‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ ছবির দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত।
আর মাত্র এক দিনের অপেক্ষা। তার পরেই দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান। আগামী ২১ জুলাই মুক্তি পেতে চলেছে হলিউড তারকা ক্রিস্টোফার নোলান পরিচালিত ছবি ‘ওপেনহাইমার’। মুক্তির অনেক আগে ছবি ঘিরে আলোচনার কেন্দ্রে থেকেছে এই ছবি। ‘ওপেনহাইমার’-এ মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন ‘পিকি ব্লাইন্ডার্স’ খ্যাত অভিনেতা কিলিয়ান মার্ফি। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে আছেন ম্যাট ডেমন, রবার্ট ডাউনি জুনিয়র, এমিলি ব্লান্ট, ফ্লোরেন্স পিউ, রামি মালেকের মতো তাবড় অভিনেতারা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকার লস অ্যালামস ল্যাবরেটরির অধিকর্তা ছিলেন পদার্থবিদ জে রবার্ট ওপেনহাইমার। তাঁর জীবনকাহিনি ও ‘ম্যানহাটান প্রজেক্ট’-এ তাঁর ভূমিকা এই ছবির নির্যাস। এই প্রথম নয়, যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এর আগেও ছবি বানিয়েছেন নোলান। শুধু নোলানই নন, এর আগে যুদ্ধের প্রেক্ষাপট ও তার পরিণতিকে সিনেমার পর্দায় তুলে ধরেছেন হলিউডের একাধিক সিনেনির্মাতা। স্টিভেন স্পিলবার্গ থেকে তাইকা ওয়াইতিতি, স্যাম মেন্ডেজ় থেকে মেল গিবসনের মতো চলচ্চিত্র পরিচালকেরা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ ও ক্ষতবিক্ষত সমাজকে ফুটিয়ে তুলেছেন সিনেমার পর্দায়। মানব মননকে কতটা প্রভাবিত করে যুদ্ধ ও তার মর্মান্তিক পরিণতি, তা স্পষ্ট ‘শিন্ডলার্স লিস্ট’-এর মতো ছবিতেই।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি জার্মানির বর্বরতা ও হলোকস্টের হাত থেকে এক হাজারের বেশি পোলিশ ও ইহুদিকে রক্ষা করেছিলেন অস্কার শিন্ডলার। জন্মসূত্রে জার্মান ব্যবসায়ী ও নাৎসি দলের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও স্রেফ মনুষ্যত্বের খাতিরে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের নির্মম গণহত্যা থেকে ১১০০ জনকে বাঁচিয়েছিলেন তিনি। সেই কাজ করতে গিয়ে ঘুষ দিতে দিতে প্রায় কপর্দকশূন্য হয়ে গিয়েছিলেন শিন্ডলার নিজে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি হেরে গেলে শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণও করতে হয় তাঁকে। অস্কার শিন্ডলারের এই জীবনকাহিনি ও ‘শিন্ডলার্স আর্ক’ উপন্যাসের ভিত্তিতে ‘শিন্ডলার্স লিস্ট’ ছবিটি পরিচালনা করেন স্টিভেন স্পিলবার্গ। ১৯৯৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই ছবি সেরা ছবি, সেরা পরিচালকের বিভাগ-সহ মোট সাতটি বিভাগে অস্কার জিতেছিল।
‘শিন্ডলার্স লিস্ট’-এর মতোই অন্য একটি কালজয়ী ছবি ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’। ১৯৭৯ সালে প্রথম বার মুক্তি পায় ডেলবার্ট মান পরিচালিত এই ছবি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তৈরি এই ছবিতে ফুটে উঠেছিল এক জার্মান তরুণের কাহিনি। মাত্র ২০ বছর বয়সে সেনাবাহিনীতে নাম লিখিয়েছিল পল বমার। ফরাসি ও জার্মানদের যুদ্ধে বদলে গিয়েছিল তার গোটা জীবন। ২০২২ সালে সেই গল্পকেই আরও এক বার সিনেমার পর্দায় তুলে ধরেছিলেন পরিচালক এডওয়ার্ড বার্গার। চলতি বছরে অস্কারের মঞ্চে পূর্ণ দৈর্ঘ্যের আন্তর্জাতিক ছবির বিভাগে সেরার শিরোপা অর্জন করে এই ছবি।
‘শিন্ডলার্স লিস্ট’, ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ ছাড়াও হলিউডের একাধিক ছবিতে ফুটে উঠেছে যুদ্ধের সমসাময়িক জীবন। ক্রিস্টোফার নোলানের ‘ওপেনহাইমার’ দেখার আগে এক বার ঝালিয়ে নিতে পারেন সেই ছবিগুলিও। কোন কোন উল্লেখযোগ্য ছবি রয়েছে সেই তালিকায়?
১৯১৭ (২০১৯):
স্যাম মেন্ডেজ় পরিচালিত এই ছবির প্রেক্ষাপট প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। নিজের ঠাকুরদার মুখে জার্মানি ও ফ্রান্সের লড়াইয়ের এই গল্প প্রথম শুনেছিলেন মেন্ডেজ়। সেই গল্প থেকেই এই ছবি তৈরির অনুপ্রেরণা পান পরিচালক। ১৯১৭ সালে ফ্রান্সের সঙ্গে লড়াই চলাকালীন ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট থেকে হিন্ডেনবার্গ লাইনে পিছিয়ে আসেন জার্মান সেনাবাহিনী— হার স্বীকার করে নয়, অন্য এক রণকৌশল কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে। ব্রিটিশ সেনা সেখানে এসে উপস্থিত হলেই তাদের উপরে হামলা করার ছক জার্মানির। সেই মোক্ষম সময়ে শত্রুদের এলাকা পার করে একটি বার্তা দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে রওনা দেন দুই ব্রিটিশ সেনাকর্তা। ঠিক সময়ে ওই বার্তা পৌঁছলে প্রাণ বাঁচানো সম্ভব প্রায় ১৬০০ সেনার। সেই লক্ষ্যে কি সফল হবেন ওই দুই সেনাকর্তা? ওই একই সময়ের প্রেক্ষাপটে তৈরি ছবি ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’। এই দুই ছবি আসলে যুদ্ধরত দুই শিবিরের দর্পণ। ঐতিহাসিক এই প্রেক্ষাপটে তৈরি এই ছবি সাড়া জাগিয়েছিল দর্শকের মনে। যুদ্ধের নির্মমতা যে সর্বজনীন, তা ছবির ছত্রে ছত্রে তুলে ধরেছিলেন পরিচালক ও সিনেমাটোগ্রাফার রজার ডিকিন্স। ‘১৯১৭’-এর জন্য অস্কারও অর্জন করেন ডিকিন্স।
জোজো র্যাবিট (২০১৯):
‘জোজো র্যাবিট’ ছবিতে কমেডির মোড়কে নাৎসি জার্মানির নিষ্ঠুর চিত্র তুলে ধরেছিলেন পরিচালক তাইকা ওয়াইতিতি। অ্যাডলফ হিটলারের যুব সংগঠনে যোগ দেয় ১০ বছরের জোজো। কচি বয়সেই নাৎসি আদর্শ ও ভাবধারায় বিশ্বাসী সে। এ দিকে তার মা রোজ়ি বেৎজ়লার (স্কারলেট জোহানসন) নিজেদের বাড়ির চিলেকোঠায় লুকিয়ে রেখেছে এক ইহুদি মেয়েকে। জোজোর থেকে বয়সে সামান্যই বড় এলসা, তার প্রয়াত দিদির বন্ধু। হঠাৎ এক দিন রাস্তার মোড়ে মাকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পায় জোজো। মায়ের মৃত্যুর পরে এলসাকে কি নাৎসি বাহিনীর হাতে সমর্পণ করে দেবে জোজো? সেই গল্প নিয়েই তৈরি ‘জোজো র্যাবিট’। ২০১৯ সালে টরন্টো চলচ্চিত্র উৎসবে প্রিমিয়ার হয়েছিল এই ছবির। ২০২০ সালে অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডসের মঞ্চে সেরা অনুপ্রাণিত চিত্রনাট্যের জন্য অস্কারও পেয়েছিলেন ওয়াইতিতি।
ডানকার্ক (২০১৭):
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ১৯৪০ সালে ‘ব্যাটল অফ ফ্রান্স’ চলাকালীন ফ্রান্সের উপরে হামলা করেছে জার্মানি। ডানকার্কের সমুদ্রসৈকতে সেই সময় আটকে পড়েছে মিত্রশক্তির সেনা। সেখানে আটকে পড়া প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ সেনাকে সমুদ্রসৈকত থেকে উদ্ধার করার কাজে লেগে পড়েছিলেন মিত্রশক্তি কর্তৃপক্ষ। ক্রিস্টোফার নোলান পরিচালিত এই ছবি তাঁরই অন্য ছবির থেকে বেশ কিছুটা আলাদা। ছবির গতি, আবহ ও ছবিতে ক্যামেরার কাজের মাধ্যমে যুদ্ধকালীন নিঃসঙ্গতার ছবি এঁকেছিলেন নোলান। ছবিটি সম্পাদনার জন্য ২০১৮ সালে অস্কার পান লি স্মিথ।
দ্য বুক থিফ (২০১৩):
মার্কাস জ়ুজ্যাকের লেখা ‘দ্য বুক থিফ’ উপন্যাস অবলম্বনে এই ছবি বানিয়েছিলেন পরিচালক ব্রায়ান পার্সিভাল। এই ছবির অন্যতম বিশেষত্ব হল ছবিতে গল্প বলার ধরন। স্মৃতি ঘেঁটে এক অনন্যসাধারণ নাবালিকার জীবনের গল্প বলে স্বয়ং মৃত্যু। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে মিউনিখে আসে ১২ বছরের লিজ়েল মেমিঙ্গার। সেখানে আসার পথে প্রথম বার বই ‘চুরি’ করে সে। পালক মা-বাবার বাড়িতে থাকাকালীন অক্ষরজ্ঞান হয় তার। ধীরে ধীরে বইপত্রের প্রতি উৎসাহ বাড়তে থাকে লিজ়েলের। এ দিকে হিটলারের নাৎসি যুব বাহিনীতে নাম লেখানোর পরে বই পোড়ানোর ধুম দেখে অবাক হয় সে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে একাধিক বোমা বিস্ফোরণ ও দ্বন্দ্ব পেরিয়েও বইয়ের হাত ছাড়ে না লিজ়েল। ছবির শেষে জানা যায়, বই চুরি করে পড়তে শেখা সেই নাবালিকা বড় হয়ে এক নামজাদা লেখিকা হয়েছিল। যুদ্ধের আবহে বেড়ে ওঠা নাবালক-নাবালিকাদের মনস্তত্ত্ব ফুটে উঠেছিল এই ছবিতে।
দ্য পিয়ানিস্ট (২০০২):
পোলিশ-ইহুদি পিয়ানোশিল্পী ওয়াডিশ স্পিলম্যানের আত্মজীবনী ‘দ্য পিয়ানিস্ট’ অবলম্বনে এই ছবি বানিয়েছিলেন পরিচালক রোমান পোলান্সকি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তৈরি এই ছবিতে ফুটে উঠেছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে বাস্তুহারা এক শিল্পীর আর্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পোল্যান্ডের এক রেডিয়ো স্টেশনে পিয়ানোবাদক ছিলেন ওয়াডিশ স্পিলম্যান। ছবিতে তাঁর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বিখ্যাত অ্যাড্রিয়েন ব্রডি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন হলোকস্টের সময়ে ওয়ারশ-এর একটি ক্যাম্পে ঠাঁই হয়েছিল ওয়াডিশ স্পিলম্যান ও তাঁর পরিবারের। সেখান থেকে অপারেশন রেইনহার্ডের সময় ট্রেবলিঙ্কার ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল স্পিলম্যান ও পরিবারকে। সেই সময় তাঁকে উদ্ধার করেন তাঁরই এক পরিচিত। এক জন পিয়ানোশিল্পী থেকে নাৎসি ক্যাম্পের দাসে পরিণত হন স্পিলম্যান। এক কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পেই জীবন কাটতে থাকে তাঁর। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলেও ২০০০ সালে ৮৮ বছর বয়সে সোভিয়েত বন্দি হিসাবেই প্রয়াত হন ওয়াডিশ স্পিলম্যান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy