ফাইল চিত্র।
বাংলা চলচ্চিত্র জগতের এক প্রধান স্তম্ভ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর সৃষ্টিপ্রতিভাকে বিভিন্ন ধারায় প্রবাহিত করেছিলেন। বাংলার চলচ্চিত্র অভিনেতাদের মধ্যে এমন কোনও শিল্পী নেই, যাঁর একই সঙ্গে কবিতাসমগ্র, গদ্যসমগ্র এবং নাটকসমগ্র প্রকাশিত হয়েছে। আমার ধারণা, পুরো ভারতের চলচ্চিত্র অভিনেতাদের মধ্যেও কবিতাসমগ্র, গদ্যসমগ্র এবং নাটকসমগ্র আছে, এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এক বার, একটি ব্যক্তিগত আলাপচারিতায়, আমি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে একটা বোকার মতো প্রশ্ন করে ফেলি। কিন্তু প্রশ্নটি বোকার মতো হলেও যে-উচ্চতায় তাঁর উত্তরটিকে পৌঁছে দিয়েছিলেন এই শিল্পী, তা আমার কাছে বিশেষ ভাবে স্মরণীয় হয়ে আছে। আমার প্রশ্নটি ছিল এই রকম: আপনি তো অভিনয়ের মধ্য দিয়ে, সিনেমায় এবং নাটকে, দু’ভাবেই নিজের সত্তাকে প্রকাশ করতে পারেন। তা করেও চলেছেন অব্যাহত ভাবে। তা হলে আবার আপনার কবিতা লেখার দরকার হয় কেন? কবিতা তো মানুষ নিজেকে প্রকাশ করার জন্যই লেখে। আপনি তো অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে সেই প্রকাশ সম্ভব করতে পারছেন। তা হলে কবিতা কেন?
এই কথায় তিনি কিন্তু রেগে যাননি। উত্তরে বলেছিলেন, অভিনয়ের সময় কী হয় জানো, আমি কোনও একটা চরিত্রের অন্তরালে আত্মগোপন করি। বলা যায়, চরিত্রটিকে সামনে রেখে তার পিছনে লুকিয়ে পড়ি। বা, উবু হয়ে বসে থাকি। চরিত্রটিই তখন আমার আড়াল। এই বার সেই চরিত্রের সত্তার সঙ্গে নিজেকে অল্প অল্প করে মিশিয়ে চরিত্রটিকে ফুটিয়ে তোলার কাজটা শুরু হয় আমার মধ্যে। কিন্তু কবিতা লেখার চেষ্টা যখন করি তখন ব্যাপারটা হয়ে যায় একেবারে অন্য রকম। তখন কোনও চরিত্রের মধ্যে ঢুকে আমাকে কথা বলতে হচ্ছে না আর। এই আমি, মানে আমার যা সারাংশ, তাকেই আমি সরাসরি কবিতায় বলতে পারছি। এই নিজের সারাংশকে বলার চেষ্টা আমার কলেজজীবন থেকেই সঙ্গে থেকে গেছে। এই ভাবে নিজের সত্তাকে প্রকাশ করে চলবার পথে সচল থেকেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সারা জীবনই, অভিনয়ের শত ব্যস্ততার মধ্যেও। একের পর এক কবিতার বই বেরিয়েছে তাঁর। যেমন, জলপ্রপাতের ধারে দাঁড়াব বলে, শব্দরা আমার বাগানে, হে সায়াহ্নকাল, পদ্মবীজের মালা। এ রকম পনেরো-ষোলোটি কবিতার বই আছে তাঁর। তিনি অনুবাদ করেছেন খলিল জিব্রানকে।
আরও পড়ুন: আক্ষেপ থাকল, সৌমিত্রকে কাজে লাগাতে পারিনি
কবিতা লেখার ব্যাপারে সারা জীবন কতটা সজাগ ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, তার একটি প্রমাণ সদ্যই আমাদের সামনে এসেছে। মাত্র গত বছর, শারদীয় দেশ-এ, সৌমিত্র লিখেছিলেন একটি নতুন ধরনের কবিতা, যা তাঁর এত দিন ধরে লিখে আসা কবিতার তুলনায় একটি নবতর আঙ্গিকের পরীক্ষায় জাগিয়ে দিয়েছে। দীর্ঘ সেই কবিতা পুরোপুরি গদ্যে রচিত, আর স্তবকবন্ধের বদলে সেখানে ব্যবহৃত হয়েছে প্যারাগ্রাফ। প্যারাগ্রাফের পর প্যারাগ্রাফ দিয়ে গ্রথিত এই কবিতা ২০২০-র বইমেলায় সিগনেট প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। যে-কেউ এক বার পড়ে দেখলেই বুঝবেন, যে ৮৪ বছর বয়সে দাঁড়িয়েও নিজের কবিতা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করার কেমন সাহস দেখিয়েছেন সৌমিত্র। তিনি এক দিন লিখেছিলেন, “পথে আজ বড় বেশি লোক/ মিছিলে কী খুঁজে পাবে হারানো বালক?” আমরা আজ বুঝি, ৮৪ বছর বয়স পার করেও ওই বালকটি আর কেউ নয়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিজেই। এই পৃথিবীর, এই সমাজ-সংসারের ভরা মিছিলের মধ্যে শিল্পী সৌমিত্র যেন কেবলই আত্মসন্ধান করে যাচ্ছেন তাঁর কবিতার মাধ্যমে। একটি কবিতায় তিনি লিখেছিলেন, “ঘোষণা করে দাও/ অনুশোচনার মৃত্যু হয়েছে গতকাল... অশ্রুর নবজন্ম হয়েছে গতকাল...।” মধ্যরাতের সঙ্কেত নামক তাঁর কাব্যগ্রন্থে এই কবিতাটি গন্তব্যের শেষে এমন কয়েকটি লাইনে এসে পৌঁছেছে, যা কখনও ভোলা যায় না। লাইনগুলি এই রকম: “তুমি শীতার্তদের জন্য/ এবার একটা ম্যানিফেস্টো রচনা করো/ পাতাঝরার গর্জন থাক তার মধ্যে/ তোমার গিটারে যে আগুন/ তারই প্রতিশ্রুতি থাক/ তোমার ম্যানিফেস্টোয়।” পাতাঝরার গর্জন? এ তো একটি অভাবিত লাইন! সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার বইয়ের যে সমগ্র আছে, তার মধ্যে খুঁজে দেখলে এ রকম অনেক আশ্চর্য কাব্য¬-অভিব্যক্তি বা এক্সপ্রেশন খুঁজে পাওয়া যাবে। কবিতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের আজীবনের সঙ্গী। কবিতার পাঠক হিসেবেও তাঁর আগ্রহ এবং সন্ধিৎসা অতুলনীয়, ব্যক্তিগত মেলামেশায় তার প্রমাণ পেয়েছি। নবীন, নবীনতর কবিদের লেখাও তিনি যত্ন করে পড়তেন। তিনি রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, সুনীল, শক্তি এঁদের পাশাপাশি নবীনদের কবিতাও মঞ্চে দাঁড়িয়ে আবৃত্তি করেছেন, এমন দৃষ্টান্ত আছে। আর একটা কথা না বললেই নয়— সৌমিত্রর মনের কেন্দ্রে সব সময় বিরাজমান থেকেছেন রবীন্দ্রনাথ। যে কোনও সাক্ষাতে তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময়, রবীন্দ্রনাথ এসে পড়তেনই।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি কবিতার বইয়ের নাম হায় চিরজল: নামটি বইয়ের প্রচ্ছদে দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। জলের আগে ‘চির’ শব্দটিকে কী ভাবে সংযুক্ত করেছেন রচনাকার? তাঁর কাব্যক্ষমতার একটি অব্যর্থ পরিচয় পাওয়া যায় এখানে। যদিও আমরা এখন বুঝতে পারছি, সেই ‘চিরজল’ আজ তাঁকে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে কোনও অনন্ত শান্তিনিবাসের দিকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy