‘সুবর্ণলতা’ ও ‘পাণ্ডব গোয়েন্দা’।
সিনেমা-সিরিয়াল শিল্প, আবার ব্যবসাও বটে। শিল্প খোঁজে উৎকর্ষ, ব্যবসা লাভের অঙ্ক। আপাত ভাবে এই দুইয়ের বিরোধ না থাকলেও, কোনও কোনও ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব ওঠে চরমে। সাহিত্যের কোনও চরিত্রকে ঘিরে ‘মেগা’ সিরিয়ালের গল্প বোনা হলে প্রকট হয় এই দ্বন্দ্ব। সাত দিনের গল্পের জোগান, টিআরপির চোখরাঙানিকে সামলে নতুন প্রজন্মকে সিরিয়ালমুখী করে তুলতে আপস করতে হয় সাহিত্যমূল্যের সঙ্গে। একটি জনপ্রিয় চ্যানেলের ধারাবাহিক ‘পাণ্ডব গোয়েন্দা’ সেই প্রশ্নই তুলে ধরছে।
সিরিয়ালের প্রয়োজনে গল্পে পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করতেই হবে। কিন্তু তা কতটা পরিসর পর্যন্ত করা বাঞ্ছনীয়? আছে কি তার মাপকাঠি? না কি টিআরপি-সর্বস্ব বাজারে চ্যানেলই শেষ কথা?
‘পাণ্ডব গোয়েন্দা’ ধারাবাহিকের পরিচালক রাহুল মুখোপাধ্যায় সাবধানী সুরে বললেন, ‘‘এই ধারাবাহিক পাণ্ডব গোয়েন্দা টু পয়েন্ট ও। ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের লেখা এই গল্প পিরিয়ড পিস করারই ভাবনা ছিল। কিন্তু অতিমারির কারণে সম্ভব হয়নি। সিদ্ধান্ত হয়, গল্পের নির্যাসটুকু নিয়ে সময়োপযোগী করে পরিবেশন করা হবে।’’ ধারাবাহিকের চিত্রনাট্যের সঙ্গে যুক্ত শর্বরী ঘোষালের কথায়, ‘‘চোদ্দো-পনেরো বছরের ছেলেদের হাতে পিস্তল দেখালে সিরিয়াল সম্প্রচারের লাইসেন্স পাওয়া যাবে না। তাই অ্যাডভেঞ্চারের মোড়ক বদলাতে হয়েছে।’’
সাহিত্যনির্ভর কাজ ছোট পর্দায় নতুন নয়। বরং দূরদর্শনে বিভিন্ন সময়ে কালজয়ী লেখা নিয়ে ধারাবাহিক তৈরি হয়েছে। তবে সেগুলি ছিল সীমিতসংখ্যক পর্বের। এখনকার চ্যানেলের সাহিত্যনির্ভর কাজ আর পাঁচটি মেগা ধারাবাহিকের চেয়ে আলাদা কিছু নয়। রয়েছে টিআরপির চাপও। এই দুইয়ের জন্য মূলত কোপ পড়ছে সাহিত্যমূল্যে।
তবে এই বিষয়ে ইন্ডাস্ট্রির দুই সিনিয়র শিল্পীর দৃষ্টিভঙ্গি দু’রকমের। খেয়ালি দস্তিদারের কথায়, ‘‘দূরদর্শনের যুগে যখন সাহিত্যনির্ভর কাজ হয়েছে, তখনও গল্পে রদবদল হয়েছে। তবে কতটা পরিবর্তন করা হবে, তা নিয়ে তখন সংশ্লিষ্ট লেখকদের সঙ্গে রীতিমতো আলোচনা হত। সে ক্ষেত্রে বাদানুবাদও হয়েছে। তবে গল্পের যে গন্ধ বা নির্যাস, তা অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা করা হত।’’ আবার কুশল চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘দূরদর্শনের যুগের সঙ্গে এখনকার বেসরকারি চ্যানেলের সাহিত্যনির্ভর কাজ মেলালে চলবে না। কারণ দু’টির পিছনে যে আর্থিক সমীকরণ, তা অনেকটাই আলাদা।’’ অভিনেতার কেরিয়ারের শুরুর দিকের উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল সাহিত্যনির্ভর। ‘সেই সময়’, ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’-এ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে ছিলেন কুশল। দূরদর্শনে রানি রাসমণির জীবন অবলম্বনে তৈরি ‘রাজেশ্বরী’ ধারাবাহিকের প্রোডাকশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘৩১৬টি পর্বের বেশি করতে
পারিনি। কারণ এর বেশি উপাদান তখন পাওয়া যায়নি। কিন্তু এখন ‘করুণাময়ী রাণী রাসমণি’ তিন বছর ধরে চলছে। সেটা ইন্ডাস্ট্রির জন্য নিঃসন্দেহে ভাল। ইন্ডাস্ট্রির স্বার্থে শো চালিয়ে যেতে হবে। তিন বছর ধরে এমন বিষয়ের শো চালাতে হলে, অনেক পরিবর্তন আনতেই হবে।’’
হালফিলের ‘দেবী চৌধুরাণী’, ‘কপালকুণ্ডলা’র আগেই বেসরকারি চ্যানেলে হওয়া শোগুলির মধ্যে ‘সুবর্ণলতা’ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তারও আগে আশাপূর্ণাদেবীর জীবদ্দশায়, দূরদর্শনের পর্দায় ‘সুবর্ণলতা’ নিয়ে সীমিত সংখ্যক পর্বের অনুষ্ঠান করেছিলেন পরিচালক রাজা সেন। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক ইন্ডাস্ট্রির এক সিনিয়রের মতে, ‘‘সাহিত্যনিষ্ঠ থাকার প্রচেষ্টা আগেকার ধারাবাহিকগুলিতে বেশি দেখা যেত, কারণ অনেক ক্ষেত্রেই কবি-সাহিত্যিকরা চিত্রনাট্য লিখতেন। কিন্তু বেসরকারি চ্যানেলের দাপটে সাহিত্যনিষ্ঠ থাকার তাগিদ বোধহয় অনুভূত হয় না।’’
তবে ব্যতিক্রম যে নেই, তা নয়। বাংলার একটি চ্যানেল ধারাবাহিক ভাবে সাহিত্যনির্ভর শো তৈরি করেছে। ‘সাহিত্যের সেরা সময়’ সেই চ্যানেলের একটি উল্লেখযোগ্য শো। চ্যানেলের মুখপাত্র ঈশিতা সুরানার কথায়, ‘‘সাহিত্যনির্ভর শোয়ে যদি সেই সময়, আবহ যথাযথ ভাবে তুলে ধরা না যায়, তবে তা বানানোই উচিত নয়। কারণ কিছু দিনের টিআরপি দিয়ে বেশি দিন শো চালানো যায় না।’’ এখন ওই চ্যানেলে চলছে ‘বালিকাবধূ’।
সাহিত্যনির্ভর শো কি টিআরপি দেয় না? ঈশিতা এই অভিযোগ মানতে চাইলেন না। আবার অনন্যা চট্টোপাধ্যায় অভিনীত ‘সুবর্ণলতা’র টিআরপি কিন্তু একটি মান ধরে রেখেছিল বলেই ইন্ডাস্ট্রির মত। এ প্রসঙ্গে কুশলের মত, ‘‘সময়োপযোগী করতে গিয়ে সাহিত্য থেকে অনেকটাই বিচ্যুত হলে দর্শক গ্রহণ করবেন না।’’
‘পাণ্ডব গোয়েন্দা’ ধারাবাহিকের টিজ়ারে বাবলুর দিকে বাচ্চুর ইঙ্গিতপূর্ণ চাহনি সোশ্যাল মিডিয়ায় শোরগোল তুলেছিল। গল্পে তেমন সম্পর্কের ইঙ্গিত ছিল না। তবে এই পরিবর্তন টিআরপি বাড়াতে যে সাহায্য করেছে, তেমন কিন্তু নয়। পরিচালকের যুক্তি, ‘‘শাশুড়ি-বৌমার সিরিয়াল দেখা দর্শকের কাছে এই ধারাবাহিক গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে সময় লাগবে।’’
দর্শকের স্বাদবদলের জন্য এখন প্রায়ই সাহিত্যনির্ভর শো নিয়ে আসছে বাংলার চ্যানেলগুলি। কিন্তু সাহিত্যনিষ্ঠ থাকার প্রচেষ্টায় বাদ সাধছে কি চ্যানেল, টিআরপি এবং বদলে যাওয়া সময়ের দাবি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy