অর্জুন ও মধুমিতা।
ছবি: লাভ আজ কাল পরশু
অভিনয়ে: পাওলি দাম, অর্জুন চক্রবর্তী, মধুমিতা সরকার, অনিন্দিতাবসু, অনির্বাণ চক্রবর্তী প্রমুখ।
পরিচালনা: প্রতীম ডি গুপ্ত
প্রতীম ডি গুপ্তর নতুন ছবি ‘লাভ আজ কাল পরশু’-র ট্রেলার দাবি রেখেছিল এক নতুন প্রেমের গল্পের, বা বলা ভাল নতুন প্রজন্মের প্রেমের গল্পের। তবে ট্রেলারের সব চেয়ে অভিনব বিষয় ছিল, অর্জুন-মধুমিতা, এই ফ্রেশ জুটির পৃথক পৃথক পরিচয়। কখনও অভিরূপ-তৃপ্তি, কখনও অভিষেক-তাপসী, আবার কখনও অন্য নাম। সেই প্রশ্ন চিত্রনাট্য খোলসা করলেও, ছবির শেষে রয়ে গিয়েছে প্রচুর প্রশ্ন, যেগুলো কোনও ভাবেই দৃষ্টি এড়াতে পারেনি।
লাভ আজ কাল পরশু, অর্থাৎ আজ, কাল ও পরশু এই তিনদিনের সময়সীমায় এ ছবির যাবতীয় ঘটনা ঘটে। দু’টি অজানা মানুষের প্রথম দেখার গল্প নিয়ে তৈরি ‘প্রথম দেখা’ শীর্ষক একটি টেলিভিশন শোয়ের মালিক কালকি মৈত্র (পাওলি দাম), শোয়ে যিনি ‘প্যারাডাইস হোটেল’-এর মালকিন। এই শোয়ের মূল চরিত্র অর্থাৎ নায়ক-নায়িকার চরিত্রাভিনয়ের জন্য রয়েছেন দুই পৃথক ব্যক্তি, প্রতি দিন যাঁরা ঘুম থেকে উঠছেন নতুন এক পরিচয় নিয়ে, সম্পূর্ণ নতুন এক মানুষ হয়ে। ফলস্বরূপ, প্রতি দিন এই হোটেলের কফি শপে কখনও আলাপ হচ্ছে ক্রিকেটার তৃপ্তি ও বিখ্যাত গায়ক অভিরূপের, আবার কখনও বিজনেস রিপোর্টার অভিষেক ও মডেল তাপসীর।
প্রতিনিয়ত এই পরিচয় বদলের মূলে রয়েছেন মিস্টার বটুক, যিনি এক অভিনব বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায়, একটি অত্যন্ত আধুনিক ও জটিল যন্ত্রের সাহায্যে এই দুই ব্যক্তির (অর্জুন চক্রবর্তী ও মধুমিতা সরকার) মগজে প্রতি রাতে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন অসংখ্য নতুন তথ্য, তৈরি করছেন নতুন স্মৃতি, যার ফলে পরের দিন সে উঠে বসছে এক স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যক্তি হয়ে, যার সঙ্গে আগের দিনের ব্যক্তির কোনও মিল নেই। অর্থাৎ অভিষেককে চেনেন না অভিরূপ, আবার তাপসীকে চেনেন না তৃপ্তি। এভাবে প্রতিদিন একই মানুষ প্রেমে পড়ছেন নতুন নতুন চরিত্রের, এবং অভিষেক-তাপসী বা অভিরূপ-তৃপ্তির অগোচরেই গোপনে রাখা ক্যামেরায় ধরা হচ্ছে তাঁদের অন্তরঙ্গ মুহূর্ত, তাঁদের কফিশপের প্রথম আলাপের কথোপকথন। কিন্তু এই মিথ্যা সাজসজ্জার ধারা কি দিনের পর দিন চলে অবিচ্ছেদ্য ভাবে? এই দুই ব্যক্তির আসল পরিচয়ই বা কী? তাঁদের প্রকৃত আলাপ কী ভাবে? সেই নিয়েই ‘লাভ আজ কাল পরশু’-র গল্প এগিয়েছে।
আরও পড়ুন: মুভি রিভিউ ‘লাভ আজ কাল’: দুই প্রজন্মের তুল্যমূল্য বিচারেই আটকে রইল ভালবাসা
ছবির দৃশ্যে অর্জুন-মধুমিতা।
সিনেমার নাম থেকেই খুব স্পষ্ট যে এ ছবি এক ঝকঝকে প্রেমের গল্প তুলে ধরতে চেয়েছে, বয়-মিটস-গার্লের চিরাচরিত ছক ভেঙে, নব প্রজন্ম কী ভাবে প্রেমকে দেখে, তারা কী ভাবে প্রেমে পড়ে, প্রেমের সংজ্ঞাটাই বা তাদের কাছে কী, প্রতীম তা-ই দেখাতে চেয়েছেন। এ কাজে তিনি আংশিক সফল, কারণ দর্শককে তিনি এক নতুন গল্প উপহার দিতে পেরেছেন। কিন্তু, সেই গল্পের চমকটা কেবল প্লটেই সীমাবদ্ধ থেকে গেল, গল্পের ধারায় সেই চমক প্রায় দেখাই গেল না। চিত্রনাট্য খুবই দুর্বল, যার ফলে ঝাঁ চকচকে দৃশ্যায়ন, রুপোলি পর্দায় নতুন জুটির আগমন, এমনকি প্রেমের গল্পে অন্য জনরের মিশ্রণ— কোনওটিই শেষরক্ষা করতে পারল না। বরং এক ঘণ্টা পয়তাঁল্লিশ মিনিটের ছবির শেষে বেশ কিছু প্রাথমিক জায়গায় থেকে গেল অনেকটা ধোঁয়াশা। যেমন, যে ছবিতে এত উন্নতমানের বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির এত সহজ ও সুলভ ব্যবহার দেখানো হয়, সেই ছবিতেই বাকি সকল চরিত্রের দৈনন্দিন জীবনযাপনে প্রযুক্তিগত প্রগতির ন্যূনতম ছাপটুকুও দেখতে পাওয়া যায় না। এমন উন্নত ও জটিল যন্ত্রের ব্যবহারের সমান্তরালে অন্যান্য চরিত্রের এত সাধারণ জীবনযাত্রা, যা বর্তমান আধুনিক জীবনই কেবল প্রতিফলিত করে— বেশ দৃষ্টিকটূই ঠেকে। আবার, খুব অদ্ভুত ভাবে, এই পরিচয় বদলের পিছনের রহস্য দর্শকের কাছে উদ্ঘাটিত হলেও, ‘প্রথম দেখা’ শোয়ের নায়ক-নায়িকা একবারের জন্যও প্রশ্ন করেন না এর কারণ।
আরও পড়ুন: আজকে ভ্যালেনটাইন ডে তো? দেখি কেউ প্রপোজ করে কি না
এই ছবি শেষ পর্যন্ত সব কিছুর ঊর্ধ্বে প্রেমের জয়— এই বার্তা দিলেও, প্রতীম তাঁর চিত্রনাট্যকে কেবল প্রেমের গল্পে বাঁধতে চাননি। সেই কারণে কখনও প্রেম, কখনও আধুনিক প্রেমের নানাবিধ আঙ্গিক, কখনও কল্পবিজ্ঞান, কখনও রহস্য-রোমাঞ্চ— এই সমস্ত উপাদানই তিনি রেখেছেন। কিন্তু চিত্রনাট্যে এত ফাঁক রয়ে গিয়েছে যে যথাযথ সংমিশ্রণের অভাবে তা শেষ পর্যন্ত সুস্বাদু পাঁচমিশালি হল না, বরং সব ক’টিই খুব বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত হয়ে রইল।
পাওলি দাম তাঁর চরিত্রে যথেষ্ট ব্যক্তিত্বময়ী, ছবিতে তাঁর প্রথম স্ক্রিন অ্যাপিয়ারেন্সেই তিনি ব্যক্তিত্বের ছাপ রেখেছেন। তবে চিত্রনাট্যের দুর্বলতায় তিনি খুব বেশি শেড নিয়ে অভিনয় করার জায়গা পাননি। অর্জুন এবং মধুমিতা, টেলিভিশনে দু’জনেই চেনা মুখ। এই প্রথম তাঁরা একসঙ্গে জুটি বাঁধলেন বড় পর্দায়। নতুন জুটি হিসাবে তাঁদের দেখতে বেশ ভাল লাগে। তবে কখনও কখনও তাঁদের রসায়ন আরোপিত ঠেকে, আর একটু স্বাভাবিকতা থাকলে ভাল হত। তবে তাঁদের দু’জনকেই অভিনয় করতে হয়েছে বেশ কয়েকটি চরিত্রে তাই সেই দিক থেকে তা খুবই চ্যালেঞ্জিং ছিল, এবং দু’জনে যথাসাধ্য করেছেন। বিশেষত বড় পর্দায় প্রথম অভিনয় হিসাবে মধুমিতা কৃতিত্বের সঙ্গে বিনা জড়তায় নিজের চরিত্র(গুলি) ফুটিয়েছেন। তবে ছোট চরিত্রের মধ্যে যথেষ্ট প্রশংসার দাবি রাখেন অনিন্দিতা বসু।
নিরাশ করেছেন এ ছবির সঙ্গীত পরিচালক অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়। অরিজিৎ সিংহের গলায় গানগুলি গল্পের ধারার সঙ্গে বেশ মাননসই এবং আধুনিকতার ছাপ বজায় রেখেছে ঠিকই।তবে সব কিছুকেই আধুনিক করতে গিয়ে ‘তোমায় নতুন করে পাব বলে’ গানটিরও আধুনিকীকরণে গানটির অর্থ, বোধ ও ওজন ক্ষুণ্ণ হয়েছে। এক্সপেরিমেন্টেশনেই যখন গেলেন তখন যন্ত্রানুসঙ্গ আরও সূক্ষ্ম ভাবে বিচার করে স্থির করতে পারতেন। সংলাপ ও আবহসঙ্গীত, দু’টি ক্ষেত্রেই বলিউডের নতুন মূলধারার ছবির একটি ছাপ সুস্পষ্ট। প্রতীমের থেকে আরও টানটান ও বুদ্ধিমত্ত চিত্রনাট্যের আশা ছিল। তাকিয়ে থাকব তাঁর পরবর্তী ছবির জন্য, আরও শক্তপোক্ত কোনও ইনিংসের আশায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy