কার্তিক সিংহ (আয়ুষ্মান খুরানা) আর আমন ত্রিপাঠীর (জিতেন্দ্র কুমার) সমকামী প্রেমের কাহিনি নিয়েই তৈরি ‘শুভ মঙ্গল জ্যাদা সাবধান’ ছবিটি।
ছবি: শুভ মঙ্গল জ্যাদা সাবধান
অভিনয়ে: আয়ুষ্মান খুরানা, জীতেন্দ্র কুমার, গজরাজ রাও, নীনা গুপ্ত প্রমুখ
পরিচালনা: হিতেশ কেওয়ালিয়া
যা সিমরন, জি লে অপনি জিন্দগি! ফের বলল বলিউড।
তবে সিমরনেরা এখন ‘ইউনিসেক্স’। জ্যাকের সঙ্গে জল তুলতে জিলের জায়গায় জনি গেলে কী বা ক্ষতি হয়? প্রশ্ন তুলে দিয়েছে ওরা।
তাতে কী হল? এ সব নতুন না কি? বলিউড কি এর আগে সমকামী যুগল দেখেনি? জানে না যে সমপ্রেম একটা আলোচনার বিষয়? এত পিছিয়ে আছে হিন্দি সিনেমা যে, এত দিনে আয়ুষ্মান খুরানাকে দিয়ে হইচই করিয়ে সে সব কথা বলতে হল? এমন কটাক্ষ করাই যায়। তবে করে লাভ নেই। কিছু কথা যুগে যুগে নানা রূপে কখনও দিলীপকুমার-অমিতাভ বচ্চন, কখনও বা আমির খান, শাহরুখ খান— কত জনকে বলতে হয়েছে। ‘পেয়ার কিয়া তো ডরনা কেয়া’ বলতে বলতে মুখে রক্ত উঠে আসার জোগাড় হয়েছিল তো গত বহু দশকের ফিল্ম নির্মাতাদের। সে সব ভুলে গেল না কি দেশটা? বলিউডের নাম খারাপ থেকে খারাপতর, হয়নি কি? মধ্যবিত্ত বাঙালি বাবা-মা ক’জন স্কুলপড়ুয়া সন্তানকে খোলা মনে হিন্দি সিনেমা দেখতে দিতেন বলুন? সেই বাবা-মায়েরা লুকিয়ে দেখেননি কি ‘লগ যা গলে...’ টাইপের প্রেমের ছবি? বুকে হাত রেখে বলতে হবে কিন্তু সত্যিটা। পরের পর বানিয়ে যেতেই হয়েছে। কখনও সলিম-আনারকলি, কখনও স্বপ্না-ভাসু, রাজ-সিমরন। ভাবুন দেখি কী কাণ্ড!
তবে না গিয়ে প্রেমের সিনেমা ক্লিশে হয়েছে। মানুষ বিরক্ত হয়েছে। বলিউডের কপালে ভাঁজ পড়েছে। হিরো-হিরোইনের গল্পে টুইস্ট এসেছে। তবে থামেনি মুম্বই। বরাবর প্রেমের কথা বিকোয় যে বেশি, তা ভুলে যায়নি। ফলে প্রেমের ব্যাখ্যা বদলেছিল কিছু কাল আগেই। নতুন ভঙ্গি এসেছিল বাজারে। যৌনতা নিয়ে সোজাসাপ্টা কথা বলা শুরু হয়েছিল। এ বার সেই প্রেম আরও রঙিন হয়েছে। রামধনু রং লেগেছে বলিউডের ‘ভাব-ভালবাসার’ ছবিতে। প্রেমের সহজপাঠ সহজে দেওয়ার কাজ করে ফেলল আবার। ‘গে’ জন্ম যে ‘হ্যাপি’ হতে পারে, এবং কমিক নয়, বছর বছর করে আসা সেই পাপ থেকেও নিজেকে খানিক মুক্ত করতে পারল ভারতীয় সিনেমা। সঙ্গে বার বার ‘ট্রিবিউট’ দিল কখনও অমিতাভ ঘরানার ‘অ্যাংগ্রি ইয়ংম্যান’ নায়ককে, কখনও শাহরুখের মতো আহ্লাদের সঙ্গে প্রেমের জয়গান গাওয়া নয়ের দশকের বলিউড-আইকনদের। কেন করল? কারণ দশর্কেরা এখনও প্রেম প্রকাশের সে সব ভাষার সঙ্গে পরিচিত।
আরও পড়ুন: কন্যাসন্তানের মা হলেন শিল্পা শেট্টি
ছবির একটি দৃশ্যে আয়ুষ্মান খুরানা ও জীতেন্দ্র কুমার
কার্তিক সিংহ (আয়ুষ্মান খুরানা) আর আমন ত্রিপাঠীর (জিতেন্দ্র কুমার) কাহিনি যে সে সব প্রেমের লড়াইয়ের মতোই আরও একটা গল্প, তা দেখাল। বোঝাল যাঁরা নিজেদের প্রেমিকাকে পেতে অনেক লড়েছেন, সে সব ভারতীয় পুরুষের থেকে এই ভালবাসার অনুভূতি কিছু আলাদা নয়। সেখানেই আলাদা হয়ে গেল ‘শুভ মঙ্গল জ্যাদা সাবধান’। কেন্দ্র চরিত্রে আয়ুষ্মানের সঙ্গে জিতেন্দ্রও সমান তালে অভিনয় করলেন। সমস্ত প্রেমের লড়াইকে একটা ট্র্যাডিশনের অঙ্গ হিসেবে দেখানো হল। এটা অবশ্যই বড় কাজ। সমকামী আর উভকামী অনুভূতি, লড়াই— সবটা এক ছাতার তলায় অবশেষে পড়ল। লড়াইটা আর শুধু ‘এলজিবিটিকিউআইএ’-তে আটকে রইল না। এটা মূলধারার ছবি ছাড়া অন্য কারও পক্ষে এমন ভাবে বলা সম্ভব হত কি? মনে তো হয় না।
আরও পড়ুন: মুভি রিভিউ ‘ভূত পার্ট ওয়ান: দ্য হন্টেড শিপ’: ছুটন্ত ভুতের রহস্যভেদ কমেডি হয়েই থেকে গেল
কার্তিক চরিত্রের আয়ুষ্মানের নাকে একটি রিং থাকলেও সে ‘সুপারম্যান’ মার্কা পোশাক পরে দিব্য কাজ করে খায়। আর পাঁচটা পুরুষমানুষের মতো দেখায় তাকে। লোকের সামনে নিজের যৌনতা নিয়ে কথা না বললে আলাদা করে সেই কার্তিককে বোঝা যায় না যে সে মহিলা নয়, পুরুষসঙ্গী পছন্দ করে। ভাবা যায়! এ এক মহান পরিবর্তন মূল ধারার ছবিতে। সমকামী চরিত্রের স্টিরিওটাইপিংয়ের গল্প থেকে এ কাহিনি অনেক ধাপ এগিয়ে। পরিচালক হিতেশ কেওয়ালিয়া-কে এর জন্য কুর্নিশ। সংলাপ তৈরি থেকে চরিত্র গঠন— সবেতেই যথেষ্ট যত্নের ছাপ দেখা গিয়েছে। সমকামী সম্পর্কে যে এক জন নারীসুলভ আচরণ না করলেও একটি অতি কোমল ভালবাসা থাকতে পারে, তা দেখা গিয়েছে। এবং গোটাটা প্যানপ্যানে কিংবা অতি-গম্ভীর ‘আর্ট ফিল্ম’ তকমার কোনওটাই যাতে না পায়, তার জন্য টিম ‘শুভ মঙ্গল জ্যাদা সাবধান’ সত্যিই বেশ সাবধান হয়েছে বলেই ভেসে উঠেছে তার নির্মাণে।
তবে চাইলে আরও এগোতেও পারে বলিউড। এ বার বুঝি একটু চেষ্টা করা যেতে পারে এক জনকে গ্রহণযোগ্য প্রমাণ করার জন্য অন্য দলকে হাস্যকর দেখানোর ফর্মুলার বাইরে বেরোতে। এত দিন সমকামী চরিত্র থাকত কমিক রোলে। তা ভাঙতে কেন মজা করতে হবে তথাকথিত মূলস্রোতের সমাজকে নিয়ে? ছক যখন ভাঙবেই, আরও ভাল ভাবে ভাঙাই যায় বোধ হয়। যদিও ছোট শহরের শিক্ষিত বাবার চরিত্র গজরাজ রাও আর তার পাশে জিতেন্দ্রর মায়ের চরিত্রে নীনা গুপ্তর অভিনয় উপভোগ করার মতো, তবে চরিত্রগুলো আরও মার্জিত হতেই পারত। গজরাজ রাওকে এত কাল পরে ডিডিএলজে-র সময়ে অমরীশ পুরী হতে হবে কেন? ‘শুভ মঙ্গল’ সিরিজে সমাজকে বার বার যে ভাবে দেখানো হচ্ছে, সে কাজে যদিও চেষ্টার ছাপ অনেকটাই রয়েছে। ভারতীয় পৌরুষের প্রচলিত ধারণা চ্যালেঞ্জ করা এক দিনের কাজ তো সত্যিই নয়। যথেষ্ট দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়েছেন অধিকাংশ অভিনেতা।
এ সবই আরও মসৃণ দেখাত যদি গল্প বলার সময়টা নিয়ে একটু ভাবা হত। এ কাহিনি বলতে কয়েক মিনিট কম নিলে ক্ষতি ছিল না। বরং টানটান দেখাত ভাবনাটা। তবে আয়ুষ্মানের ছবির স্বভাব থেকে অনেকটা বেরোতে পেরেছে শুভ মঙ্গল দ্বিতীয়। ছবির শেষের ধামাকাদার নাচ থাকলেও ড্রিম গার্লের একটানা লম্বা জ্ঞানদানটি বাদ পড়িয়াছে। তার বদলে, হল ছাড়ার আগে, এক ঝলক ‘বাপ্পিদা কা শান’ অবশ্যই নির্দেশকের বুদ্ধির পরিচয় দিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy