দেবী চৌধুরানী
আশাপূর্ণা দেবীর উপন্যাস ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’ অবলম্বনে ধারাবাহিকে দেখানো হয়েছে, উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র বালিকাবধূ সত্যবতী তার শাশুড়ি এলোকেশীর রক্তচক্ষু এড়িয়ে প্রতিমা গড়েছে। সত্যিটা জানতে পেরে শাশুড়ি মূর্তি বিসর্জনের জন্য আদেশ করলেন বটে, কিন্তু শত চেষ্টাতেও প্রতিমাকে একচুল নড়ানো গেল না— পরিচিত উপন্যাসের এমন গতি দেখে বেশ অবাক হয়েছেন দর্শক। কারণ উপন্যাসে এমন কিছুই তো ছিল না! এলোকেশী কি এতটাই দজ্জাল ছিল যে, বৌমার প্রাণসংশয়ের কারণ হয়ে উঠেছিল সে? দর্শকের মতে, আশাপূর্ণা দেবীর গল্পে এমন পরিবর্তন বেশ বেমানান। এই ধারাবাহিকের প্রযোজক রানা সরকার বললেন, ‘‘কোনও টেক্সটকে মেগা সিরিয়ালে দেখাতে গেলে অদলবদল করতেই হয়। উপন্যাসে সত্যবতীর করা কাজের চারটে উদাহরণ থাকলে, আমরা সে রকম আরও তিনটে ঘটনা জুড়তে পারি। তা বলে সত্যবতীর গোটা চরিত্রটাকেই বদলে দিতে পারি না।’’ তিনি যোগ করেন, ‘‘আমরা দু’ধরনেরই ফিডব্যাক পাচ্ছি। কিছু ক্ষেত্রে দর্শক এই এক্সপ্লোর করাকে উপভোগই করছেন। আর যাঁরা রক্ষণশীল মানসিকতার, তাঁদের বিষয়টায় আপত্তি আসছে। বিশেষ কারও জন্য মেগা বানানো হয় না। আমাদের লক্ষ্য হল আপামর সাধারণ দর্শক।’’
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘দেবী চৌধুরানী’ অবলম্বনে ধারাবাহিকটি নিয়েও বিচলিত সাহিত্যপ্রেমীরা। চিত্রনাট্যকার মুখ্য চরিত্র প্রফুল্লর শ্বশুর হরবল্লভবাবুকে পুরোদস্তুর ভিলেন বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞাপনে প্রফুল্লর ডাকাত হয়ে ওঠার আগে সাজপোশাক দেখে মনে হচ্ছে, যেন কোনও দক্ষিণী মাইথলজি-নির্ভর ছবি থেকে নেওয়া!
প্রযোজকরা যা-ই বলুন না কেন, এই ধারাবাহিকগুলি কয়েকটি প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। সাহিত্যনির্ভর ধারাবাহিক দেখে দর্শকের কি আদৌ মনোরঞ্জন হচ্ছে? যাঁরা শাশুড়ি-বৌমার ঝগড়া ও পারিবারিক অশান্তির বাইরে গিয়ে নতুন কিছু দেখতে চান, তাঁরা ঠকে যাচ্ছেন না তো? এতে কি বাংলা সাহিত্যেরও ক্ষতি হচ্ছে না?
প্রথম প্রতিশ্রুতি
এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয়েছিল সাহিত্যিক স্মরণজিৎ চক্রবর্তীকে। তাঁর উত্তর, ‘‘ক্ষতি তো হচ্ছে! অনেকেই আছেন যাঁরা ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’ বা ‘দেবী চৌধুরানী’ বা বাংলা সাহিত্যের সেরা উপন্যাসগুলির নাম শুনেছেন। জানেন কতটা বিখ্যাত। হয়তো কোনও ভাবে পড়া হয়ে ওঠেনি। বিশেষ করে এখন তো মানুষের পড়ার অভ্যেস কমে গিয়েছে। আর তাঁরা যখন দেখবেন সেই সব গল্পও কূটকচালিতে ভর্তি, তখন ওই লেখকের আর কোনও বই পড়ার উৎসাহ পাবেন কি? হয়তো নাক সিঁটকে বলবেন, ‘এ মা! এই লিখেছে! এই নিয়ে এত মাতামাতি।’ আসলে সিরিয়াল যাঁরা করেন, তাঁরা প্রথমে একটা জনপ্রিয় নাম ঠিক করেন। সেই নামের নীচে চিরাচরিত বিষয় দেখানোর চেষ্টা করেন। তাঁদের ভাষায়, ‘দর্শক খাবে ভাল।’ কিন্তু বাংলা সাহিত্যের তো বিরাট ভাণ্ডার। সেখান থেকে খুঁজে নিন না তাঁরা যা চান।’’
প্রতিবেদককে দেওয়া একটি পুরনো সাক্ষাৎকারে সুচিত্রা ভট্টাচার্য বলেছিলেন, তাঁর উপন্যাস ‘কাছের মানুষ’ সিরিয়ালে যে ভাবে পরিবর্তন করা হয়েছিল, তাতে তিনি মোটেও খুশি হননি। অবশ্য সব নির্মাতাকে এক ছাঁচে ফেলা যায় না। আশাপূর্ণা দেবীর আর একটি উপন্যাস ‘সুবর্ণলতা’র প্রবোধ ওরফে বিশ্বনাথ বসু বললেন, ‘‘উপন্যাসকে সম্পূর্ণ ভাবে ফলো করেই ‘সুবর্ণলতা’ হয়েছিল। টিআরপি-র অসুবিধে তো হয়নি!’’
শুরু হতে চলেছে সমরেশ মজুমদারের ‘সাতকাহন’ নিয়ে ধারাবাহিক। লেখক জানিয়েছেন, প্রায় তিরিশ বছর আগে লেখা উপন্যাস নিয়ে এই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে ধারাবাহিক করতে গেলে কিছু তো বদলাতে হবে। বদলটা লেখকই বলে দিচ্ছেন চিত্রনাট্যকারকে।
কিছু কিছু উপন্যাস বাঙালির আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। সেই সব সাহিত্যের অদলবদলের ক্ষেত্রে নির্মাতাদের কি আর একটু যত্নবান হওয়া উচিত নয়?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy