রানি মুখোপাধ্যায়।
ছবির নাম: ‘মর্দানি-২’
পরিচালক: গোপী পুত্রণ
অভিনয়ে: রানি মুখোপাধ্যায়, বিশাল জেঠওয়া
যে কোনও ছবির ক্ষেত্রে তার মুক্তির সময়টা বেশ খানিকটা ফারাক গড়ে দিতে পারে। সে ছবি কতখানি আগ্রহ তৈরি করবে, কতটা চর্চিত হবে, কতটাই বা রেশ থেকে যাবে দর্শকের মনে, তার বেশ কিছুটা অলক্ষে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলে সে সময়টায় চারপাশে ঘটতে থাকা ঘটনাপ্রবাহ, সামাজিক পরিস্থিতির দোলাচল। রানি মুখোপাধ্যায়ের দাপুটে অভিনয়ে মোড়া ‘মর্দানি-২’এর মুক্তির দিনক্ষণ স্থির করার সময়ে প্রযোজক-পরিচালকেরা ভারত জুড়ে ক্রমাগত ঘটতে থাকা ধর্ষণের ঘটনা এবং তাকে ঘিরে ক্রমশ জমাট বাঁধতে থাকা রাগ, ক্ষোভ, হতাশাকে উস্কে দিতে চাইছিলেন নিঃসন্দেহে, তবে সেই সময় নির্বাচন কাকতালীয় ভাবে বাস্তবের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে, এতটা হয়তো বা ভাবেননি।
এক দিকে ধর্ষণ, নারীদেহ ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলা বিকৃত কাম এবং প্রমাণ লোপাটে বীভৎস ভাবে খুনের একের পর এক গা শিউরে ওঠা ভারতবর্ষ নির্ভয়া-কাণ্ডে দোষীদের ফাঁসির অপেক্ষায়। অন্য দিকে হায়দরাবাদের তরুণী পশু চিকিৎসককে ধর্ষণ ও পুড়িয়ে মারার ভয়াবহ ঘটনায় অভিযুক্তদের ‘এনকাউন্টারে’ মৃত্যুর ঘটনায় তুমুল তর্ক-বিতর্কের রেশ ফুরোয়নি এখনও। এমন আগুনে সময়ে এক বিকৃতমনস্ক ধর্ষক ও সিরিয়াল কিলারকে ধরতে ব্যতিব্যস্ত পুলিশের মরণপণ লড়াইয়ের গল্প বলা ‘মর্দানি-২’ যে বেশ অনেকখানি আগ্রহ বা চর্চার জায়গা তৈরি করে দেবে তা বলাই বাহুল্য। ২০১৪-য় দেশের নামীদামি শহর থেকে মেয়ে পাচারের ভয়াবহতা ও তাকেরুখতে এক তেজস্বিনী পুলিশ অফিসারের লড়াইয়ের কাহিনি নিয়ে যশরাজ ফিল্মসের ‘মর্দানি’ বক্স অফিস সাফল্যের পাশাপাশি নাড়িয়ে দিয়েছিল দর্শকদের। ২০১৫-র ঘটনাপ্রবাহের প্রেক্ষাপটে গল্প বুনে মর্দানি-২ তারই সিকুয়েল হিসেবেও হলে টেনে এনেছে দর্শকদের।
মর্দানি-র সেই বীরাঙ্গনা পুলিশ অফিসার শিবানী শিবাজী রায় (রানি মুখোপাধ্যায়) এ ছবিতে রাজস্থানের কোটা শহরের এসপি-র পদে কর্মরত। দশেরার রাত পেরিয়ে সকাল হতেই ‘স্টুডেন্ট ক্যাপিটাল’ কোটা শিউরে ওঠে স্কুলছাত্রী লতিকার ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার নৃশংশতায়। যার নেপথ্যে থাকা নাবালক অপরাধীকে ধরার দায়িত্বপ্রাপ্ত শিবানীর সঙ্গে রীতিমতো দাবা খেলায় নামে সেই ছেলে, সানি(বিশাল জেঠওয়া)। নিজের বাবাকে মায়ের খুনে সাহায্য করা এক নির্মম ছেলেবেলা যাকে পরিণত করেছে সমগ্র নারীজাতির প্রতি তুমুল বিদ্বেষী, বিকৃতমনস্ক, ঠান্ডা মাথার এক খুনিতে। পুলিশের সঙ্গে চোরপুলিশ খেলায় নেমে যে প্রতি মুহূর্তে চ্যালেঞ্জ ছোড়ে স্বয়ং এসপি-কেই। পুলিশ-প্রশাসনের নাকের ডগায় বসেই ঘটিয়ে যেতে থাকে একের পর এক পরিকল্পিত খুন, কখনও প্রমাণ লোপাটে, কখনও সুপারি নিয়ে, কখনও বা নিজের পালিয়ে যাওয়ায় সাহায্য চাওয়ার বিনিময়ে। এমনকি রীতিমতো ছক কষা, প্রয়োজন মতো ছদ্মবেশ নেওয়া সে সব অপরাধের পরে শিবানীকে জানান দিয়েও যায় অকুতোভয় সেই কিশোর। ক্ষুরধার বুদ্ধির তেজস্বিনী শিবানীকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে যায়, ধরা পড়ার ভয়ও তাকে দমাতে পারে না, বরং তার এমন ভয়ঙ্কর অপরাধ মনস্কতার নেপথ্যে রয়েছে দুর্দম মেল-ইগো। বলিউডি থ্রিলারের রীতি মেনে শেষমেশ সে ধরাও পড়ে ঠিকই নিজে হাতে সেই অপরাধের শাস্তি জোটে সেই ‘এসপি সাহেবা’র হাতেই। যে কাঁটাওয়ালা বেল্টে সে ছিঁড়েখুঁড়ে দিত তার শিকারদের, তারই অবিশ্রান্ত আঘাতে।
ছবির একটি দৃশ্য
ছবি জুড়েএকের পর এক রোমহর্ষক খুনের ঘটনা টানটান উত্তেজনায় বসিয়ে রাখে। আর তারই মধ্যে অসম্ভব দক্ষতায় কাহিনিকার-পরিচালক গোপী পুত্রণ বুনে দিয়েছেন এই একুশ শতকেও নারীদের হেলাফেলার চোখে দেখা পুরুষশাসিত সমাজের গল্প— কখনও তার চরিত্র হয়ে ওঠে পুলিশবাহিনীতেই থাকা সিনিয়ার অফিসার শেখাওয়াত, কখনও টিভি অ্যাঙ্কর অমিত শর্মা, কখনও রাজনীতির কারবারি বেনিওয়াল, কখনও খোদ শিবানীরই বস। গল্পের পরতে পরতে মিশে গিয়েছে সমাজের দুর্নীতির গল্প, আইনের ফাঁকফোকর গলে তার বড় হয়ে ওঠাও। তবে সব পেরিয়ে গান-হীন এই ছবিতে দাগ কেটে যায় ঠান্ডা মাথার অপরাধের হাড় হিম করা ডিটেলিং, স্তরে স্তরে ভাঁজ খোলা জটিল মনস্তত্ত্বে গল্পের অবাধ আনাগোনা।
আরও পড়ুন-আল্পসে ঘেরা জেনেভায় প্রেমে মজেছেন সৃজিত-মিথিলা, প্রকাশ্যে এল হানিমুনের একগুচ্ছ নতুন ছবি
মর্দানি-র ধারাবাহিকতা মেনে এ ছবিরও শুরু থেকে শেষ দাপটে অভিনয়ে দর্শককে টানটান বসিয়ে রাখার কথা ছিল রানি মুখোপাধ্যায়ের। রেখেছেনও। তীক্ষ্ণবুদ্ধি, অসম্ভব স্মার্ট, পুরুষদের সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দেওয়া শুধু নয়, চোখে চোখ রেখে পুরুষশাসিত সমাজের প্রতিনিধিদের মোকাবিলাও করেছেন অবলীলায়। কিছু কিছু দৃশ্যে তাঁর চোখা চোখা নারীবাদী সংলাপ খানিক বাড়তি মনে হয়েছে বটে, তবে গল্পের গুণে তা কেটেও গিয়েছে ঠিক।প্রথম থেকে অপরাধীকে চিনিয়ে দিয়ে তাকে ধরার টানাপড়েন নিয়ে থ্রিলারের প্লট বোনা, সমাজের নিম্নরুচির দিকগুলোকে তুলে ধরার ভাবনায়, ধর্ষণ করে খুনের ভয়াবহতার সবটুকুর দৃশ্যায়ন না করে স্রেফ আলগোছে বুঝিয়ে দেওয়ার মুন্সিয়ানাতেও এ ছবি বেশ নম্বর দাবি করতেই পারে।
তবে এ ছবির সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে খল চরিত্র ‘সানি’র ভূমিকায় টেলিপর্দার জনপ্রিয় অভিনেতা বিশাল। বড়পর্দার প্রথম অভিনয়ে কখনও কখনও রানিকেও ছাপিয়ে গিয়েছেন তাঁর দৃষ্টির নিষ্ঠুর শীতলতায়, ঠান্ডা মাথার অপরাধীর জিঘাংসা ফোটানোর মুহূর্তগুলোয়, সমান সাবলীলতায় এক চরিত্রের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ছদ্মবেশে অনেকগুলো চরিত্রকে আলাদা আলাদা করে চিনিয়ে দেওয়ায়।
আরও পড়ুন-মারা গেলেন মৌসুমি চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে পায়েল, শোকবার্তা বলিউডের
তবে এ ছবির সবটাই নিখুঁত, এমনও বলা গেল না অবশ্য। ছবির প্রথমার্ধ্বে থ্রিলারের টানটান বুনোট দ্বিতীয়ার্ধ্বে এসে খানিক খেই হারিয়েছে, প্রেডিক্টেবল হয়ে গিয়েছে বরং। গাড়িতে উঠে রানিকেই খুন করতে চাওয়া সানির ধরা পড়া যে স্রেফ সময়ের অপেক্ষা, তা দিব্যি বোঝা গিয়েছে গল্পের ভাঁজে। এমনকিপাবলিক সেন্টিমেন্টের সবটুকু শুষে নিতে রানির হাতে বেল্টের মার খেয়েই যে তাঁর পুলিশের হাতে ধরা পড়া, আন্দাজ করা গিয়েছে তা-ও। কিশোর অপরাধীর এমন নিপুণ পরিকল্পনা্য একের পর এক অপরাধ ঘটিয়ে ফেলা, এমনকি এসপিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে থানাতেই চায়ের দোকানের কর্মী সেজে ভয়ডরহীন অবাধ গতিবিধি বিশ্বাসযোগ্যতায় নাড়াও দিয়েছে মাঝেমধ্যেই। স্রেফ সিকুয়েল বোঝাতে রানির স্বামী হিসেবে একটিমাত্র সিনে যীশু সেনগুপ্তের পর্দায় আসাও অর্থহীনই বলা চলে।
তবু স্রেফ গল্পের গুণেই এ ছবি পাশ। এবং অবশ্যই প্রধান চরিত্রদের অসাধারণ অভিনয়ে। দশে অন্তত সাত বোধহয় দেওয়াই যায়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy