন্তক— কেউই তো হিন্দি গান গাই না। কাজেই, বাংলা গান ভালবাসেন, এমন শ্রোতারাই আমাদের মূল লক্ষ্য।
প্রশ্ন: মতপার্থক্য কি একেবারেই হয় না?
স্যমন্তক: গানবাজনা নিয়ে তো ঝগড়া হয়ই। একটা মাঝামাঝি পথ নিতে হয়। ইগোর জন্যে অনেক বড় বড় ব্যান্ড ভেঙে যেতে দেখেছি। এ ব্যাপারটা নিয়ে আমরা খুব সচেতন থাকি। কারণ, নিজেদের ভাল লাগাটা চাপিয়ে দেওয়ার একটা প্রবণতা মিউজ়িশিয়ানদের থাকে। প্রত্যেকের আর্টিস্টিক মতামতকে সম্মান করাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কোলাবরেট করতে গেলে অন্য দিকের মতটা শোনাও খুব জরুরি।
প্রশ্ন: ‘গানের ওপারে’ ধারাবাহিকে গোরা চরিত্রের জন্য গান গাওয়ার পর স্যমন্তককে অনেক কটাক্ষ শুনতে হয়েছে। অন্য দিকে, রবীন্দ্রসঙ্গীতে সাহানার প্রতিষ্ঠা অনেক দিনের। তাঁর নিজস্ব শ্রোতা তৈরি। হঠাৎ একসঙ্গে অনুষ্ঠান করতে আশঙ্কা হয়নি?
সাহানা: আমিও কিন্তু হারমোনিয়াম-তবলা নিয়ে গান করি না। সব সময় স্বাতন্ত্র্য রাখতে চেয়েছি। সাউন্ড নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি। আর স্যমন্তকের ক্ষেত্রে বলব, না, একসঙ্গে অনুষ্ঠান করতে কোনও ভয় করেনি। ও তো রবীন্দ্রভারতী থেকে মাস্টার্স করেছে। ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে। ও আমাকে স্বরলিপি শিখিয়ে দিতে পারে। স্যমন্তকের সঙ্গে গাইছি বলে কেউ আমায় কিছু বলবে, এমনটা কখনওই মনে হয়নি। আমি ঠিক ওই পথে হাঁটার মানুষ নই।
প্রশ্ন: আপনি তো মৌলিক গান গাইবেন বলে ভেবেছিলেন?
স্যমন্তক: হ্যাঁ, সেটাই আমি করে আসছি অনেক বছর ধরে। নিজের ব্যান্ডের জন্য গেয়েছি। ইউটিউব চ্যানেলের জন্য গেয়েছি। নিজে লিখে, সুর করে। সাহানার লেখা অনেক গানও গেয়েছি। অন্য বন্ধুদের লেখা গানও। তবে, বেশি জনপ্রিয় হয়েছে রবীন্দ্রনাথের গান। ‘গানের ওপারে’র মতো মূলধারার ধারাবাহিক এ ক্ষেত্রে অনেকটা ভূমিকা নিয়েছে।
প্রশ্ন: মৌলিক গানগুলো তুলনায় এত কম জনপ্রিয় কেন দু’জনেরই?
স্যমন্তক: আসলে, মৌলিক গান বাজানোর পরিসরটা কমে এসেছে। আগে শ্রীকান্তদার (আচার্য) ‘বৃষ্টি, তোমাকে দিলাম’ও রেডিয়োতে বাজত, রবীন্দ্রনাথের গানও বাজত। গানগুলো মানুষের কাছে পৌঁছত। এখন আর রেডিয়ো-টিভিতে মৌলিক গান বাজানো হয় না। রবীন্দ্রনাথের গান সেখানে ‘ইজ়ি ফর্মুলা’। শুধু ইউটিউবের গান জনপ্রিয় করার সেই ক্ষমতা নেই। লোকে মৌলিক গানের ক্ষেত্রে ভাবছে, এটা তো পপুলার নয়। অথচ, ‘আমার পরান যাহা চায়’ গাইলে দু’লাখ লোক শুনছে। আর মানুষজনের ধৈর্যও অনেক কমে গিয়ে এক মিনিটের গানে বা রিলে চলে এসেছে। মৌলিক গান শোনার সেই মনোযোগও নেই।
প্রশ্ন: নতুন কী কাজ আসছে?
স্যমন্তক: এই মুহূর্তে সাহানা ওর পিএইচডি নিয়ে ব্যস্ত। আমি ব্যান্ডের কাজ নিয়ে। হয়তো এর পর সাহানা আমার কম্পোজ়িশনে কিছু মৌলিক গান গাইবে। সেই লক্ষ্যেই এগোচ্ছি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy