মঞ্চে মগ্ন মৌসুমী। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য
এখন আর তাঁর গান গাইতে ইচ্ছে করে না। এ এমন এক সময় যখন লিখতে, বাড়ির বাইরে বেরোতে, কিছু করতেই ইচ্ছে করে না তাঁর! কিন্তু গান তাঁর শেষ আশ্রয়। তিনি বলেন, “গান ছাড়া আমার আর কোনও মাধ্যম নেই, তাই গান গেয়েই বলতে হয় আমার গান গাইতে ভাল লাগছে না এখন।”
আর এর পরেই গেয়ে ওঠেন তিনি, মৌসুমী ভৌমিক। গুমোট ভাদুরে সন্ধ্যা সঙ্গীতের নবধারাজলে সিক্ত হয়। পরের ঘণ্টা দেড়েক গানে-গল্পে-কথায় শান্তিপুর পাবলিক লাইব্রেরির বদ্ধ প্রেক্ষাগৃহে কয়েকশো শ্রোতাকে প্রায় মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখেন তিনি। কোনও যন্ত্রানুষঙ্গ ছাড়াই, খালি গলায়।
শনিবার সন্ধ্যায় শান্তিপুর সাহিত্য পরিষদের শতবর্ষ ভবন নির্মাণের অর্থ সংগ্রহের জন্য আয়োজিত অনুষ্ঠানের সুরটি প্রাক্কথনেই বেঁধে দিয়েছিলেন সুধীর চক্রবর্তী। বলেন, “মৌসুমীদের মতো মানুষ যে দেশে আছেন, সেখানে গান কখনও অবসিত হয় না। ধারার মতো, ঢেউয়ের মতো চলে। শুধু বাঁক বদল হয়, চরিত্র খানিকটা পাল্টে যায়। ‘তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে, কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফুটে’...।” তিনি ধরিয়ে দেন, মৌসুমী এক জন আদ্যন্ত আধুনিক মানুষ, সারা পৃথিবী তাঁর দেশ। তাঁর গানে আছে বহু দেশ দেখা, বহুমানুষের সঙ্গ করা জীবনবোধ।
মৌসুমী শুরুতেই বলে দেন, পর পর গান সাজিয়ে যাঁরা অনুষ্ঠান করেন, তেমন শিল্পী নন। তিনি একটি প্রেক্ষিত তৈরি করতে করতে, গান গাইতে কথা বলতে পছন্দ করেন। এই সময়ের প্রেক্ষিতে সে ভাবেই গাইবেন। এবং ধরেন প্রথম গান— ‘রাত্রি নামে দিন ফুরিয়ে যায়, শ্রান্ত স্নায়ু নিদ্রা পেতে চায়’। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সুরের বুনোটে সময় থমকে দাঁড়ায়।
গান কথা গল্প স্মৃতিচারণে ভেসে মৌসুমী শোনান শচীনকর্তাকে মনে রেখে হালে বাঁধা গান— ‘কে যাস রে গাঙ বেয়ে বেয়ে শুনিস না কি তুই’। কী এক অমোঘ মায়া চারিয়ে যায় যেন এ দেওয়াল থেকে ও দেওয়াল। পরে আর এক গান যখন বলে যায়, ‘এখন আমার ঘরে রোগ জর্জর, তুমি এখন এসো না সুদিনে এসো’, প্রেক্ষাগৃহ যেন শ্বাস নিতে ভুলেছে।
লোকগান নিয়ে দীর্ঘ দিন কাজ করে চলা মৌসুমী শোনান বিস্ময়কর এক গান শেখার গল্প। বাংলাদেশের সিলেটে সৈয়দপুরের এক পিরের গান তিনি শিখেছেন তাঁর বন্ধুর কাছে লন্ডনে বসে। অথচ তখনও সে গানে পুব বাংলার মাটির গন্ধ টাটকা— ‘প্রাণনাথ বন্ধু রে, অপরাধী হইলাম আমি এ কোন বিচারে/ আমার মনের কথা মনে রইল হুড়কি দিলাম ঘরে...’।
অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে তাঁর সংগ্রহ থেকে একটি তথ্যচিত্র দেখান মৌসুমী — ‘নোটস অন ব্লাইন্ডনেস’। ক্রমশ অন্ধ হয়ে যেতে থাকা একটি মানুষ তাঁর অনুভবের কথা রেকর্ড করে রেখেছিলেন। দৃষ্টি হারিয়ে কেমন করে স্পর্শ আর অনুভব দিয়ে তিনি তাঁর বিশ্বকে দেখেন। শেষে মৌসুমী যখন গাইছেন, ‘বিরাট সূর্য এই পৃথিবীকে ঘিরে থাকে’, চক্ষুষ্মান অথচ দৃষ্টিহীন মানুষ যেন গানের ভিতরে ভুবনখানি দেখার পথ খুঁজে পায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy