৩, লেক টেম্পল রোডের বাড়িতে বসবাস করেন সত্যজিৎ রায় ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
কালের নিয়মে হারিয়ে যায় সব কিছুই। অতীতকে ধরে রাখতে তখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে সংরক্ষণের প্রশ্ন। দক্ষিণ কলকাতার ৩, লেক টেম্পল রোড। তিন তলা বাগান সমেত বাড়িটির তিন তলার ফ্ল্যাটে এক সময় সপরিবার বাস করেছেন গুরু-শিষ্য— সত্যজিৎ রায় এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। বাংলা সিনেমার দুই কৃতীর স্মৃতিধন্য সেই বাড়িই এখন হাতবদল হয়ে চলে গিয়েছে কর্পোরেট সংস্থার হাতে। বর্তমানে কী অবস্থায় রয়েছে ঐতিহাসিক বাড়িটি? খোঁজ নিল আনন্দবাজার অনলাইন।
প্রথমে বাড়িটির ইতিহাস জেনে নেওয়াটা জরুরি। ১৯৫৯ সালে ৩, লেক টেম্পল রোডের বাড়িতে থাকতে শুরু করেন সত্যজিৎ। বাড়ির মালিক বারীন্দ্রনাথ বসুর কাছ থেকে তিন তলার ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়েছিলেন তিনি। ওই বাড়িতে সত্যজিৎ ছিলেন ১৯৭০ সাল পর্যন্ত। তার পর উঠে আসেন বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়িতে। পরের বছর থেকে ওই একই ফ্ল্যাট ভাড়া নেন সৌমিত্র। তিনি ওই বাড়িতে ছিলেন ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত। প্রায় তিন দশক বাড়িটি দুই খ্যাতনামী ব্যক্তিত্বের জীবনযাত্রার সাক্ষী থেকেছে।
বর্তমানে কী অবস্থায় আছে সেই বাড়ি? সম্প্রতি লেক টেম্পল রোডে উপস্থিত হয়ে দেখা গেল, বাড়িটির মূল কাঠামো এখনও একই রয়েছে। তবে সংস্কারের কাজ চলছে। বাইরে নতুন করে সিমেন্টের প্লাস্টার করা হচ্ছে। প্রতিবেশীদের দাবি, জানলা এবং দরজার ফ্রেমের আকার বদলে ফেলা হয়েছে। বাড়ির সামনের ফুটপাথে দীর্ঘ দিন ইস্ত্রির দোকান চালান কমলেশ রজক। বললেন, ‘‘আমি তো এক সময় এই বাড়িতেই থাকতাম বিএন বসুর দেখভালের জন্য। এখন থাকি না।’’ সত্যজিৎ বা সৌমিত্রকে তিনি দেখেননি। তবে স্মৃতি হাতড়ে জানালেন, তাঁর বাবা-কাকারা দোকান চালানোর সময় দুই পরিবারের থেকেই পোশাক পেতেন। বাড়ির মূল গেটে ঝুলছে তালা। অতীতের ‘বসু’ ফলকের পরিবর্তে এখন লেখা হয়েছে ‘মেট্রো আর্ক— ফার্স্ট ইন সিলিকনস ইন ইন্ডিয়া’। খোঁজ করতেই ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন দারোয়ান স্বরূপ। পদবি জিজ্ঞাসা করতেই বেঁকে বসলেন তিনি। শুধু জানালেন, কারও ফোন নম্বর দেওয়া নিষেধ। বার বার অনুরোধ করার পর তিনি কর্তৃপক্ষকে ফোন করলেও আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে তাঁরা কথা বলতে রাজি হননি।
এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বছর পাঁচেক আগে বারীন্দ্রনাথ বসু এবং তাঁর স্ত্রী প্রয়াত হন। বছর দুয়েক আগেই তাঁদের তিন ছেলে ‘চুপিসারে’ বাড়িটি বিক্রি করে দেন। এখন তাঁদের কেউ দিল্লি, কেউ আবার বিদেশে থাকেন। ৩, লেক টেম্পল রোডের বাড়িটি থেকে চারটি বাড়ি দূরেই থাকেন গৌরীশঙ্কর দেব। এলাকার দীর্ঘ দিনের বাসিন্দা। বললেন, ‘‘এখন আর ভেবে কী হবে! পাড়ার বয়স্করা তো কেউ আর বেঁচে নেই। আগামী প্রজন্ম হয়তো জানতেই পারবে না এই বাড়ির ঐতিহাসিক গুরুত্ব।’’ সত্যজিতের পরিবার নয়, বরং সৌমিত্রের পরিবারের সঙ্গে তাঁর শৈশবের স্মৃতি রয়েছে। বললেন, ‘‘সৌমিত্রবাবুর ছেলে তো আমার বন্ধু ছিল। একসঙ্গে প্রচুর খেলাধুলো করেছি।’’ ওই পাড়ার বাসিন্দা বর্ষীয়ান আইনজীবী সমীর মিত্র। সত্যজিৎকে চোখের সামনে দেখেছেন বলে এখনও নিজেকে ধন্য মনে করেন। বললেন, ‘‘আমার তখন বয়স ১৮ বছর। আমরা সরস্বতী পুজোর চাঁদা নিতে গেলে বিজয়া রায় দরজা খুলতেন। অন্য দিকে, পাড়ায় লাইব্রেরি তৈরি এবং আমাদের নাটক করতে উৎসাহ দিতেন সত্যজিৎবাবু।’’ গুপী গাইনের গানের রিহার্সালে বাড়িতে অনুপ ঘোষাল আসতেন, তারও সাক্ষী থেকেছেন তিনি। কথাপ্রসঙ্গেই একটি গল্প শোনালেন সমীর। জানালেন, একদিন তিনি বাড়ির গেট থেকে ফুটপাথ পর্যন্ত সত্যজিৎকে মাপজোক করতে দেখেন। দু’হাত তুলে বাড়িটিকে ফ্রেমের মধ্যে ধরেন তিনি। সমীর বললেন, ‘‘আমি দূর থেকে দেখে কিছুই বুঝলাম না। ও মা! তার কয়েক দিন পর দেখি, বাড়ির সামনের রাস্তায় ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়। জানতে পারলাম, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবির শুটিং চলছে।’’
নতুন মালিকেরা এই বাড়িটিকে কী কাজে ব্যবহার করবেন? এলাকায় খোঁজ নিতেই নানা মত উঠে এল। কারও মতে, বাড়ির সংস্কারের কাজ শেষ হলে সেখানে নতুন বাসিন্দারা এসে থাকবেন। আবার কেউ জানালেন, বাড়িটিতে নাকি কর্পোরেট অফিস তৈরি হবে। স্থানীয় এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘বিগত এক বছর ধরে কখনও কাজ হচ্ছে। আবার কখনও বন্ধ থাকছে। পুরোটাই রহস্যে ঘেরা। কী যে হচ্ছে, জানি না।’’
লেক টেম্পল রোডের বাড়ি যে বিক্রি হয়ে গিয়েছে, সে খবর জানতেন না সত্যজিৎ-পুত্র সন্দীপ রায়। আনন্দবাজার অনলাইনের তরফে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সন্দীপের প্রতিক্রিয়া, ‘‘সে কী! কবে বিক্রি করা হল। ওই বাড়িতে তো আমার ছোটবেলার প্রচুর স্মৃতি।’’ সত্যজিতের পর ওই একই বাড়িতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কেন থাকতে শুরু করেছিলেন, তার নেপথ্যে সম্ভাব্য কারণ ব্যখ্যা করলেন সন্দীপ। তাঁর কথায়, ‘‘সৌমিত্রকাকুর আগের বাড়িটা খুব বড় ছিল না। তার পর যখন জানতে পারলেন যে আমরা চলে যাচ্ছি, তখন তিনি বাবার কাছে ওই ফ্ল্যাটেই থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। বিষয়টা এই ভাবেই এগোয়।’’
বলা চলে, লেক টেম্পল রোডের বাড়িতে থাকাকালীনই সত্যজিৎ তাঁর পেশাগত জীবনের নতুন আঙিনায় প্রবেশ করেন। ওই বাড়িতেই তাঁর কলমে ফেলুদা এবং প্রফেসর শঙ্কুর জন্ম। সন্দীপ বললেন, ‘‘১৯৬১ সালে ওই বাড়িতেই তো ‘সন্দেশ’ পত্রিকার নবজন্ম। এমনকি, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’র বেশ কিছু কাজও ওই বাড়িতে শুরু হয়। কিন্তু শেষ হয় আমাদের বর্তমান বাড়িতে এসে।’’ সন্দীপ জানালেন, লেক টেম্পল রোডের বাড়িতে আসার আগে তাঁরা থাকতেন ৩১, লেক অ্যাভিনিউয়ের দোতলার ফ্ল্যাটে। সেই বাড়ি আপাতত ইসকনের জিম্মায়।
সন্দীপ আরও জানালেন, বছর পাঁচেক আগে এক পরিচিতের সূত্রে লেক টেম্পল রোডের বাড়ির কিছু ছবি তিনি দেখেছিলেন। বাড়ির অন্দরের কিছু কিছু পরিবর্তন তখনই তাঁর নজরে আসে। তবে এই বাড়িতে তাঁর শৈশবের সেরা সময় কাটিয়েছেন বলেই জানালেন সন্দীপ। বললেন, ‘‘ওই বাড়িতে ঠাকুমা, দিদা সবাই থেকেছেন। তিন তলায় থাকতাম বলে ছাদটা ছিল আমাদের উপরি পাওনা। মনে আছে, ছাদে জন্মদিন পালন ও অন্যান্য অনুষ্ঠানও হত।’’ একই সঙ্গে সন্দীপ জানালেন, ওই বাড়িতে থাকাকালীনই রায় পরিবারে পিয়ানোর প্রবেশ। সন্দীপের কথায়, ‘‘ও বাড়ি থেকেই তো বাবার সঙ্গীত পরিচালনার সূত্রপাত। তাই বাবার ক্ষেত্রে সব দিক থেকেই ওই বাড়ি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।’’
লেক টেম্পল রোডের বাড়িটির মালিকানা বদল নিয়ে অবগত নন সৌমিত্র-কন্যা পৌলোমী চট্টোপাধ্যায়ও । আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বললেন, ‘‘এই খবরটা জানতাম না। ওখানে অফিস হবে! ভাবতে পারছি না।’’ পৌলোমী জানালেন, তাঁর বড় হওয়ার দিনগুলোর যাবতীয় সুখস্মৃতি লেক টেম্পল রোডের বাড়ির সঙ্গেই জুড়ে রয়েছে। বললেন, ‘‘এই বাড়িকে আমরা কোনও দিন ভাড়াবাড়ি হিসেবে দেখিনি। বাবা কত ভাল ভাল কাজ ওই বাড়িতে থাকাকালীন করেছিলেন! সামনের বাগানে স্কুল থেকে ফিরে খেলাধুলো করার দিনগুলো এক ঝটকায় মনে পড়ে গেল। ওই পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে আজও আমার যোগাযোগ রয়েছে।’’ ছেলেবেলার স্মৃতির হাতবদলে পৌলোমীর মনে কি কোনও আক্ষেপ কাজ করছে? পৌলোমী বললেন, ‘‘আক্ষেপ নেই, কাউকে দোষারোপও করতে চাই না। কারণ, দিনের শেষে ওটা ব্যক্তিগত সম্পত্তি। অনেক সময়েই অনেক কিছু করে ওঠা সম্ভব হয় না।’’
২০১৪ সালে এই বাড়িতেই তাঁর ‘ফেলুদা: ফিফটি ইয়ারস অফ রে’জ় ডিটেকটিভ’ তথ্যচিত্রের আংশিক শুটিং করেছিলেন পরিচালক সাগ্নিক চট্টোপাধ্যায়। আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বললেন, ‘‘অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। ওই বাড়িতেই তো লেখক সত্যজিৎ রায়ের শুরু। ফেলুদার জন্ম ওই বাড়িতে বলে সেখানে শুটিং করতেই হয়েছিল।’’
বাস্তব ছবিটা এই যে, ব্যক্তিগত মালিকানার কোনও সম্পত্তির হাতবদল নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে না। কিন্তু যে বাড়ির ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে, সেখানে সরকারি পদক্ষেপ হয়তো করা যেত। সাগ্নিকের যুক্তি, ‘‘এর আগেও ৩১, লেক অ্যাভিনিউ এবং ৩, লেক টেম্পল রোডের বাড়িকে হেরিটেজ ঘোষণা করার জন্য দাবি উঠেছিল। কিন্তু তার পর কিছুই হয়নি। বিদেশে অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের বাড়িও তো ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ছিল। কিন্তু উদ্যোগ নিয়ে তো সেগুলো সংরক্ষণ করা হয়েছে!’’ এক প্রতিবেশীর কথায়, ‘‘এখানে তো আমরা নিরুপায়। বসু পরিবারের পরবর্তী প্রজন্ম শুরু থেকেই এখানে থাকতেন না। এই বাড়ির গুরুত্ব তাঁরা বোঝেননি। তাই তাঁরা যেটা ভাল বুঝেছেন, করেছেন।’’ সন্দীপ যোগ করলেন, ‘‘একটু হলেও খারাপ লাগছে। কিন্তু এখন তো যা শুনছি, বুঝতে পারছি, অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছে। আর কিছু করার নেই।’’
এই প্রসঙ্গে আনন্দবাজার অনলাইনের তরফে কলকাতা পুরসভার দায়িত্বপ্রাপ্ত মেয়র পারিষদ স্বপন সমাদ্দারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, এখনও পর্যন্ত লেক টেম্পল রোডের বাড়িটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব প্রসঙ্গে তাঁদের কাছে কোনও তথ্য জমা নেই। তিনি বলেন, ‘‘কোনও বাড়িকে হেরিটেজ ঘোষণার জন্য যে কেউ উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ-সহ পুরসভার হেরিটেজ কমিটির কাছে আবেদন করতে পারেন। তার পর কমিটি বিচার বিশ্লেষণ করে গ্রেড নির্ধারণ করে। সেই অনুযায়ী পুরসভা সিদ্ধান্ত নেয়।’’ লেক টেম্পল রোডের বাড়িটির ক্ষেত্রে যে তা করা হয়নি, তা স্পষ্ট।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy