যিশু সেনগুপ্ত।
সকাল সাড়ে ৯টা
কাল ওয়েব সিরিজ দেখতে দেখতে বেশ রাত হল। সেকেন্ড ফ্লোরে যাই, নীলাঞ্জনারা ব্রেকফাস্টের জন্য অপেক্ষা করছে। আড়াই বছর পর টানা এত দিন বাড়িতে। সকালের খাওয়াটা একসঙ্গে খাওয়ার চেষ্টা করি। বিছানা তুলে এ বার সোজা দোতলায়। বিছানা অবশ্য আমি ছোটবেলা থেকে নিজেই তুলি। তবে এখন নীলাঞ্জনাকে হেল্প করার জন্য বাড়িতে রান্না করছি। রান্না ব্যাপারটা আমার কাছে নতুন জিনিস। তাই এখন ভাল লাগছে। পরে কতটা লাগবে জানি না। তবে মুম্বইতে তো একাই থাকি। নিজের মতো রেঁধে খাই। তবে এখানে তো সবার জন্য রান্না। তাই এক দিন মাটন কারি, চিকেন কারি করে বউ-বাচ্চাদের খাইয়েছি। আর একদিন চিলি চিকেন ফ্রায়েড রাইস করেছি। আমাদের বাড়িতে দু’জন আছেন যাঁরা আমাদের সঙ্গেই থাকেন। সে দিক দিয়ে খুব অসুবিধে হচ্ছে না। তবে খাবার প্লেট আমাদের বাড়িতে যে যার সে তারটাই তুলি। মেয়েরাও সেটা শিখেছে। যাই এ বার…
সকাল ১০টা
আমি বরাবর ডিম টোস্ট কফি খেতে অভ্যস্ত। আজও তাই খেলাম। এর পর ছোট মেয়ের পড়াশোনায় কিছু সাহায্য করছি, বিশেষ করে নীলাঞ্জনা যখন সময় পায় না। ওদের স্কুল থেকে দেখছি এখন প্রজেক্ট পাঠিয়ে দিচ্ছে। ওকে নিয়ে বসি।
দুপুর ১টা
আমার শাশুড়ি অসুস্থ ছিলেন। এখন ভাল আছেন। ওর সঙ্গে একটু গল্প করলাম। লকডাউনের বিষয়ে উনি জানতে চান, কী চলছে এখন। এর পর স্নানে যাব।
মেয়ের সঙ্গে ব্যস্ত যিশু।
দুপুর ২টো
লাঞ্চটা আমরা চার জনেই করি। আমি কোনও দিন খাওয়ার ব্যাপার সাঙ্ঘাতিক ডায়েট করিনি। বাড়ির রান্নাই খাই। আজও তাই খেলাম। টকের ডাল, বেগুনভাজা, পটলভাজা। সর্ষের তেলে মাখা পেঁয়াজ লঙ্কা দিয়ে আলু সেদ্ধ। রুই মাছের কালিয়া। আমার মেয়েরা মাছ খায়। আজ ওদের স্কুল নিয়েই কথা হল। সারা বলছিল জারার নতুন ক্লাসে কোন টিচার হবে? সারার স্কুলেই জারা যায়। সারা বলছিল বোনকে, কেমন পড়াশোনার চাপ হবে।
দুপুর ৩টে
আমি আমার চার তলার ঘরে চলে আসি। ওটা আমার ঘর। সামনে বড় টেরেস। দাঁড়ালেই আকাশ দেখা যায়। ওখানেই ওয়েব সিরিজ দেখছি রোজ। ওটা আমার সময়। ‘টেক ইন’ বলে একটা সিরিজ দেখলাম। ওটা শেষ। আজ থেকে ‘মির্জাপুর’ দেখা শুরু করব। এখন ছোট মেয়ের সঙ্গে খেলব। ‘কানেক্ট ফোর’ বলে একটা খেলা আছে। ও আমার সঙ্গে খেলতে ভালবাসে। বড়টা সত্যি বড় হয়ে গিয়েছে। বন্ধুদের সঙ্গে ফোন কলে ব্যস্ত। নিজের প্রজেক্ট নিজে করে নেয়। ওকে দেখতেই হয় না। আর সারা এমনিতেই খুব ম্যাচিয়োর। ও টিনএজার। নিজের মতো করেই থাকে। আজ বলছিল আমায়, আমি কাজে ফিরে যেতে চাই কি না! আমি বললাম, ‘অবশ্যই। বাড়িতে এ ভাবে বসে থাকলে টাকাটা ফুরিয়ে যাবে তো।’ ও সেটা বুঝলও। বলল, ‘আমি খুব তাড়াতাড়ি স্কুলে যেতে চাই।’ কী বলব ওকে? নিজের মতো করে নিজেদের এন্টারটেন করতে হবে, ওকে বোঝালাম। বললাম, ‘আমরা বেরলে শুধু আমরাই নয়, অজস্র মানুষ বিপদে পড়বে।’ আর কী বা বলব! ধৈর্য ধরা ছাড়া কী বা করতে পারি আমরা আজ?
নীলাঞ্জনা আর যিশু
সন্ধে ৭টা
আমি এখন গ্রাউন্ড ফ্লোরে। নিজের জিমেই ওয়ার্কআউট করি। ঘণ্টাখানেক ওয়ার্কআউট, তারপর শাওয়ার নিই।
আরও পড়ুন: অস্থির পরিস্থিতিতেও সৃষ্টি থেমে নেই তাঁদের
রাত সাড়ে ৯টা
এই সময়টা বন্ধুবান্ধবের। সৃজিত, শ্রীজাত, রুদ্র, সবাই একসঙ্গে আড্ডা মারি রোজ। এক দিন শ্রীকান্তদাও (আচার্য) ছিল। আমাদের ছোটবেলার বন্ধুদের গ্রুপ আছে, ওদের সঙ্গেও ভিডিয়ো চ্যাট হয়। বিদেশেও কয়েক জন আছে। খবর নেওয়া-দেওয়া চলে। আড্ডা মারতে মারতেই রাত বাড়ে। ডিনারটা খুব লাইট করি। আজ লোখান্ডওয়ালায় আমাদের নতুন ফ্ল্যাটটার কথা মনে পড়ছে। এই সময় আমার ওই নতুন বাড়িতেই তো থাকার কথা। নীলাঞ্জনার যে ফ্ল্যাট ছিল ওটা ভেঙে ফ্ল্যাট হয়েছে। কে জানে, নতুন ফ্ল্যাট কী ভাবে পড়ে আছে? মুম্বইয়ের অবস্থা আমাদের এখানকার চেয়েও তো খারাপ। আমার শালী আছে ওখানে, ওর সঙ্গে আজ কথা হল। ওখানে তো ফ্ল্যাটগুলো আলাদা করে লকডাউন। বাড়ির বাইরে মানুষের পা রাখার জো নেই।
একেই বলে বিশ্বযুদ্ধ। এটা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। বন্দুক নেই। মানুষে মানুষে যুদ্ধ করে না। শত্রুকে চেনে না। তাকে দেখা যাচ্ছে না। অথচ বাড়ির বাইরে পা রাখলে তুমি আক্রান্ত হবে। তা-ও আবার জানতেও পারবে না! অদৃশ্য মৃত্যুফাঁদ পাতা। আমরা ঐতিহাসিক সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। সব শেষ হলে হয়তো আমি আমার নাতি-নাতনিদের গল্প করব, আমরা এমন সময়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছিলাম যখন দু’মাস পৃথিবীর সব বন্ধ ছিল!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy