মুকেশ তিওয়ারি। ছবি: সংগৃহীত।
প্রায় ২৫ বছরের অভিনয়জীবন অভিনেতা মুকেশ তিওয়ারির। মূলত খল চরিত্রেই তাঁকে দেখতে অভ্যস্ত দর্শক। কিন্তু রোহিত শেট্টির ‘গোলমাল’ ফ্র্যাঞ্চাইজ়ির ছবিতে কৌতুকাভিনেতা হিসেবেও দেখা গিয়েছে তাঁকে। দিন কয়েক আগে কলকাতায় এসেছিলেন অভিনেতা। উপলক্ষ, নিজের ছবি ‘ম্যায় মুলায়ম সিংহ যাদব’ ছবির প্রদর্শন। সেখানে এসে আনন্দবাজার অনলাইনের মুখোমুখি অভিনেতা।
প্রশ্ন: মুলায়ম সিংহের মতো একজন চরিত্রের পাশে অন্য চরিত্রেরা কি চাপা পড়ে যায়?
মুকেশ: না, তেমন নয়। এই ছবিতে আমাকে এক নেতার চরিত্রেই দেখা যাবে, যে একটু বদমেজাজি। যে কৃষকের হকের জন্য লড়াই করে। একটা আর্দশগত লড়াই দেখানো হয়েছে। শুধুই আন্দোলন নয়, বরং যুক্তি-তর্ক দিয়ে তৈরি একটা চরিত্র। বর্তমানে সময়ে এই ধরনের চরিত্র খুবই গ্রহণযোগ্য।
প্রশ্ন: পুরো ছবিটা দেখা হয়েছে?
মুকেশ: না, আমার ছবিটা দেখা হয়নি।
প্রশ্ন: এই মুলয়াম সিংহের চরিত্রে যিনি রয়েছেন তিনি নবাগত, ছবিতে কাজের অভিজ্ঞতা কেমন?
মুকেশ: হ্যাঁ প্রথমে আমিও ভেবেছিলাম ঠিক মতো অভিনয় করে উঠতে পারবে তো, এমন একটা ওজনদার চরিত্র! তবে অমিত (পর্দার মুলায়ম) খুব বুদ্ধিমান অভিনেতা। নিজের ‘হোমওয়ার্ক’ করেই সেটে আসত। আমাদের তো অভিনয় নিয়ে পড়াশোনা রয়েছে। অমিতের তেমন কোনও প্রেক্ষাপট নেই, তবু খুবই ভাল কাজ করেছে। আসলে, ছেলেটা মনোযোগী, সৎ। তবে প্রথমে আমার মনে হয়েছিল, মুলায়ম সিংহের চরিত্রে অভিনয় করেছে, আর একটু ভারিক্কি চেহারা হলে ভাল হত। কুস্তির দৃশ্য যখন দেখলাম, তখন বুঝলাম, না, এই ছেলে একেবারে ঠিক আছে। সব সময় বড়দের থেকেই অনুপ্রাণিত হতে হবে এমন কথা নেই। ছোটদের থেকে, যাঁরা অনভিজ্ঞ তাঁদের থেকেও অনেক কিছু শেখার আছে।
প্রশ্ন: বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে হিন্দি ছবির দর্শক জীবনীচিত্র পছন্দ করছেন?
মুকেশ: আসলে ‘বায়োপিক’ তখনই হয় যখন কোনও চরিত্র জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন কিংবা খ্যাতনামী হয়ে ওঠেন। যেমন ধরুন, মেরি কমকে নিয়ে ছবি হয়েছে। দর্শকের তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে জানার আগ্রহ রয়েছে বলেই ছবি তৈরি হচ্ছে। আসলে যে ধরনের গল্প মানুষের অনুপ্রাণিত করে, সেই গল্প দেখার আগ্রহ সব সময় থাকে দর্শকদের।
প্রশ্ন: আপনার নিজের জীবনের গল্পটা কেমন?
মুকেশ: একজন অভিনেতা ও খেলোয়াড়ের জীবনটা একই রকমের হয়। যত ক্ষণ পর্যন্ত তুমি নিজেকে গোটা দুনিয়ার সামনে প্রমাণ করতে না পারছ, তত ক্ষণ তুমি নিঃসঙ্গ। আমি ১৯৯১ সালে বাড়ি ছেড়েছিলাম, অভিনয় শিখব বলে। তখন ফিল্ম স্কুল নিয়ে লোকের মাথাব্যথা ছিল না। বর্তমান সময় বাবা-মায়েরা নিজের ছেলে মেয়েদের নিয়ে যান রিয়্যালিটি শোয়ে। আমাদের সময় ধারণা ছিল, একাদশ শ্রেণিতে অকৃতকার্য হলেই অভিনেতা হতে যান কেউ। তখন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও উকিল— এই তিনটেই পেশা ছিল। যার কিছু হয় না সে অভিনেতা হয়। তবে এখন সমাজ বদলেছে, দর্শকের দেখার চোখ পাল্টেছে।
প্রশ্ন: ওটিটি আসাতে আপনাদের মতো অভিনেতাদের কতটা সুবিধা হল?
মুকেশ: ওটিটি-র কারণে বিশ্বসিনেমা হাতের মুঠোয় এসে গিয়েছে। সেগুলি এতটা সহজলভ্য হওয়ায় দর্শকের দেখার ব্যাপ্তি বেড়েছে। ভাল কাজের কদর বেড়েছে। তেমনই আমাদের মতো অভিনেতাদের কাজের সংখ্যাও বেড়েছে। ওটিটি-র কারণে পর্দায় চরিত্রের সময় অনেকটা বেড়েছে। আগে সিনেমায় মাত্র তিনটে দৃশ্যেই একটি চরিত্রকে বুঝিয়ে দিতে হবে এমন নিয়ম ছিল। এখন অবশ্য পর্দায় সময় বেড়েছে নায়ক ছাড়া অন্য অভিনেতাদেরও।
প্রশ্ন: আপনাকে বেশি ভাগ সময় দুষ্ট লোকের চরিত্রে দেখা যায়?
মুকেশ: হ্যাঁ আমার প্রথম ছবি ‘চায়না গেট’-এর চরিত্রটা এমনই ছিল। তার পর ‘গঙ্গাজল’-এর পর যেন এটাই প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেল, রাগী, বদমেজাজি, দুষ্ট লোকের চরিত্রেই যেন মানানসই আমি। তবে ‘গোলমাল’ ছবি সেই ধারণা ভেঙেছে। আসলে অভিনেতারা নিজেরাই অনেক সময় একটা আবরণ তৈরি করে নেন। নিজেদের খুব বেশি ভাঙতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। প্রেম চোপড়াদের সময়ের কথাই ভাবুন, যিনি খল চরিত্র করছেন, তিনি ওই একই ধরনের চরিত্র করে যাবেন। কিন্তু এখন দর্শকরা গ্রহণ করতে শিখেছেন। আমার আবাসনের বাচ্চা এখনও আমার নাম জানে না, ‘ওসুলি আঙ্কেল’ (গোলমাল ছবিতে অভিনীত চরিত্রের নাম) বলেই ডাকেই। দর্শকের কাছে কোনটা জনপ্রিয় হবে সেটা তো বোঝা যায় না। দর্শকই পারেন একজন অভিনেতার কেরিয়ার গড়তে ও ভাঙতে।
প্রশ্ন: এমন কোনও চরিত্র আছে যেটা আপনি করতে চান?
মুকেশ: আমি ‘স্পর্শ’ ছবিতে নাসিরুদ্দিন শাহের চরিত্রটা করতে চাই কখনও। কারণ ওই ছবিতে একেবারও মনে হয়নি তিনি অন্ধের অভিনয় করছেন। ‘সেন্ট অফ উইমেন’ ছবিতে যেমন অ্যালপাচিনো অভিনয় করেন। তবে এখানে একজন বাংলার অভিনেতার নাম উল্লেখ করতেই হবে। তিনি উৎপল দত্ত। আমাদের পড়াতে আসতেন। ওঁর মতো অভিনেতা খুব কম দেখেছি, অদ্ভুত! ওঁর যে কোনও সিনেমা দেখেলেই বুঝতে পারবেন অভিনয়ের ব্যাপ্তি ঠিক কতটা। মজার বিষয়, উনি মুম্বইয়ে শুটিং করতে আসতেন কিন্তু থাকতেন না কখনও। সন্ধ্যার বিমান ফেরত চলে যাবেনই। যেমন ভাল অভিনেতা ছিলেন তেমনই ভাল লিখতেন।
প্রশ্ন: সুজিত সরকারের সঙ্গে কাজ করেছেন কেমন লেগেছিল?
মুকেশ: হ্যাঁ, সুজিত সরকারের সঙ্গে কাজ করেছি, উনিও এখন কলকাতাতেই থাকেন। বিজ্ঞাপনের কাজ করেন। কলকাতায় এসে ফুটবল খেলেন দেখি। আসলে নিজের শিকড়ের সঙ্গে জুড়ে থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তার প্রভাব শিল্পের উপরও পড়ে।
প্রশ্ন: তবে বর্তমান সময়ে অনেকের শিকড় আলগা হচ্ছে, মানেন?
মুকেশ: আজকে আমরা দেড় বছরের শিশুর হাতেও মোবাইল ফোন দিয়ে ইউটিউব চালিয়ে দিচ্ছি। আমি তো নিজের ভুলটা স্বীকার করি। আমি হয়তো অনেকে কিছুই নিজের সন্তানকে দিতে পারিনি, যেটা একান্নবর্তী পরিবারে থাকলে সম্ভব হত। তবে একান্নবর্তী পরিবার থেকে যখনই অনু পরিবারের দিকে পা বাড়ালাম, তার প্রভাব পড়ল শিশুদের উপরেই। বড় পরিবার থাকলে ভাবনা আদান-প্রদানটাও বেশি হয়। এখন তো সেই সুযোগই নেই, এই নতুন প্রজন্ম, যাঁদের ‘জেন জ়ি’ বলা হয়। তাঁরা একেবারেই আবেগপ্রবণ নয়। আমি দিল্লিতে পড়াশোনা করতাম, মধ্যপ্রদেশে আমার বাড়ি। যখন ছুটিতে বাড়ি ফিরতাম মায়ের সঙ্গেই ঘুমোতাম। এমনকি বিয়ের পরও মায়ের হাত, মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছি। তাই মা চলে যাওয়ার পর দু’বছর কাজ করতে পারিনি। মনে হত আমার সবচেয়ে বড় দর্শকই চলে গিয়েছে।
প্রশ্ন: আপনার যে সময় শুরু করছেন সেই সময় খল চরিত্র অভিনয় করা মানেই পর্দায় কুকাজ করা, পরিবার আপত্তি জানায়নি?
মুকেশ: ‘আগাজ়’ ছবির কথা। খল চরিত্রে ছিলাম সেখানে। একটা ধর্ষণের দৃশ্যে ছিল। ছবিটা মা দেখে বলেছিলেন, ‘এ সব করতে হলে বাড়ি ফিরে এসো।’ আমি মাকে বলি, আমার নিজেরই জ্বর এসে গিয়েছিল ওই দৃশ্য করতে গিয়ে। কিছুতেই মানতে চাননি মা। এই হচ্ছে সমস্যা। আগে তো অধিকাংশ ছবিতেই এই ধরনের দৃশ্য থাকত। এখন এগুলো বন্ধ হয়েছে, বাঁচা গিয়েছে।
প্রশ্ন: পরিচালকের আসনে নিজেকে দেখার ইচ্ছে রয়েছে?
মুকেশ: অভিনয় থেকে অবসর নিয়ে নিলে তখন। অভিনেতা ও পরিচালনা দু’টি কাজ একসঙ্গে করলে কোনটাই ভাল হবে না। একটা সময় ছিল যখন রাজ কপূর, গুরু দত্তরা একসঙ্গে দু’টি দিক সামলাতেন। অজয় দেবগনও করেন। এটার জন্য অসম্ভব দক্ষতার প্রয়োজন। আমার মনে হয় না, আমি সেটা পারব। অভিনয় ও পরিচালনা একসঙ্গে করা মুখের কথা নয়।
প্রশ্ন: বিশেষ কোনও ইচ্ছে?
মুকেশ: প্রথম থেকে অভিনেতা হতে চেয়েছি। সেটাই লক্ষ্য ছিল। আর ভেবেছিলাম দর্শক যাতে আমাকে গ্রহণ করেন। আমি যে জায়গা থেকে এসেছি সেখানে সমাজ অভিনেতাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের নজরে দেখে। সেই দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটা বদলেছে। এ ছাড়া, আমার মধ্যপ্রদেশে বেশ কিছু জমি-জায়গা আছে। অবসর নেওয়ার পর থিয়েটারের শিল্পীদের নিয়ে একটা কাজ করার ইচ্ছে রয়েছে। এমন একটা জায়গা, যেখানে তাঁরা থিয়েটার করবেন এবং সম্মানের সঙ্গে নিজেরা থাকবেন। একজন শিল্পীর আত্মসম্মানই তাঁর স্বাভিমান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy