অন্ধ বিশ্বাসের গল্পই বলে ‘দ্য জোয়া ফ্যাক্টর’। ছবি: সংগৃহীত।
ফিল্ম দেখতে দেখতে শিবরাম চক্রবর্তীকে মনে পড়ে গেল। মনে পড়ার সূত্রটি সেই গল্প, ‘দেবতার জন্ম’। গল্পের কথক বলছেন, ‘একবার বাসনা হলো, ত্রিলোকেশ্বর শিবের নিস্তলতার ইতিহাস সবাইকে ডেকে বলে দিই, কিন্তু জীবন-বীমা করা ছিল না এবং ভক্তি কতটা ভয়াবহ হতে পারে জানতাম...’। ভক্তি কত ভয়াবহ গল্পের শেষে কথকের পরিণতিতে পাঠকের সে উপলব্ধি হয়। বাড়ির সামনে এক পাথরে হোঁচট খেতে খেতে অতিষ্ঠ গল্পের কথক পাথরটিকে রাস্তা থেকে উচ্ছেদ করেন। সেই পাথরই কি না সাক্ষাৎ শ্রীবিষ্ণু রূপে ভক্তের সেবা পেতে শুরু করে। প্রচার হয়ে যায়, মাটি ফুঁড়ে উঠেছেন শ্রীবিষ্ণু এবং মাটির নীচে তাঁর তল পাওয়া অসম্ভব। আজও কি সেই পাথর আমরা উপড়ে ফেলতে পারলাম? উপড়ে ফেলা গেল কি অন্ধ বিশ্বাসের নিস্তলতার ইতিহাস?
‘দ্য জোয়া ফ্যাক্টর’ সেই অন্ধ বিশ্বাসের গল্পই বলে। ভাগ্য না কি কর্ম? কার হাত ধরে এগিয়ে যাবে জীবন? সেই দ্বন্দ্বের জট ছাড়াতে থাকে ফিল্মটি।
চারপাশে তাকালেই আজও মালুম হয়, আভূমি চারিয়ে গিয়েছে আমাদের সেই নিস্তলতার শেকড়। অথচ আমাদেরও ছিল অবিশ্বাসের সুদূর অতীত। আমাদেরও ছিলেন চার্বাক। আর ছিল ক্ষমতাধারীর হাতে পরাজয়, চার্বাকের মূল লেখার অন্তর্ধান। আজও, সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে। তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে ছোট ছোট উদ্যোগকেও তাই সাধুবাদ জানাতেই হয়। ‘দ্য জোয়া ফ্যাক্টর’ টিমকেও। যদিও বলিউড আগেও এমন ভাবে উদ্যোগী হয়েছে।
‘দ্য জোয়া ফ্যাক্টর’
অভিনয়ে: সোনম কে আহুজা, দুলকির সলমন, সঞ্জয় কপূর, অঙ্গদ বেদী প্রমুখ।
পরিচালক: অভিষেক শর্মা
ভারতীয় ক্রিকেট টিমের ক্যাপ্টেন নিখিল খোডা (দুলকির সলমন) আপ্রাণ কর্মের জয়গান করে যাচ্ছেন। কিন্তু পুরো ক্রিকেট টিম, এমনকি ক্রিকেট বোর্ডও ভারসা রাখছে ‘লাকি ম্যাসকট’-এ। সেই লাকি ম্যাসকটই জোয়া সোলাঙ্কি (সোনম কপূর)। কিন্তু ক্রিকেট বোর্ডের সদস্যরা এতটাই খেলো যে জোয়ার বাবা (সঞ্জয় কপূর) বলেছিলেন বলে জোয়াকে ম্যাচ জেতার মাধ্যম মেনে নিয়ে একেবারে কোটি টাকার চুক্তি করে ফেললেন? এক জনকেও সে ভাবে প্রতিপক্ষ দেখানো হল না। ভালমন্দের জটিল টক্কর চলতে পারত। কিন্তু সব সময়েই প্রতিপক্ষ দূর্বল। তাই উত্তেজনাও কম। খেলার জগতে নানা রকম অন্ধ বিশ্বাস তো আমরা পৃথিবী জুড়েই দেখে থাকি। এখানেও ক্যাপ্টেন ছাড়া প্রায় সবাই হামলে পড়ে ভাগ্যকেই আঁকড়ে ধরে। মাত্রাতিরিক্ত ভাবেই। জোয়া চরিত্রের দেবী হয়ে ওঠার মনস্তাত্ত্বিক টানাপড়েন অনুপস্থিত। দেবী হয়ে ওঠার সূত্রগুলো মোটা দাগের।
আরও পড়ুন: ‘ট্রোলড হলে রাতে ঘুমোতে পারতাম না’
ক্রিকেট অপছন্দ করতে করতে জোয়ার ক্রিকেটারের প্রেমে পড়াও ‘মোড়’ নেয় না। ছবি: সংগৃহীত।
ফিল্মের নামলিপিতেই দুটি ক্রিকেট বেল এবং লেবু-লঙ্কার সমাহার ক্রিকেট ও অন্ধ বিশ্বাসের সম্পর্ক ইঙ্গিত করে। কিন্তু সেই সম্পর্কের জট খুলতে গিয়ে উপকরণগুলো কেমন ছড়িয়ে যায়। গল্পের গরু গাছে চড়লেও গল্প বলার সিনেমাটিক বাস্তবতা থাকে। সেটা টোল খায় মাঝে মাঝেই। যেমন, ভারতীয় ক্রিকেট টিমের সদস্যদের নিয়ে অ্যাড শুট করার দৃশ্যটি। জুনিয়র কপি রাইটার জোয়া এবং তার টিম শুটের দায়িত্বে। এত বিখ্যাত পাবলিক ফিগার নিয়ে শুট। অথচ শুটিং টিমে লুক দেখার জন্য কেউ নেই? এক খেলোয়াড়ের দাবি অনুযায়ী জুতো যোগান দিতে হচ্ছে জোয়াকেই? তাও আবার নকল জুতো বানাতে হচ্ছে লিফটের মধ্যেই? টিম ক্যাপ্টেন নিখিলের সঙ্গে দেখা হয়ে যাচ্ছে লিফটে। নিখিল-জোয়ার একান্তে প্রথম মুখোমুখি কথা বলানোর সূত্র তাই বড়ই দুর্বল। ক্রিকেট অপছন্দ করতে করতে জোয়ার ক্রিকেটারের প্রেমে পড়াও ‘মোড়’ নেয় না। ট্রান্সফরমেশন নয়, একটা চটজলদি ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
সোনমের অপরূপ সৌন্দর্য বা তিনি নিজে যে ভাবে ফ্যাশন আইকন বলে পরিচিত তার কোনওটার প্রভাব পাওয়া গেল না ফিল্মে। ভারত অধিনায়কের সঙ্গে ডিনারে যাওয়ার জন্য নির্বাচিত পোশাকটিও কেমন যেন খোলতাইহীন। প্রায় সারা ফিল্ম জুড়ে তাঁর কেশদাম এমন স্টিফ হয়ে থাকে মনে হয় মৃদু বাতাসও যেন ভাল করে ওড়াতে পারবে না। এমনকি, বাইকের পিছনে বসে থাকা জোয়ার চুলও তীব্র ভাবে ওড়ে না, একটা শট ছাড়া (যেখানে ওড়না উড়ছে)। অদ্ভুত ঠেকে। এখানেই বলে নেওয়া যায়, ক্রিকেট টিমের সদস্য হ্যারির কাঁধ অব্দি লম্বা চুলের উইগ বড্ড চোখে লাগে।
দুলকির সলমন মোটের উপর ভাল। ক্রিকেট টিম অধিনায়কের ওজন ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন। বাবা মামুট্টির সঙ্গে তাঁর তুলনা না করাই ভাল।
ক্রিকেট ম্যাচের দৃশ্যগুলো ‘লাইভ’ ফিল দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু টেলিভিশনে দেখা লাইভ ম্যাচের ফিল পাওয়া যায়নি সবসময়। তাতে খুব অসুবিধাও হয়নি যদিও। ফিল্ম তো ছাড় নিতেই পারে। জোয়া মাঝে মাঝেই দর্শকের দিকে তাকিয়ে, মানে স্ট্রেট ক্যামেরার লেন্সে তাকিয়ে নিজের কথা শেয়ার করেছে। গল্পের পরিসর থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে যেন দর্শকের সঙ্গেই শুরু করছে কথোপকথন। ফলে, দর্শক নিজেও ফিল্মের চরিত্র হয়ে উঠছেন বলে বোধ হতে পারে। কিন্তু সেই সংলাপ চরিত্রর ভেতরের যন্ত্রণা বেরিয়ে আসার অনুভূতিও দেয় না।
সারা ফিল্ম জুড়েই উঁচু দাগের অভিনয়। চরিত্রগুলোকে এ ভাবেই হয়তো দেখতে চেয়েছেন পরিচালক। বিষয়টা খুব কমন হলেও মূল ধারার ফিল্মেও অভিনয়ের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ণ কাজ দুর্লভ নয়।
সারা ফিল্মে একটা সংলাপই কৌতুক জাগায়, ‘জিতনা ধীরে খেল রাহা হে না উতনা দেরসে আধার কার্ড ভি বান যাতা, ও ভি পুরা ফ্যামিলিকা।’ আবহসঙ্গীত সে ভাবে অন্য রকম কিছু নয়। গড়পড়তাই। কখনও কখনও মনে হয় স্টক মিউজিক ব্যবহার করা হয়েছে। গানগুলো শুনতে ভাল লাগলেও এ রকম গান হামেশাই শোনা যায়। তবে ‘আঁধার কা এক খত্ হু ম্যায় অর খত্ কা পাতা হ্যায় তু...’ (কাশ)। কথা ও সুর বেশ লাগে। মিউজিকের দায়িত্বে শঙ্কর-এহসান-লয়। মনোজ লোবো-র সিনেমাটোগ্রাফিতে কোনও ফাঁকি নেই।
ফিল্মের শুরুতে ও শেষে শাহরুখ খানের নেপথ্য কণ্ঠ। শাহরুখের কথা লিখতেই মনে পড়ল ফিল্মটি রোম্যান্টিক কমেডি। মনে পড়ল, কেননা শাহরুখের রোম্যান্স দৃশ্যে আপ্লুত হয়নি আমার জেনারেশনের এমন দর্শক হয়তো গুটিকয় পাওয়া যেতে পারে। কাজল, মাধুরী, মনীষা, সলমন, আমির প্রমুখ তো আছেনই। কিন্তু এই ফিল্ম কোনও দৃশ্যেই রোম্যান্সের একান্ত মুহূর্তে নিয়ে গেল না, যা দেখে বুকের মধ্যে চিনচিন করে উঠতে পারে। গানের একটা দৃশ্যে জোয়া-নিখিল সুইমিং পুলে পড়ছে স্লো মোশনে। ওয়াটার প্রুফ ক্যামেরায় জলের ভেতর ধরা সেই দৃশ্যের কালার গ্রেড এমনই যে চরিত্র দু’জন কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে যায়। জলজ অনুভূতিও রংমগ্ন হয়ে পড়ে।
সকালের শোয়ে মাত্র সাত জন দর্শক। তিন জন হাফ টাইমের আগেই হল থেকে বেরিয়ে গেলেন। সাত জনের জন্য প্রোজেকশন। বড় ব্যয়বহুল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy