তাপসী পান্নু।
ছবি: থাপ্পড়
অভিনয়ে: তাপসী পান্নু, পাভেল গুলাটি, তনভি আজমি, রত্না পাঠক, দিয়া মির্জা প্রমুখ
পরিচালনা: অনুভব সিংহ
যত্ন, পরিশ্রম, ভালবাসা, আকাঙ্ক্ষায় মোড়া একটা সংসার। তাতে একে অন্যকে ঘিরে ঘিরে, বেঁধে বেঁধে থাকা হাসিখুশি, সুখী এক দম্পতি। আচমকা তাঁরাই ডিভোর্স চেয়ে আদালতে মুখোমুখি। আর সেই বিচ্ছেদের গল্পের কেন্দ্রে একটা থাপ্পড়। শুধুমাত্র একটাই থাপ্পড়।
স্রেফ একটা থাপ্পড়ের জন্য ডিভোর্স? বাড়াবাড়ি নয় কি? পরিচালক অনুভব সিংহের নতুন ছবি ‘থাপ্পড়’ দেখার আগেও যেমন প্রশ্নটা জাগে, তেমনই ফিরে ফিরে আসে ছবি দেখার সময়ে। এ গল্পের নায়িকা অমৃতা (তাপসী পান্নু) যখন স্রেফ একটা থাপ্পড় মারার অপরাধে বিবাহবিচ্ছেদ চান স্বামী বিক্রমের (পাভেল গুলাটি) কাছে, তখন বার বার তাঁর কাছের মানুষের সংলাপে এ প্রশ্ন ওঠে। থাপ্পড়ের জন্য ডিভোর্স? ঘুরপাক খেতে থাকে দর্শকের মাথাতেও।
জীবনের কাছে সুখ এবং সম্মান একসঙ্গে চাওয়া অমৃতার গল্পে এই প্রশ্নটাই রীতিমতো মোটা দাগে দেগে দেওয়াটাই বোধহয় উদ্দেশ্য ছিল পরিচালক অনুভবের। কারণ, ছবির এই থাপ্পড়টা পর্দায় দেখা গৃহবধূর গালে নয়, থাপ্পড়টা আসলে আধুনিকতার পথে হাজার পা বাড়িয়েও সমাজের উঁচু থেকে নিচুতলা, বড়লোক থেকে গরিব, মেয়ের বাবা-মা কিংবা ছেলের বাবা-মা, রক্ষণশীল থেকে উদারমনস্ক— প্রত্যেকটা মনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে গেঁথে থাকা ভাবনাগুলোয়। আদ্যিকাল থেকে চলে আসা যে ভাবনা এখনও লুকিয়ে থাকে মগজের কোণে। সুযোগ মতো বেরিয়েও পড়ে সেই প্রশ্ন, স্রেফ একটা থাপ্পড়ের জন্য ডিভোর্সের বাড়াবাড়ি কেন? থাপ্পড়টা তাই আসলে আমাদেরই চেতনার মূলে। এবং সপাটে।
তাপসী পান্নু সঙ্গে পাভেল গুলাটি ছবির একটি দৃশ্যে
স্বেচ্ছায় গৃহবধূ হয়ে, নামী নৃত্যশিল্পী হওয়ার স্বপ্ন হেলায় ছেড়ে দেওয়া অমৃতার জীবনে স্বামীর ভালবাসা, আর্থিক সচ্ছলতা, শাশুড়ির স্নেহ, বাপেরবাড়ির আদর— কোনও কিছুরই অভাব নেই। যত্ন, পরিশ্রম, কর্তব্যপরায়ণতায় সংসার ভরিয়ে রাখা ‘আম্মু’ আক্ষরিক অর্থেই বিক্রমের জীবনের সবটুকুতে জড়িয়ে। স্বামীর উচ্চাকাঙ্ক্ষা, চাকরিতে বড়সড় উন্নতি নিয়ে বিদেশ পাড়ির লক্ষ্যেও তারই স্বপন বোনা। কিন্তু সবটাই এলোমেলো হয়ে যায় এক সন্ধ্যায়। নিজের সাফল্যের দৌড়ে কর্পোরেট পলিটিক্স আচমকা বাধা হয়ে দাঁড়ালে রাগের মাথায় ভরা পার্টিতে বিক্রম থাপ্পড় মেরে বসে অমৃতার গালে।
আরও পড়ুন: জীবন, রাজনীতি নাকি প্রেম? ‘তখন কুয়াশা ছিল’-র টিজার প্রকাশ্যে
সেই থাপ্পড় অমৃতার জীবনবোধে আঘাত হয়ে নামে। এই প্রথম সে খেয়াল করে, নিজেকে উজাড় করে দেওয়া দাম্পত্যে তার পাওয়ার খাতা শূন্য। এই প্রথম বার তার মনের গহীনে উঠে আসে মাথা উঁচু রেখে বাঁচা, সুখের সঙ্গে সম্মানেরও প্রয়োজনীয়তা বোধ। এই প্রথম সে বোঝে, সমাজের চোখে, এমনকি তার নিজের চোখেও আদ্যোপান্ত ভাল, ভদ্র একটা মানুষ, তার স্বামী বিক্রম আসলে পুরুষ-গর্বেই বাঁচে। বুঝতে শেখে, বিক্রমের কাছে অমৃতা তার প্রয়োজন, অভ্যাস, ভালবাসাও বটে। কিন্তু তারা সমতলে দাঁড়িয়ে নেই, ছিলই না কখনও। অমৃতা তাই নিজেকে নিজের জায়গাটা ফিরিয়ে দিতেই লড়াইয়ে নামে। এবং খেয়াল করে, তার চেয়ে উঁচুতে বিক্রমের থাকাটাই সমাজের চোখে স্বাভাবিক। তার মা (রত্না পাঠক), শাশুড়ি (তনভি আজমি), ভাই, শ্বশুরবাড়ির বাকিরা, বিক্রমের উকিল, এমনকি তার নিজের উকিলের কাছেও। যারা প্রত্যেকে অমৃতারই কাছের মানুষ হয়েও তার সম্মানহানির বিহিত চাওয়ার চেয়ে মানিয়ে নিতে বলারই পক্ষপাতী। নিজের সম্মানের সঙ্গে আপস করতে নারাজ অমৃতার পাশে প্রথম থেকে থাকে শুধু তার বাবা, ভাইয়ের বান্ধবী এবং স্বামীকে হারিয়ে একাই জীবনটা মাথা উঁচু করে বাঁচা সিঙ্গল মাদার (দিয়া মির্জা) প্রতিবেশী। আর মানসিক ভাবে অমৃতার পাশে থাকে আরও এক জন। স্বামীর হাতে নিত্য মারধর খাওয়া পরিচারিকা।
এ গল্প আসলে অমৃতার একার নয়। এ গল্প তার মায়ের, তার শাশুড়ির, ভাইয়ের বান্ধবীর, আইনজীবী নেতার, এমনকি কাজের মেয়ে সুনীতারও। কারণ সমাজে পুরুষ-নারীর ভাগ বাঁটোয়ারায় তাদের প্রত্যেকেরই জীবনে ঘুরপাক খায় নানা রকম না পাওয়া, হরেক রকম আপস। আর অমৃতার হাত ধরেই তারাও চাওয়া-পাওয়ার হিসেব মেলায়, অমৃতা কি সম্মানের সঙ্গে নিজের জীবনে ফেরে?
আরও পড়ুন: ঋতুচক্র নিয়ে সাংসদ মিমির নতুন প্রকল্প ‘সুকন্যা’
এ ছবি তাপসী পান্নুর। প্রত্যাশা মতোই তাঁর বলিষ্ঠ অভিনয়ে অমৃতা জীবন্ত হয়ে ওঠে ভালবাসা থেকে যত্ন, যন্ত্রণা থেকে জেদ— প্রত্যেকটা অনুভূতিতেই। কোথাও কোথাও এক্সপ্রেশন খানিক মাত্রা ছাড়ায়, যা দাগ কাটে না। মাপা অভিনয়ে কখনও মেল শভিনিস্ট, কখনও অসহায় স্বামীর চরিত্রে মিলেমিশে গিয়েছেন পাভেল। তবে এ ছবির সম্পদ তার পার্শ্ব চরিত্ররা। তনভি আজমি, রত্না পাঠক, দিয়া মির্জা, সুশীল দাহিয়া, রাম কপূর, মানব কল, কুমুদ মিশ্র, মায়া সরাওদের উপস্থিতি শুধু যে স্বল্প পরিসরে জাত চিনিয়েছে তা নয়, গল্পের বুনোট থেকে পর্দা পেরিয়ে বাস্তব হয়ে ওঠা— সবটুকুতেই তাঁদের প্রত্যেকের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
ছবির শুরুতে পর্দায় কোলাজ হয়ে আসা এক এক নারীর গল্প এসে মেশে অমৃতার জীবনে, তার পরিবারে। চেনা যায়— তারাই কেউ অমৃতার মা, কেউ শাশুড়ি, কেউ উকিল, কেউ পরিচারিকা, কেউ বা ভাইয়ের বান্ধবী। এক গল্পের পরতে পরতে এমন অজস্র গল্পের বুননে সমাজের চেনা চেহারাটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো নিঃসন্দেহে পরিচালকের মুনশিয়ানা। অমৃতার মানসিক পরিস্থিতির অদলবদল তুলে ধরা গানগুলো ভালই লাগে।
তবে সহজ গল্পের এ ছবির শেষটা বড্ড প্রত্যাশিত, সরলরেখায় চলা, বলা ভাল কিছুটা নীতিপাঠের মতো। ছোটখাটো একটা চমক থাকলে মন্দ লাগত না। পুরুষশাসিত সমাজের চেহারাটা বেআব্রু করতে গিয়ে চেনা ছকের ক্লিশে ঘটনাতেই গল্প এগোয়। মেল শভিনিজমের প্রকাশটাও বড্ড চেনা।
তবে এ ভাবেই বোধহয় রোজকার চেনা গল্পে, আধুনিক, ভদ্র, ভালবাসা মোড়া জীবনযাপনের অন্তরালে থেকে যাওয়া পুরুষশাসিত সমাজটাকে চিনিয়ে দিতে চেয়েছিলেন পরিচালক। কষিয়ে থাপ্পড়টা পড়ল সেখানেই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy