Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
kishore kumar

Kishore Kumar-Ruma Guha Thakurta: মায়ের প্রাক্তন তো, কিশোর কুমারকে আমি বরাবর বাপি বলেই ডাকতাম: শ্রমণা

আমার মনে আছে বাপি বিদেশ গেলে কেবল দাদাভাইয়ের (অমিত কুমার) জন্য নয়, আমাদের সবার জন্য জিনিস আসত।

রুমা গুহঠাকুরতা এবং কিশোর কুমারকে নিয়ে কলম ধরলেন শ্রমণা

রুমা গুহঠাকুরতা এবং কিশোর কুমারকে নিয়ে কলম ধরলেন শ্রমণা

শ্রমণা চক্রবর্তী
শ্রমণা চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০২১ ১৮:৫৮
Share: Save:

আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই মনে হল, বাপি গান গেয়ে আমায় ঘুম পাড়াত। সেই ঘুম আর তো আসেনি।

আজ ৩৪ বছর পেরিয়ে গেল, বাপি নেই। বাপিকে কোনও দিন কিশোর কুমার হিসেবে দেখিনি আমি। তারকা সুলভ আচরণ ছিল না তো। বাপি বাইরে যা ছিল, অন্দর মহলে তাঁর অন্যই রূপ দেখা যেত। পুরো ব্যক্তিত্বই যেত বদলে। পোশাক ছাড়ার মতো করে ‘কিশোর কুমার’-এর সত্তা ছেড়ে আভাস কুমার গঙ্গোপাধ্যায় (কিশোর কুমারের আসল নাম) হয়ে ঘরে ঢুকতেন।

আমার মনে আছে বাপি বিদেশ গেলে কেবল দাদাভাইয়ের (অমিত কুমার) জন্য নয়, আমাদের সবার জন্য জিনিস আসত। দাদাভাইয়ের সঙ্গে আমার এখনও প্রায়ই কথা হয়, দু’টি আলাদা শহর হলেও, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হইনি। হ্যাঁ জানি, এখনকার দিনে সম্পর্ক নিয়ে বড্ড বেশি আলোচনা হয়। কার পরিবারে কী রকম সম্পর্ক ইত্যাদি। কিন্তু আমরা নিজেরাই এত সুন্দর করে সব সম্পর্কগুলোকে লালন করেছিলাম তাই কখনও মনে হয়নি বাপি আমার দ্বিতীয় বাবা। কয়েকটা ঘটনা বললে সেটা বোঝা আরও সহজ হবে।

কিশোর কুমার এবং রুমা গুহঠাকুরতা

কিশোর কুমার এবং রুমা গুহঠাকুরতা

আটের দশকের শুরুর দিকের ঘটনা। কলকাতায় এসে হৃদরোগে আক্রান্ত হন বাপি। মাসখানেক এখানে ছিলেন। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর হোটেলে থাকতেন। সেই সময়ে লীনাদি (লীনা চন্দভরকর, কিশোর কুমারের চতুর্থ স্ত্রী) আমাদের বাড়িতে ছিলেন। শুধু তাই নয়, অশোক কুমারও এক সময় আমাদের বাড়িতে রোজ এসে খাওয়া দাওয়া করতেন। কারও কোনও দিন অস্বস্তি হয়নি। আমার নিজের বাবাও বাপিকে খুব ভালবাসতেন। বাপির মৃত্যুর পরে বাবাকে যে ভাবে কাঁদতে দেখেছি, সে ভাবে আর কখনও দেখিনি। তার আগে কেবল ঠাকুমার মৃত্যুর পরে অমন করে কেঁদেছিলেন আমার বাবা।

ছোটবেলার কয়েকটা মজার ঘটনা মনে পড়ছে আজ। হৃদরোগ থেকে সেরে ওঠার পরে বাপিকে মুম্বই ফিরতেই হবে নানা কাজে। কিন্তু চিকিৎসক বলে দিয়েছিলেন, এখনই বিমানে চড়তে পারবেন না। ট্রেনে ফার্স্ট ক্লাসে করে যাবেন। আমরাও লাফাতে লাফাতে বাপির সঙ্গে স্টেশনে গিয়েছি। লীনাদিও ছিলেন। কিন্তু তখন তো বাপি তারকা! সে বোঝার ক্ষমতা আমাদের ছিল না। মানুষের ভিড় এড়াবেন কী করে? কার মাথা থেকে বেরিয়েছিল জানি না, বাপিকে বোরখা পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল, যাতে লোকে চিনতে না পারে!

কিশোর কুমার

কিশোর কুমার

রেডিয়োয় গান বাজলে আমরা শুনতাম। দিদিমার রেডিয়ো চালাতেন, আমি পাশে শুয়ে থাকতাম। মনে আছে, বাপির গান হলে দিদিমা মন দিয়ে শুনতেন। কিন্তু তার পর মহম্মদ রফির গান শুরু হলেই বন্ধ করে দিতেন রেডিয়ো। এখন কারণগুলি বুঝতে পারি। আর তাই খুব হাসি পায়।

বাপি বাঙালি খাবার খুব পছন্দ করতেন। মা আমাদের রাঁধুনী মদনদাকে মুম্বইয়ে বাপির কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। মদনদার কাছ থেকে জানতে পারতাম, মাছের ঝোল রান্না করবেন বলে হয়তো আয়োজন করছেন মদনদা, সাঁতলোনোর সময়েই নাকি বাপি ছোবল মেরে মাছ কেড়ে নিতেন। এত পছন্দ ছিল বাঙালি খাবার।

বাপি গান গুনগুন করতেন, আর ,তা-ই শুনে আমি ঘুমিয়ে পড়তাম। কখনও ‘আ চল কে তুঝে’, কখনও বা ‘ভামরে কি গুঞ্জন’। আজও সেই সব কানে বাজে। রবি ঠাকুরের গান গাইতে খুব ভয় পেতেন বাপি। বলতেন, ‘‘উরি বাবা! স্বরলিপি দেখে গাইতে হয়।’’ কিন্তু বাপি রবীন্দ্রসঙ্গীতও কী ভাল গাইতেন !

রুমা গুহঠাকুরতার সঙ্গে শ্রমণা

রুমা গুহঠাকুরতার সঙ্গে শ্রমণা

বিদেশি ছবি দেখার অভ্যেস বাপির থেকেই আমার আসে। ১৫ বছর তখন আমার। বাপি ভিসিডি নিয়ে আসতেন বিদেশ থেকে। ছবি দেখতাম বাপির সঙ্গে বসে। সেই আমার আমেরিকান মিউজিক্যাল দেখা শুরু। মেরিলিন মনরোর কিছু ছবিও দেখেছিলাম, মনে আছে। তা ছা়ড়া প্রজেক্টরে বাপি নিজের ছবিও দেখাতেন। তখন বুঝতাম না, যাকে পর্দায় দেখছি, সেই লোকটাকেই বাপি বলে ডাকি! মায়ের ক্ষেত্রেও তাই হত। টেলিভিশনের পর্দায় মাকে গান গাইতে দেখতাম, আর সেই মানুষটির পাশে শুতাম রাতের বেলা। দু’টিকে পৃথক করতে পারিনি কোনও দিন। এখন ভাবলে অবাক লাগে।

বাপি এক বার পরিকল্পনা করেছিলেন একটি ছবিতে আমাকে দিয়ে অভিনয় করাবেন এবং গানও গাওয়াবেন। ‘দিনু কা দিনানাথ’ বলে একটি ছবির কথা হয়, কিছুটা কাজও এগোয়। ‌দাদাভাই নায়ক, আমি তার ছোট বোন। তখন আমার ছয়-সাত বছর বয়স। গানও শিখিয়েছিলেন দাদার সঙ্গে গাওয়ানের জন্য। কিন্তু তার পর ছবিটার শ্যুটিং হয়নি। বাপি মারা যাওয়ার পরে বরং আমার গানের অ্যালবাম বেরোয়। বাপি সেটি আর দেখে যেতে পারলেন না। ‘জিন্দেগি কে সফর মে' গানটি গেয়ে একটি ভিডিয়ো করেছিলাম আমি। সেই গান শুনে গানের সংস্থা আমাকে যোগাযোগ করেছিলেন। নয়ের দশকে অ্যালবাম প্রকাশিত হয়।

কিশোর কুমার

কিশোর কুমার

খুব কম বয়সে বাপিকে হারিয়েছি আমি। ১৮ বছর বয়স তখন আমার। তাই বাপির সঙ্গে খুব বেশি সময় কাটানো হয়নি কিন্তু যত দিন পেয়েছি, মন খুলে আবদার করেছি। আর বাপি সব বায়না পূর্ণ করেছেন। ১৫-১৬ বছর বয়স থেকে খুব ভাল বন্ধু হয়ে গিয়েছিল বাপি। গাড়ি করে মুম্বইয়ের রাস্তায় ঘুরতে বেরোনো থেকে শুরু করে আরও কত কী! রাস্তায় বেরোলে লোক জন তাদের কিশোর কুমারকে ফিরে ফিরে দেখছেন, আমি ভাবতাম, এত কী দেখার আছে!

যখন বাপি আর নেই, মা কিন্তু বাপির বাড়িতেই শেষ দিনগুলি কাটিয়েছেন। লীনাদি, দাদাভাই এবং তাঁর স্ত্রী রিমা বৌদি, সবাই মিলে মায়ের সেবা করেছেন। বাপি কিন্তু কোনও দিন কাউকে সখ্য রাখার কথা শেখাননি। আপনাআপনি হয়েছে। লীনাদির মনের মধ্যেও বোধহয়, একটা বোধ কাজ করত যে, মা বাপির প্রথম স্ত্রী, সেই ভাবনা থেকেই মাকে সেবা করেছিলেন তিনি। এই সখ্যতা দুম করে হয় না। তখন লীনাদিরও তো কম বয়স। কিন্তু কী ভাবে সবাই আমরা জড়িয়ে জড়িয়ে থাকতাম, সেটি এখন কেউ ভাবতেই পারবে না! আর আমার তো খুব আনন্দ হত। আমার দু’জন বাবা। দুই জায়গা থেকে একই রকম আদর পেতাম।

শ্রমণা চক্রবর্তীর ‘বাপি’

শ্রমণা চক্রবর্তীর ‘বাপি’

বাপির ৯২তম জন্মদিন আজ। বাপির এক মূর্তিতে মালা দিয়ে এসেছি। ঠিক ৩৪ বছর আগে বাপি মারা যাওয়ার খবর পাই। মনে আছে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আমাদের বাড়িতে দেখা করতে এসেছিলেন। কেউ কিন্তু সে কথা জানতেন না। এখন তো সাংবাদিকদের খবর দিয়ে তার পর কারও বাড়িতে যাওয়া হয়। কাউকে ছোট না করেই বলছি এখনকার সম্পর্কতে দেখনদারি বেশি। তখন তা ছিল না।

বাপি তুমি আড়াল হয়েও আমার মধ্যে সুর হয়ে, আনন্দ হয়ে আছো।

(লেখক: রুমা গুহাঠাকুরতার দ্বিতীয় পক্ষের মেয়ে শ্রমণা গুহঠাকুরতা, কিশোর কুমার তাঁর দ্বিতীয় বাবা, যাঁকে তিনি ‘বাপি’ বলে ডাকতেন।)

অন্য বিষয়গুলি:

kishore kumar birth anniversary Ruma Guha Thakurta
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy