শহরের আর যে কোনও তরুণের মতোই তিনি। সুখী, বেপরোয়া, মজাদার। গিটার বাজিয়ে গান গাওয়া আর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারা প্রিয় শখ। পরিবারের সদস্য বলতে রয়েছেন বাবা-মা, ছোট ভাই। সকলেই গানবাজনা ভালবাসেন। কিন্তু পরিবারে যে গানবাজনার চল আছে এমন নয়। নেই সিনেমা জগতের সঙ্গেও কোনও যোগাযোগ।
তিনি রাহুল পান্ডে।
লেক গার্ডেন্সের এই তরুণ এখন বলিউডের সুরকারদের প্রিয় গায়ক।
ইতিমধ্যে গান গেয়ে ফেলেছেন সলমন খানের প্রোডাকশনের ছবি ‘হিরো’র নায়ক সুরজ পাঞ্চোলির কণ্ঠে। সইফ আলি খান অভিনীত ‘হ্যাপি এন্ডিং’ ছবিতে ‘হাসিনা তু কামিনা ম্যায়’ আর বরুণ ধবন-আলিয়া ভট্ট অভিনীত ‘হাম্পটি শর্মা কি দুলহানিয়া’ ছবিতে ‘লাকি তু লাকি ম্যায়’ গান গেয়ে জনপ্রিয় হয়েছেন তিনি। তাঁর চনমনে গলায় মানিয়ে যায় পপ থেকে ব্লু সবই। আর বলিউডের রোম্যান্টিক নাম্বার তো আছেই।
‘‘আমার সত্তার মধ্যেই সঙ্গীত রয়েছে,’’ বলেন রাহুল। ছেলেবেলায় মা শোনাতেন ঘুমপাড়ানি গান। তখন থেকেই গানের প্রতি ভালবাসা। জনপ্রিয় পাশ্চাত্য সঙ্গীত গেয়ে প্রথম স্টেজে ওঠা স্কুলের অনুষ্ঠানে। তখন বয়স আট। তাঁর দক্ষতায় শান দেওয়ার জন্য বিড়লা হাই স্কুল সব রকমের ব্যবস্থাই করেছিল। পাঠ্যক্রমে অন্যতম বিষয় ছিল সঙ্গীত। গান শেখানো ছাড়াও বাদ্যযন্ত্র শেখারও ব্যবস্থা ছিল। রাহুলের গায়ক হয়ে ওঠার প্রথম ধাপের সূচনা হয়েছিল স্কুলে। ক্রমে রাহুল হয়ে ওঠেন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ ব্যান্ডের প্রধান গায়ক।
প্রতি রবিবার বিভিন্ন রকম পাশ্চাত্য সঙ্গীত গাওয়াটাই ছিল রাহুলের রেওয়াজ। গায়ক হিসেবে তাঁর ভবিষ্যৎ অন্ধকার বলেই মনে করতেন তাঁর পরিবার। এমন কেউ ছিলেন না যিনি সঙ্গীতগুরু হিসেবে রাহুলকে অনুপ্রাণিত করবেন বা শিক্ষা দেবেন। ক্লাস টেন পাশ করার পর রাহুল গানকেই জীবিকা করার কথা ভাবতে শুরু করেন। কিন্তু তাঁর পরিবার এ ব্যাপারে রাজি ছিল না। তাঁরা চেয়েছিলেন ছেলে সাধারণ শাখায় পড়াশোনা করে গতানুগতিক কোনও পেশা বেছে নিক।
আর রাহুলও সেই ইচ্ছেমতোই মুম্বই চলে যান এমবিএ করবেন বলে। এমবিএ পাশ করার পর একটি বহুজাতিক সংস্থায় কাজ করতে শুরু করেন। এবং তার পরে এক টিভি চ্যানেলেও যোগ দেন। এ সব সত্ত্বেও ভেতরে ভেতরে সঙ্গীতের জন্য অস্থিরতা লেগেই রইল। ভাল রোজগার করা সত্ত্বেও সস্তার বাড়িতে ভাড়াটে হয়ে উঠে গেলেন। গাড়িঘোড়ার বদলে পায়ে হেঁটে বাড়ি পৌঁছতে শুরু করলেন। তখন যে ভাবে হোক টাকা সঞ্চয় করাটাই উদ্দেশ্য।
‘‘আমার সংগ্রাম ছিল নিজের সঙ্গে নিজের। টাকা জমিয়ে চাকরি ছাড়ার স্বপ্ন দেখতাম যাতে নিজের স্বপ্নপূরণ করতে পারি। সমস্ত ধরনের গান গাওয়ার অফার নিতে শুরু করলাম। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে লাগলাম ব্রেক পাওয়ার জন্য,’’ বলেন রাহুল।
সুরকার সচিন–জিগার রাহুলের গান শুনে উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন। তাতে তাঁর প্লেব্যাক গায়ক হওয়ার আশা আরও বেড়ে গেল। আশা বাড়লেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছিল না। গান গাইবার সুযোগ আসছিল না। এই ভাবে এক বছর কাটার পর গানের প্রস্তাব নিয়ে ফোন এল সচিন-জিগারের কাছ থেকে। ‘‘ ওঁরা বলেছিলেন সঠিক গান পেলে আমাকে ডাকবেন। গান পাওয়ার পর কথা রেখেছিলেন,’’ কৃতজ্ঞতা মেশানো গলায় বলেন রাহুল।
যখন গান গাওয়ার প্রস্তাব এল রাহুল জানতেন না কে তাঁর গানে লিপ দেবেন। গান রেকর্ড হওয়ার বেশ কিছু মাস পরে তিনি জানতে পারেন তাঁর গানে ‘হ্যাপি এন্ডিং’’ ছবির জন্য লিপ দিচ্ছেন স্বয়ং সইফ আলি খান। ‘‘বলা যায় আমার কেরিয়ার শুরু হল স্বপ্নের মতো। জীবন আমার জন্য এমন পরিকল্পনা করে রেখেছিল,’’ আত্মবিশ্বাসের গলায় বলে ওঠেন রাহুল। আত্মবিশ্বাস থাকলেও হঠাৎ পাওয়া সাফল্যের অহঙ্কার তাঁর গলায় ঝরল না লেশমাত্র।
মাটিতে পা রেখে চলা এই তরুণ খুব খুশি এই কথা ভেবে যে তাঁর গায়ক হওয়ার পথে তাঁর বাবা-মা, শ্বশুরবাড়ির লোকজন, স্ত্রী আকৃতি সকলেই প্রেরণা জুগিয়েছেন। চাকরি ছাড়ার সময়ও অসম্ভব স্বপ্নকে সফল করার ব্যাপারে বাড়ির লোকজনের কাছে অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়েছেন রাহুল। ‘‘যখন কোনও সুযোগই আসছিল না তখন অনেকেই বলেছিল তল্পিতল্পা নিয়ে ফিরে যেতে। মানুষজনের প্রত্যাখ্যান আমার মনের জোর আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল,’’ বলেন রাহুল।
সে ভাবে সঙ্গীতের কোনও গুরু ছিল না। কলকাতায় যখন থাকতেন কণ্ঠশিল্পী পণ্ডিত জগদীশ প্রসাদের কাছে কিছু দিন তালিম নিয়েছিলেন। তবে পুরোটা মনোযোগই থাকত রক আর নানা ধরনের পাশ্চাত্য সঙ্গীতের দিকে। কলকাতার বিভিন্ন আড্ডায় গান গাইতেন রাহুল। তখনই গিটার শিখেছিলেন অমিত দত্তের কাছে।
মুম্বই গিয়ে রাহুলের বারবার মনে হতে লাগল গানের সঠিক তালিম দরকার। সেই কারণেই টিভি রিয়েলিটি শোর মেন্টর সুচেতা ভট্টাচার্য়ের কাছে তালিম নেন। ‘‘মুম্বই গিয়ে আমি বুঝতে পারলাম অন্যান্য গায়কের তুলনায় আমার গলায় পালিশ কম,’’ স্বীকার করলেন রাহুল। সুচেতা ভট্টাচার্য়ের কাছে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পাশাপাশি রাহুল পশ্চিমী সঙ্গীতের তালিম নেন সামান্থা এডওয়ার্ডসের কাছে। এই সামান্থার কাছেই সঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন প্রিয়াঙ্কা চোপড়া সঙ্গীতকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার আগে।
গান সম্পর্কে সব সময় খুঁতখুঁতে রাহুল নিজের গলা ঠিক করার জন্য সব রকম চেষ্টা করেছেন, বিশেষজ্ঞদের কাছে প্রশিক্ষণ নেওয়া থেকে সঙ্গীতের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পরীক্ষা দেওয়া সবই করেছেন। এমনকী কর্নাটকী সঙ্গীতেও প্রশিক্ষণ নিয়েছেন বিজয়া শঙ্করের কাছে।
‘‘আমি সব ধরনের গান শুনি। বিশেষজ্ঞদের কাছে গান শেখার পাশাপাশি ছোটদের তালিমও দিয়ে থাকি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গাই,’’ হেসে বলেন তিনি। অনেক দিন মুম্বইতে থাকলেও কলকাতা এখনও তাঁর প্রিয় শহর। প্রিয় আড্ডার জায়গা।
ইতিমধ্যে সইফ তাঁর গানের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করছেন। রাহুল এখন অপেক্ষা করছেন সলমন তাঁর গান শুনে কী বলেন তা শোনার জন্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy