মেঘনা গুলজারের ‘ছপাক’, গুলজারের মন নিংড়ে নেওয়া সংলাপ আর দীপিকা...
ঘন করে কাজল পরেছি আজ। গায়ে শীতের কোট আর ছোট্ট দুল।
নাহ, আমার কান আছে। অ্যাসিডে গলে পড়ে যায়নি। নাক আর চোখটা অবশ্য ছিল না...গলে গিয়েছিল।
পাঁচ-ছ’টা সার্জারি। হাসপাতালে বিনা চিকিৎসায় পড়ে থাকা। বার্ন ইউনিটে দিনের পর দিন খেতে না পাওয়া আমি পড়েই থাকতাম। মায়ের পাউরুটি আর কলার অপেক্ষায়। ওটাই শুধু খেতে পেতাম। ইনফেকশনের ভয়ে কেউ খেতে অবধি দিত না আমায় হাসপাতালে! দশ-বারোটা প্রায় মৃত মানুষের সঙ্গে বাস করেছি তখন পোড়া শরীর আর জ্বালা নিয়ে...
এ সব কী লিখছি? আমার তো আনন্দবাজার ডিজিটালের জন্য ‘ছপাক’ ছবির সমালোচনা লেখার কথা!
তা হলে? সব দলা পাকিয়ে যাচ্ছে...
হলে ঢোকার মুখে দু’জন তরুণী পপকর্নের ঢাউস বক্স নিয়ে আমাকে কেমন ঘেন্নার চোখে দেখল দেখলাম। এ তো প্রায়ই হয়। মেট্রোয় উঠলেই বাচ্চা থাকলে মা তার বাচ্চাকে আমার স্পর্শ থেকে সরিয়ে নেয়। যেন আমি, আমরা অচ্ছুৎ!
যাই হোক, ছবি শুরু হল।
পাঁচ বছর আগের ঘটনা। আবার আমার সামনে! কষ্ট হচ্ছে বড্ড! খুউউব! নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে।
মেঘনা গুলজারের ‘ছপাক’। গুলজারের মন নিংড়ে নেওয়া সংলাপ। আর দীপিকা পাড়ুকোন। যাঁর লেহঙ্গা দেখে হয়তো ভেবেছিলাম নিজের বিয়ের লেহঙ্গা ঠিক ওরকম পরব...
‘মালতীকে ওর মা এবং নার্সরা মাথায় জল দিয়ে স্নান করাচ্ছে... খুব কষ্ট হচ্ছিল নিজের মায়ের জন্য তখন’
নাহ্। দীপিকাকে আর ওই গ্ল্যামার কুইন ভাবতেই পারছি না। মালতী, বা মনে হচ্ছে লক্ষ্মী আগরওয়ালের কথা। যেমন বাইরের মেকআপ, তেমনই সহজ অভিনয়।ওঁকে দেখে মনে পড়ছে আমার বন্ধু মনীষা...পারমিতা...আমি...
যাঁদের সারাক্ষণ শুনতে হয়েছে ‘ইশ! পোড়া মুখ! ছিঃ’!
এই তো, হলেই যখন ‘ছপাক’দেখছি, যখন দীপিকার শরীর মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে অ্যাসিডের গ্রাসে তখন পাশ থেকে শুনছি,‘ইশ্শ্! উফ্ফ! পুরো মুখটায়...’
হ্যাঁ, সমস্ত অ্যাসিড সারভাইভার এটাই শোনে। রোজ! আর শুনবেও! শরীরে অ্যাসিড ছুড়লে ঢাকা থাকত। কিন্তু মুখ পুড়ল! তাই পোড়ারমুখী। মুখপুড়ী। ভূত। পেত্নী...।
আমি শুনেছিলাম, আমি নিজেই নাকি এক ছেলে, যে আমায় বিয়ে করবে না বলেছিল তার ওপর রেগে নিজের মুখে অ্যাসিড ছুড়ে ছেলেটার ওপর দোষ দিয়েছিলাম!
‘ছপাক’-এর ওই দৃশ্য দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল চিৎকার করে বলি, মুখই তো পুড়েছে। মন তো নয়। তাহলে মুখ ঢাকব কেন? কেন শুনে যেতেই হবে মুখ নিয়ে?
বড্ড ব্যক্তিগত হয়ে যাচ্ছে আমার লেখা। ছবিটা ভেতর থেকে সেই পাঁচ বছরের পুরনো দৃশ্যগুলো টেনে টেনে বের করে আনছে। মালতী একজন পুরুষকে বিয়ে করবে না বলেছে। সে গায়িকা হবে। সে আলাদা কিছু। বড় কিছু করতে চাইছে। আমি এমন অগুণতি মালতীকে চিনি যারা পুরুষদের সমকক্ষ হতে চাইছে। বা তাদের চেয়েও বড় কিছু! তারা জোর গলায় ‘না’বলছে। ব্যস, তখনই তাদের মুখ পোড়াও! ক্ষমতাহীন করো...
মেঘনা গুলজার আর দীপিকা আমাদের জীবনকে সামনে আনলেন। পোড়া জীবনের গল্প বলেছেন তাঁরা সুঠাম চিত্রনাট্যে।
অন্যের পাশবিক রোষানলে দেখলাম ক্ষতবিক্ষত মুখ, বার বার দেখলাম...
ছবির প্রধান চরিত্র মালতী বেশ কিছুদিন পরে হঠাৎই আয়নার সামনে নিজেকে দাঁড় করায়। দেখবেই তো, কতদিন সে নিজেকে দেখেনি! কিন্তু আয়নায় চামড়া খসে জুড়ে যাওয়া বিভিন্ন ক্ষতের নীলচে রঙের মুখ দেখে সে চিৎকার করে ওঠে। এই চিৎকার আমার দীর্ঘদিনের শক্ত মনটাকেই ভেঙে দিল। মনে পড়ল, আমি তো দু’দিনের মাথায় হাসপাতালে মাকে বলেছিলাম,‘‘এখনই আয়না দাও। দেখব।’’ অন্যের পাশবিক রোষানলে দেখলাম আমার ক্ষতবিক্ষত মুখ। বার বার দেখলাম। মালতীর মতো আমার পাশে কেউ ছিল না। শুধুই মা। সে বেচারি কত করবে?বাড়িতে কাজ করে। এমনিতেই শুনছে যে মেয়ের চরিত্র খারাপ। যে ছেলে অ্যাসিড ছুড়েছে তার সঙ্গেই আমার ওঠাবসা ছিল...।
হ্যাঁ ছিল। যদি দেখি সে পুরোদস্তুর মিথ্যেবাদী লোক তাহলে তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখব কী করে? সম্পর্ক রাখিনি। আর তাই এই পরিণতি!
ছবিটা দেখতে দেখতে একটু হিংসে হল মালতীর উপর।ওর চারপাশে বড় উকিল। আর মধুরজিৎ সার্গি, যে মালতীর হয়ে লড়াই করেছে, কী ভাল যে তাঁর অভিনয়।লড়াকু মানুষ। অনেক সমর্থন মালতীর। আমি হাসপাতালে পোড়া চামড়ায় নিজেই অ্যালোভেরা মাখতাম...
পুলিশ দেখলাম, ছবিতে ভীষণ তৎপর। ইনভেস্টিগেশনের সময় খুব দ্রুত ঘটনার জায়গা পরিদর্শনে গেল। মেঘনা গুলজার আপনাকে বলি,না, পুলিশ এত সহযোগী নয়। মানতে পারলাম না।
দমদম থানা আমার এফআইআর-ই নিয়েছিল তিন মাস পর। একদিন তো পুলিশ বাড়িতে হাজির হয়ে বলে, আমায় অভিযুক্তের বাড়ি যেতে হবে। ভাগ্যিস আমার আইনজীবী ছিলেন। তিনি জানান, কোর্টের নির্দেশনামা ছাড়া আমি পুলিশের সঙ্গে কোথাও যেতে পারি না।
তবে মালতীর যন্ত্রণা বার বার আমায় সেই আগের মতো কাঁদিয়ে ছাড়ল। আগে যেমন হাসপাতালে রোজ কাঁদতাম। ছবিতে মালতীকে ওর মা মাথায় জল দিয়ে স্নান করাচ্ছে...খুব কষ্ট হচ্ছিল নিজের মায়ের জন্য তখন। যেটুকু আরামের স্পর্শ তা ওই সময় মার থেকেই পেয়েছিলাম। এখন একটা এনজিও-র সঙ্গে যুক্ত আমি। দেখেছি অনেকে তো ওই সময় বাবা-মায়ের সহযোগিতাও পান না।
‘মালতীর যন্ত্রণা বার বার আমায় সেই আগের মতো কাঁদিয়ে ছাড়ল’ ( বাঁ দিক থেকে সঞ্চয়িতা, দীপিকা এবং লক্ষ্মী)
ছবি বার বার আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমার ধূসর নির্মম জীবনে। মালতীর পিঠ থেকে চামড়া নিয়ে মুখে বসানো হচ্ছে আর আমি ভাবছি এই যে আমার পোড়া মুখের কপাল, এই কপাল থেকে চামড়া কেটে আমার নাক তৈরি হয়েছিল। আর যাই হোক, আমার কপাল মন্দ নয়! ভালই। আর সেই কপালের জোরেই বেঁচে গেলাম। মালতীর মতো চাইলে টিকালো নাক আরও পরিষ্কার চামড়ার সার্জারি করতে পারতাম। কিন্তু চাইনি। সৌন্দর্যের মানেটাই তো পুড়ে ছারখার। এখন মনে হয়, এই বেশ দেখায় আমায়।থাক আরও যন্ত্রণা।
ফিরে আসি ছবির বিষয়ে। এই ছবিতে গান আছে। গানের কথা মাঝে মাঝে কানে পৌঁছয়। তবে এই ছবির রক্তধারায় গান আমার কাছে বেমানান। আসলে, নিজের জীবন পরদায় দেখে মনে হল তার কাটাছেঁড়া রক্তক্ষরণ ছবিতে থাকবে। লড়াই থাকবে। আক্রমণ থাকবে। জয় থাকবে। অনুপ্রেরণা থাকবে।
কিন্তু গান?
চামড়া পোড়া আগুন লাগা প্রাণকে গান দিয়ে কি দেখানো যায়? মানতে পারি না। এই ছবি দেখতে গিয়ে নিজের আত্মাকে বাইরে রেখে শুধু মানুষ হয়ে ছবিটা দেখতে পারলাম না। আর সেই কারণেই মনে হল, ভিক্রান্ত মাস-এর মতো জীবনসঙ্গী যদি মালতী পায়। আহা! এমন নির্ভরসঙ্গী! এমন চরিত্রের সংযত অভিনয় বেশ লাগে।
আর একটা আর্জি আছে আপনাদের কাছে। দীপিকার জেএনইউ-তে যাওয়া নিয়ে গত ক’দিন ধরে তীব্র রাজনীতি চলছে দেখছি। দয়া করে ‘ছপাক’ নিয়ে রাজনীতি করবেন না। তাতে আমাদের মতো মেয়েদের যন্ত্রণা আর হাহাকার কোথায় যেন হারিয়ে যায়।
ছবিটা আমার মতো মেয়েকে নানা স্তরে নিয়ে যায়। কখনও কাঁদি। কখনও রাগি। কখনও মালতীর প্রতিবাদ, মনে হয় আমার কথা। আবার ভাবি, ধুর, এই ছবি করে কী হবে? অ্যাসিড আক্রমণ বন্ধ হয়ে যাবে? এটা তো একটা ছবি মাত্র। মেঘনা গুলজার যদিও হ্যাপি এন্ডিং-এর পথে যাননি। সংকেত দিয়েছেন। সাবধান করেছেন এ দেশে বেড়ে চলা অ্যাসিড আক্রমণের পরিণতি নিয়ে। তাতে কি বন্ধ হবে অ্যাসিড বেচা?
উত্তর নেই।
পোড়া মুখে তবে কি ফাগুন ছুঁল?
কিন্তু হল থেকে যখন বেরিয়ে আসি দেখলাম সেই ‘আহা! উফ!’ করা মেয়ে দু’জন, যারা ঘেন্নার চোখে তাকিয়েছিল, তারা আমায় দেখে হাসল! গা ঘেঁষে সিড়ি দিয়ে নামল!
ওদের কথা কানে এল। ওরা এরকম বলছিল...
‘অনেক মেয়ে তো মালতীর মতো সাপোর্ট পায় না।তাদের কী অবস্থা?’
‘অ্যাসিড অ্যাটাক হলে সবচেয়ে আগে জল ঢালতে হয়? এটাও জানতাম না!’
‘এরা সবাই তো আমাদের মতোই, তা-ও আমরা কেমন টেরিয়ে দেখি, নাহ্?’
পোড়া মুখে তবে কি ফাগুন ছুঁল?
(লেখক পরিচিতি: ২০১৪-র ২২ সেপ্টেম্বর, মহালয়ার আগের দিন অ্যাসিডে আক্রান্ত হন। তখন তাঁর বয়স ২২। বর্তমানে সমাজকর্মী।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy